ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সম্ভাবনাময় উপকূল

পলিমাটিতে কৃষি আবাদের বিপুল সম্ভাবনা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০১, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পলিমাটিতে কৃষি আবাদের বিপুল সম্ভাবনা



পলিমাটির উর্বর ক্ষেতজুড়ে শুধু ক্যাপসিকাম (মিষ্টি মরিচ)। হয়েছে বাম্পার ফলন। ভালো ফলনে মিলছে ভালো দাম। বিনিয়োগের তুলনায় লাভের পরিমাণও সন্তোষজনক। আর তাই অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি ক্যাপসিকাম চাষেও আগ্রহী হয়ে উঠছেন চাষিরা। তাদের দাবি, বীজের দাম কমিয়ে আনা আর দেশের বাইরে থেকে ক্যাপসিকাম আসা বন্ধ হলে দেশেই এই ফসল চাষে বিপ্লব ঘটতে পারে। এটা দ্বীপ জেলা ভোলার একটি গল্পমাত্র। কৃষিতে এমন সাফল্যের হাজারো গল্প রয়েছে উপকূলজুড়ে। 

যে ফসল শহরে দেখা যেত, গ্রামের চাষিরা এর নামও জানতেন না। সেই ফসল এখন উপকূলের দ্বীপের চাষিরাই ফলাচ্ছেন। ক্যাপসিকামের মতো অনেক ফসল ফলছে উপকূলের উর্বর মাটিতে। ধান, মরিচ, সয়াবিন, তরমুজ, গম, ভুট্টা, বাদাম, সরিষা, তিল, ঢেড়স, বিভিন্ন ধরনের ডাল, সবজিসহ বহুমূখী কৃষি আবাদে উপকূল অঞ্চল বিপুল সম্ভাবনার প্রমাণ দেখিয়েছে। দ্বীপ জেলা ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনার বিভিন্ন চরে চাষীরা নতুন নতুন ফসল আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন।

উপকূলে কৃষি আবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব ধরনের কৃষির জন্য উপকূলের জমি উপযোগী। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ঝুঁকি নিয়ে চাষিরা আবাদ করলেও অধিকাংশ সময় ফসল ঘরে তুলতে পারে না। অসময়ে জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়া, পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, নদী ভাঙন, ঘুর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগে বছরের পর বছর ফসল মার খায়। এজন্য সরকারি পর্যায় থেকে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন বলে দাবি চাষিদের।

সূত্র বলছে, অর্থকরী ফসল সয়াবিন চাষে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর এগিয়ে রয়েছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের প্রায় ৭৫ শতাংশ উৎপাদিত হচ্ছে এই জেলায়। এই সাফল্যে লক্ষ্মীপুর পরিচিতি পেয়েছে ‘সয়াল্যান্ড’ হিসাবে। লক্ষ্মীপুর ছাড়াও উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে সয়াবিন উৎপাদিত হচ্ছে।

 



কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)’ র সূত্র মতে, লক্ষ্মীপুর জেলার সবচেয়ে বড় সয়াবিন চাষি কমলনগর উপজেলার দক্ষিণ চর মার্টিন গ্রামের পল্লী চিকিৎসক মো. আলী হোসেন (৫০)। যিনি দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সয়াবিন বীজ উৎপাদনকারী চাষী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আলী হোসেন জানান, গত বছর তিনি ৪০ একর জমিতে সয়াবিন চাষ করেছিলেন। এ বছর করেছেন প্রায় ৫০ একর জমিতে। তার উৎপাদিত সব সয়াবিনই বিএডিসির বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

