ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মধুর ভাণ্ডার মানিকগঞ্জের সরিষাখেত

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৩, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুর ভাণ্ডার মানিকগঞ্জের সরিষাখেত

জাহাঙ্গীর আলম বকুল, মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে : ফয়সাল হোসেন। বাড়ি বাগেরহাটে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। তবে তিনি চাকরির পেছনে ছোটেননি। বিসিক থেকে কৌতূহলবশত মৌমাছি পালনের ওপর যে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেটিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

বছরের ছয় মাস মৌমাছির বক্সগুলো নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরে মধু সংগ্রহ করেন তিনি। আর ছয় মাস নিজ এলাকার মাছের ঘের দেখাশুনা করেন। শুধু মধু সংগ্রহ থেকে তার বছরে আয় হয় ১০ লাখ টাকা।

ফয়সাল হোসেন চলতি মৌসুমে মানিকগঞ্জ জেলায় সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে আসা মৌ চাষিদের মধ্যে অন্যতম। তার দেড় শতাধিক মৌমাছির বক্স আছে। সেই বিচারে তিনি একজন বড় মৌ চাষি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ অফিসের হিসাব মতে, সরিষার মৌসুমে মানিকগঞ্জে ২০ থেকে ২৫ জন মৌচাষি মধু সংগ্রহে আসেন। এ বছরও তারা এসেছেন। তারা জেলার ৩৬ হাজার হেক্টর জমির সরিষাখেত থেকে মধু সংগ্রহ করছেন। মৌ চাষিদের কারো কারো কাছে ৩০০ পর্যন্ত মৌমাছির বক্স আছে।

ডিসেম্বরের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত সরিষা মৌসুমে মৌচাষিরা মানিকগঞ্জে অবস্থান করে মধু সংগ্রহ করেন। এরপর এরা চলে যান শরিয়তপুর, মাদারীপুর এলাকায় কালোজিরা এবং ধনিয়ার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য। সেখানে তারা দেড় মাস মধু সংগ্রহের সুযোগ পান। আর লিচুর মৌসুমে তারা চলে যায় রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুর এলাকায়। সেখানে লিচু ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেন। সেখানেও তারা দেড় মাসের মতো মধু সংগ্রহ করার সুযোগ পান।

এভাবে মৌচাষিরা বছরে ছয় মাস মধু সংগ্রহ করার সুযোগ পান। বাকি সময়টা তাদের মৌমাছি পালন করতে হয়। এ সময়ে মৌমাছির বাঁচিয়ে রাখার জন্য চিনি খাওয়াতে হয়।



এ বছর মানিকগঞ্জে তিন সহস্রাধিক বক্স মধু সংগ্রহে নিয়োজিত আছে। চার থেকে ছয়দিন পরপর বক্সগুলো থেকে মধু আহরণ করা হয়। প্রতিবার প্রতি বক্স থেকে দেড় থেকে দুই লিটার মধু পাওয়া যায়। তবে মধুর পরিমাণ আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। যদি কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকে, তবে মধুর পরিমাণ কমে যায়।

আট/দশ বছর আগে মৌ চাষিরা মানিকগঞ্জে মধু সংগ্রহ শুরু করেন। প্রথমে ছোট পরিসরে শুরু হলেও এখন বৃহৎ পরিসরে মধু সংগ্রহ করা হয়। এখানে যে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহে আসেন, তাদের প্রায় সকলের বাড়ি খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা বা পার্শ্ববর্তী জেলায়। মৌ চাষিরা বিস্তীর্ণ সরিষাখেত এলাকায় কিছু দূর পরপর বক্সগুলো স্থাপন করেন। এক বক্সের মৌমাছিরা তিন কিলোমিটার এলাকা থেকে মধু সংগ্রহ করে।

মধু সংগ্রহ লাভজনক পেশা। মধু সংগ্রহের ফলে দেশে মধুর চাহিদার জোগান দিয়ে মৌচাষিরা যেমন লাভবান হন, তেমনি সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ অফিসের হিসাব মতে, এ বছর মানিকগঞ্জে সরিষা ফুল থেকে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ হবে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। মৌচাষিরা খুচরা পর্যায়ে আড়াই থেকে তিনশত টাকা কেজি দরে এ মধু বিক্রি করেন। মধু সংগ্রহের ফলে সরিষাফুলে পরাগায়ন বেশি হওয়ায় সরিষার ফলন ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এতে কৃষকরা প্রায় পাঁচ কোটি টাকার অতিরিক্ত সরিষা পাবেন।

মৌচাষি ফয়সাল হোসেন জানান, সরিষার মধুর উৎপাদন বেশি। সেইজন্য দাম কম। তিনি বছরে প্রায় দুই মেট্রিক টন সরিষার মধু সংগ্রহ করতে পারেন। আর কালোজিরার মধু পান মাত্র ৩০ কেজির মতো। লিচুর মধু পাওয়া যায় এক টনের বেশি।

তারমতে, যেহেতু সরিষার মধুর উৎপাদন বেশি, তাই দাম কম। খুচরা পর্যায়ে মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। সেখানে কালোজিরার মধুর কেজি ৬০০-৭০০ টাকা। আর লিচুর মধু ৪০০-৫০০ টাকা। স্বাদে এবং ঘ্রাণে লিচুর মধু উৎকৃষ্ট।

তিনি জানান, সরিষা ফুলের মধুতে সরিষার ঘ্রাণ থাকে। কিন্তু এ মধুর সমস্যা এর সংরক্ষণ। কালোজিরা বা লিচুর মধু যে কোনো পাত্রে রাখা যায়। সেটি জমে না বা গুণাগুণ দীর্ঘ সময় অক্ষুণ্ন থাকে। কিন্তু সরিয়ার মধু সংগ্রহের মাস খানেকের মধ্যে জমে যায়। তবে কাঁচের পাত্রে রাখলে এ মুধ এক বছর সংরক্ষণ করা যায়। এমনভাবে রাখতে হবে যেন পাত্রের ভেতর আদ্রতা না থাকে। দু-এক মাস পরপর ওই পাত্রের মুখ খুলে রোদে রাখতে হবে। শুকনো চামচ দিয়ে পাত্র থেকে মধু বের করতে হবে। প্লাস্টিকের পাত্রে রাখলে মধু গন্ধ হয়ে যায়।



বাংলাদেশ মৌ চাষি কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. এবাদুল্লাহ আফজাল রাইজিংবিডিকে বলেন, দেশের ১৩০০ মৌচাষি তাদের সংগঠনের সদস্য। তাদের সংগঠনের সদস্যদের বাইরেও মৌচাষি আছেন। বছরে দেশে প্রায় ছয় হাজার মেট্রিক টন মধু সংগৃহীত হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বছরে প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন মধু রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারতে রপ্তানি হয় ৫০০ মেট্রিক টন এবং জাপানে ৫০০ মেট্রিক টন।

তিনি বলেন, দেশে মধু উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। মৌচাষিদের একটি বক্স কিনতে খরচ হয় ৫০০০-৭০০০ টাকা। যদি সরকার উন্নতমানের প্রশিক্ষণ এবং মৌচাষিদের স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাসিক রেশনের মধ্যে মধু তালিকাভুক্ত করারও দাবি জানান।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জানুয়ারি ২০১৭/বকুল/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়