ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাজশাহী থেকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় স্ত্রী ঘড়িয়াল

শায়েখ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২২, ১২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজশাহী থেকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় স্ত্রী ঘড়িয়াল

শায়েখ হাসান :  দশ বছর আগেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মহাবিপন্ন সরীসৃপ ঘোষণা করা হয়েছে ঘড়িয়ালকে। যদিও এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণীটি পাওয়া যায়। ঢাকা চিড়িয়াখানায় চারটি ঘড়িয়াল রয়েছে। কিন্তু পুরুষ ঘড়িয়ালের সংখ্যাই বেশি। তাই ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান চিড়িয়াখানা ও কেন্দ্রীয় উদ্যান থেকে আনা হয়েছে স্ত্রী-ঘড়িয়াল।

চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দুপুরে ঘড়িয়ালটি চিড়িয়াখানা আনা হয়। আর ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে একটি পুরুষ ঘড়িয়াল নেওয়া হবে রাজশাহীতে। সেখানে দুটো ঘড়িয়াল রয়েছে, দুটোই স্ত্রী-ঘড়িয়াল। এভাবে উভয় চিড়িয়াখানার ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে চিড়িয়াখানার নিঃসঙ্গ এবং অধীক বয়সী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে চিড়িয়াখানা সূত্র জানিয়েছে।

ঢাকা চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এসএম নজরুল ইসলাম  রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘শুক্রবার রাতেই রাজশাহী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান চিড়িয়াখানা ও কেন্দ্রীয় উদ্যানের একটি মেয়ে ঘড়িয়ালকে ঢাকা চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। ঘড়িয়ালটির বয়স প্রায় ২০ বছর।’

বাংলাদেশের সরীসৃপগুলোর যে তালিকা রয়েছে তাতে ঘড়িয়াল এক অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রানি। দেখতে কুমিরের মতো, কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে ঠিক কুমির না। লম্বা চ্যাপ্টা মুখ। আপাতদৃষ্টিতে হিংস্র কিন্তু আসলে নিরীহ এক সরীসৃপ। এক সময় দাপিয়ে বেড়াতো বাংলার পদ্মা-যমুনা অববাহিকার নদী-নালায়। তাদের এখন আর চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে জেলেদের জালে আটকা পড়ে। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। তাই দেশের চিড়িয়াখানাগুলোতে এই সরীসৃপ প্রাণীকে টিকিয়ে রাখার প্রতি জোর দেওয়া হয় সবসময়।

২০০৭ সালে কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অব এনডেঞ্জার্ড স্পেসিস (সিটস) ঘড়িয়ালকে বিশ্বের অতিবিপন্ন প্রাণী হিসেবে ‘লাল’ তালিকাভুক্ত করেছে। ঘড়িয়াল নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিলোপ হয়ে গেছে। এক সময় বাংলাদেশে পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রচুর ঘড়িয়ালের আনাগোনা ছিল। বাংলাদেশেও এখন ঘড়িয়াল প্রায় বিলুপ্ত।

চিড়িয়াখানা সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকটি ঘড়িয়াল উদ্ধার করা হয়।  ২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপকরা পদ্মার চরে একটি বাচ্চা ঘড়িয়ালের সন্ধান পান। পরে সেটিকে কক্সবাজারের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে অবমুক্ত করা হয়। ২০০৯ সালে পদ্মা নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়ে আরো একটি ঘড়িয়ালের বাচ্চা। সেটিকে রাজশাহী চিড়িয়াখানায় রাখা হয়। যদিও পরে সেটি মারা যায়। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পাচারকালে ঢাকা বিমানবন্দরে প্রায় এক হাজার কচ্ছপের সঙ্গে একটি ঘড়িয়ালের বাচ্চাও উদ্ধার করা হয়।  একই বছরের ৩১ অক্টোবর মানিকগঞ্জের শিবালয়ের আরুয়া ইউনিয়ন সংলগ্ন পদ্মা নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়ে একটি বাচ্চা ঘড়িয়াল। পরদিন আড়াই ফুট দীর্ঘ ও দেড় বছর বয়সী ঘড়িয়ালটিকে আবার পদ্মাতেই অবমুক্ত করা হয়।