জানা গেছে, ‘ক্যাশ ক্রপস’ খ্যাত সয়াবিন ঘিরে এ অঞ্চলে বিশেষ করে রামগতি ও কমলনগরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দাদন ব্যবসা। বেশির ভাগ চাষী প্রান্তিক ও বর্গাচাষী হওয়া সয়াবিন বোনার মৌসুমে তাদের হাতে নগদ টাকা থাকে না। টাকার অভাবে তারা দ্বারস্থ হন মহাজনের কাছে। চাষীদের দারিদ্র্যের সুযোগে মহাজনরা নামমাত্র মূল্যে আগাম কিনে নেন ক্ষেতের সয়াবিন। ফলে ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না কৃষক।

উপকূলীয় অঞ্চলে ধান উৎপাদনের খ্যাতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি নোয়াখালীর সুবর্ণচর। ধান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবে এই এলাকাটিকে অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ এলাকায় বিভিন্ন জাতের ধান আবাদ হয়। ধানকাটা মৌসুমে বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষ সুবর্ণচরে ধানকাটায় মজুর দিতে আসেন। তবে এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ধানের এলাকা হিসেবে পরিচিত সুবর্ণচরের চাষীরা লোকসান গুনছেন। ধান আবাদ করে কোনমতে বছরটা পার করা তাদের পক্ষে এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বাম্পার ফলন হলে ধান-চালের বাজার কমে যায়। আবার দাম কিছুটা ভালো পাওয়া গেলে দেখা যায় ফলন ভালো হয় না। বৈরি প্রকৃতির সঙ্গে যোগ হয়েছে সার-বীজের অপ্রতূলতা, সেচ সংকট, যথাযথ পরামর্শের অভাব।

চাষীরা জানালেন, ধান উৎপাদনে সুবর্ণচরের মাটি অত্যন্ত উর্বর হলেও চাষীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজর নেই। গোটা উপজেলার চাষীদের মধ্যে অধিকাংশই বর্গাচাষী। নিজের জমি চাষাবাদকারী চাষীর সংখ্যা খুব কম। বর্গাচাষীরা মালিকদের কাছ থেকে জমি নিয়ে চাষ করে। আবাদকালীন সব খরচ বর্গাচাষী নিজেই বহন করেন। কিন্তু উৎপাদনের অর্ধেক জমির মালিককেই দিতে হয়। এরফলে বর্গাচাষীরা কখনোই লাভবান হতে পারেন না।

তবে সুবর্ণচর কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা বলেছেন, সার-কীটনাশক না পাওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। কৃষি এলাকা হিসেবে এখানকার চাষীদের প্রতি কৃষি বিভাগের বিশেষ নজর রয়েছে। ব্লক পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত চাষীদের সাথে যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছেন।

 



উপকূলের দ্বীপ-চর এলাকায় তরমুজ ও বাদাম আবাদের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এই সম্ভাবনা আরও অনেকখানি বিকশিত হয়েছে। দ্বীপের নতুন উর্বর জমিতে এসব লাভজনক ফসল আবাদ করে চাষীরা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু লাভজনক এই আবাদ নানামূখী ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। একদিকে প্রাকৃতিক বৈরিতা, অন্যদিকে রয়েছে বাজার না পাওয়ার ঝুঁকি। এর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, চাঁদাবাদদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। কিন্তু উপকূলের তরমুজ ও বাদাম চাষে সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারলে চাষীরা আরও বেশি লাভবান হতে পারে। ন্যায্য দাম পেয়ে তারা ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে।   

দ্বীপ জেলা ভোলার চর কাচিয়ায় দেখা মেলে ক্যাপসিকাম চাষী আবুল কাসেম পাঠানের সাথে। তিনি জানালেন, প্রথম বছর সামান্য পরিমাণ জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করলেও পরের বছর চাষের পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে। লাভজনক হওয়ায় এবার তিনি ক্যাপসিকাম আবাদ করেছেন সোয়া ৪ একর জমিতে। এতে তার খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। এরই মধ্যে তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করেছেন। আরও অন্তত ১০ লাখ টাকার ফসল রয়েছে ক্ষেতে।

চাষিদের কাছ থেকে পাওয়া হিসাবে জানা গেছে, প্রতি একরে ক্যাপসিকাম চাষে খরচ হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। তবে ফলন ভালো হলে এবং কোন ধরনের দুর্যোগ না হলে বিনিয়োগের দ্বিগুণ মূল্য উঠে আসে। সমুদ্র-নদীর অববাহিকায় যুগে যুগে পলি জমে জেগে ওঠা চরের মাটি বেশ উপযোগী ক্যাপসিকাম চাষের জন্য। প্রথম বছরেই সাফল্য পেয়েছেন চাষীরা। সেই সাফল্যের ধারায় তিন বছর ধরে এই চাষ অব্যাহত রয়েছে। এক জনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসছেন অন্যরা। এভাবে চাষের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এখনও কৃষি দপ্তরের তালিকায় এই ফসলের নাম ওঠেনি।

চাষীরা জানান, এটি সম্ভাবনাময় একটি ফসল। তবে এর সামনেও রয়েছে অনেক বাধা। দেশের ক্যাপসিকামের বাজার এখনও বিদেশি ক্যাপসিকামের দখলে। এদেশে এখনও বীজ উৎপাদিত হচ্ছে না। অধিক কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। এর ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয় তো রয়েই গেছে। এসব কারণে চাষীদের ঝুঁকি থেকেই যায়। ধারকর্জ করে ক্যাপসিকাম আবাদের পর কোনো বছর দুর্যোগ হানা দিলে, কিংবা দাম না পেলে বিপদ।

চাষীরা জানান, ক্যাপসিকাম চাষে সবচেয়ে খরচ বেশি বীজে। ভারত থেকে আসা বীজ কিনতে হয় প্রতি কেজি ১ লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকা দরে। অনেক সময় ভালো বীজ পাওয়া যায় না। এর ওপরে রয়েছে কীটনাশক প্রয়োগ। অতিরিক্ত দামে কীটনাশক কেনা হলেও অনেক সময় কীটনাশকে পোকা দমন হয় না। ক্যাপসিকাম চাষ শুরু হয় বাংলা সনের পহেলা কার্তিক থেকে। বীজ তৈরি করতে প্রায় একমাস লেগে যায়। সাধারণ মরিচ চাষের মতই বীজতলা থেকে চারা তুলে সারিবদ্ধভাবে লাগাতে হয়। চারা রোপণের পর থেকে একমাসের ব্যবধানে ফুল ও ফল আসতে শুরু করে। প্রতিটি গাছে ১০-১২টি ক্যাপসিকাম ধরে। এর ওজন দাঁড়ায় দেড় কেজির মত। ফলন তোলা থেকে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই ক্যাপসিকাম বাজারজাত শেষ হয়ে যায়। এক থেকে দেড় সপ্তাহ পর্যন্ত এগুলো হিমাগারে রাখা যায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা মূল্য বঞ্চিত হয়।

 



চাষীরা দাবি জানিয়েছেন, দেশে সম্ভাবনাময় ক্যাপসিকাম চাষের বিকাশ ঘটাতে হলে ক্যাপসিকামের বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। বাইরে থেকে ক্যাপসিকাম আসা বন্ধ করতে হবে। বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বীজের দাম কমাতে হবে। সার ওষুধের গুণগত মান বাড়িয়ে মূল্য কমাতে হবে। সরকারিভাবে চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ক্যাপসিকাম ক্রয়ের ব্যবস্থা থাকলে চাষীরা লাভবান হতে পারে।

এ ব্যাপারে ভোলা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, মেঘনা বিধৌত মাঝের চরের মাটি অত্যন্ত উর্বর, তাই দুই-তিন বছর ধরে কৃষকরা ক্যাপসিকাম চাষ করে ভালো ফল পাচ্ছেন। কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এতে দিন দিন আবাদ বাড়ছে। গত বছর জেলায় দুই হেক্টর জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ হয়। এবার তা বেড়ে পাঁচ হেক্টর হয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়