২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে ধরা পড়ে একটি ঘড়িয়ালের বাচ্চা। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর  রাজবাড়ি জেলার সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের আম্বারিয়া চরের পদ্মা নদীতে ওরাকান্দা গ্রামের আমজাদ হোসেনের জালে আটকা পড়ে দু’বছর বয়সী একটি ঘড়িয়াল। তাৎক্ষণিকভাবে বন বিভাগের ডেপুটি রেঞ্জার ও ফরেস্টার ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত ঘড়িয়ালটি উদ্ধার করেন। ২০১৩ সালের ৩০ মে রাজশাহীর গোদাগাড়ি থেকে উদ্ধার করা ঘড়িয়াল ছানাটি চিড়িয়াখানা বা অন্য কোথাও সংরক্ষণ সম্ভব না হওয়ায় আবার পদ্মা নদীতেই অবমুক্ত করা হয়।

এদিকে দেশে ঘড়িয়াল কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এবং ভারত দু’দেশেই ঘড়িয়ালের ওপর অত্যাচার করে কিছু মানুষ। ওরা নানাভাবে ঘড়িয়াল শিকার করে ডিম ছিনিয়ে নিয়ে ওদের বংশবিস্তার রোধ করে দিয়েছে। চোরাই শিকারিদের কাছে ঘড়িয়াল অত্যন্ত লোভনীয় শিকার। শিকার করতে পারলে চড়া দাম পায় ওরা। সাধারণত ঘড়িয়ালের চামড়া দিয়ে লেডিস ব্যাগ, মানিব্যাগ, জুতা তৈরি হয়। আর এদের তেল ও চর্বি ওষুধ শিল্পে ব্যবহার করা হয়।

ঘড়িয়াল দ্রুত বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে জেলেদের জালে ধরা পড়া। জেলেরা পেলেই ঘড়িয়ালদের পিটিয়ে হত্যা করে। ওদের ধারণা এরা কুমির জাতীয় প্রাণী এবং মানুষ খেকো। আসলে ঘড়িয়াল মানুষ খেকো নয়, শান্ত প্রাণী। ঘড়িয়াল শুধু মাছ, সাপ, ব্যাঙ খায়; অন্যকিছু খায় না। কালেভদ্রে জলজ পাখি খায়। ঘড়িয়াল হচ্ছে মস্যভূক প্রাণী।

চৈত্র মাস ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু। এ সময় স্ত্রী ঘড়িয়াল বালুতে ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার গর্ত করে একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০টি ডিম পাড়ে। ক্যাপসুল আকৃতির ধবধবে সাদা ডিমগুলো লম্বায় প্রায় ১২ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। ডিমের ওজন প্রায় ২৫০ গ্রাম। ৬০ থেকে ৭৫ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চাগুলো লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার হয়। বাচ্চাদের প্রধান শত্রু  বড় ঘড়িয়াল, কুমির, শিকারি পাখি, বোয়াল জাতীয় রাক্ষুসে মাছ ইত্যাদি। বাচ্চারা বছর তিনেকের মধ্যেই প্রায় ১ দশমিক ৫৩ মিটার লম্বা হয়। চার-পাঁচ বছরে প্রজননক্ষম হয়। এরা ৫০ থেকে ৬০ বছর বাঁচে।

বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ৪টি, রাজশাহী চিড়িয়াখানায় ৩টি, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের পুকুরে ২টি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, কক্সবাজারে ১টি ঘড়িয়াল আছে।

ঘড়িয়াল সংরক্ষণের বিষয়ে চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ঘড়িয়াল টিকিয়ে রাখতে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে ভারত ও নেপালের মতো এ দেশেও কৃত্রিম প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ‘এখন শ্রাবণ মাস চলছে। বলতে গেছে শ্রাবণ তো প্রায় শেষই। আর কয়েক মাস পরেই বসন্ত আসবে। চৈত্র মাস ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু। এ সময়ে ঘড়িয়াল শিকার থেকে সবার বিরত থাকা উচিত।’

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৭/শায়েখ/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়