ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মোটর মেকানিক মিজানের চমকপ্রদ ৮ আবিষ্কার

বিএম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মোটর মেকানিক মিজানের চমকপ্রদ ৮ আবিষ্কার

বি এম ফারুক , যশোর : একের পর এক উদ্ভাবনে চমকে দিয়েছেন  যশোরের মোটরসাইকেল মেকানিক মিজানুর রহমান।

যশোরের শার্শা উপজেলার এই মোটরসাইকেল মেকানিকের অ্যাকাডেমিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও আজ সে নিজের আলোয় আলোকিত। নতুন চিন্তা আর চেষ্টায় এখন পর্যন্ত তার আবিষ্কারের সংখ্যা ৮।

শার্শার নিজামপুর ইউনিয়নের আমতলা গাতিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে ১৯৭১ সালের ৫ মে মিজানুর রহমানের জন্ম । বাবা আক্কাস আলী ও মা খোদেজা খাতুন। বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। বাবা-মার ৬ সন্তানের মধ্যে মিজান পঞ্চম। বর্তমানে শার্শার শ্যামলাগাছিতে মিজানুর বাস করেন।

দারিদ্র্যতার কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি মিজান। ৮-৯ বছর বয়সেই বেঁচে থাকার তাগিদে নেমে পড়েন মজুরের কাজে। মাঠে শ্যালো মেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করেন। পরে নাভারণ বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজে কাজ পান তিনি। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু । বর্তমানে শার্শা বাজারে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ নামে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ রয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই তার শখ ছিল নতুন কিছু করা, নতুন কিছু জানা। সেই আগ্রহের কারণেই তিনি একে একে উদ্ভাবন করে চলেছেন ।

মিজান প্রথমে উদ্ভাবন করেন হাফ ক্রেনসেপ্ট দিয়ে একটি আলগা ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনের সব যন্ত্রপাতি বিদেশি। এ ইঞ্জিনটি একবার জ্বালানি তেল দিয়ে চালু করলে পরে আর তেল লাগে না। ইঞ্জিনের সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে জ্বালানি তৈরি করে নিজে নিজেই ইঞ্জিনটি চলতে সক্ষম।

ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির পর মিজান দ্বিতীয় উদ্ভাবন করেন স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। যা বাসা-বাড়ি, কলকারখানা, অফিস-আদালতে আগুন লাগলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রক্ষার্থে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। এটি বিদ্যুৎ না থাকলেও চলবে। এই যন্ত্রটি অল্প জায়গায় রাখা যায়। কোনো জায়গায় আগুন লাগলে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম ও লাইট অন করে দেয়। তারপর একইসঙ্গে সংযুক্ত মোবাইল থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে ফোন করে দেয়। পাশাপাশি যন্ত্রটি পানির পাম্পকে সুইচ অন করে দেয়। যা আগুনের অবস্থান নিশ্চিতের ৫-৭ সেকেন্ডের মধ্যেই সম্ভব হয়। অতঃপর পানির পাম্পের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপের মাধ্যমে আগুনের অবস্থানে পৌঁছে দেয়। ফলে আগুন নিভে যায়। এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৫ সালে যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রদর্শন করে মিজান প্রথমস্থান অধিকার করেন। পরবর্তী সময়ে এটি বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম ও দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে।

দেশে পেট্রলবোমায় যখন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল ঠিক সে সময়ে মিজান উদ্ভাবন করেন তার তৃতীয় উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধ জ্যাকেট। এ জ্যাকেট পরে ড্রাইভার বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। এতে করে আগুনের মাঝে গিয়ে জানমাল রক্ষা করার সময় তার শরীরে আগুন স্পর্শ করবে না।

তার চতুর্থ উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধক হেলমেট। এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনার আগুনে গলার শ্বাসনালী পুড়বে না। তার পঞ্চম উদ্ভাবন  প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে মোটরকার। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রলচালিত।

কৃষকদের জন্য স্বয়ংক্রিয় সেচ যন্ত্র তার ষষ্ঠ উদ্ভাবন। কৃষকরা দূর-দূরান্তের মাঠে জমিতে পানি দিতে আর খেতে যেতে হবে না। বাড়ি বসেই সেচযন্ত্রটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। তাছাড়া এ যন্ত্রটি জমিতে পানির প্রয়োজন হলে নিজে নিজেই চালু হয় এবং পানির প্রয়োজন না থাকলে এটি একা একাই বন্ধ হয়ে যায়।

দেশীয় প্রযুক্তিতে মিজান তার সপ্তম উদ্ভাবন করেছেন ফ্যামিলি মোটরযান। ব্যবহারযোগ্য এ কার এলাকার মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

মিজানের অষ্টম উদ্ভাবন পরিবেশ সেফটি যন্ত্র। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখী কাজ করে থাকে। যন্ত্রটি বাড়ি, অফিস বা কলকারখানায় ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়। এ যন্ত্রটি উদ্ভাবনের পর ২০১৬ সালের ৫ জুন জাতীয় পর্যায়ে মিজান পরিবেশ পদক লাভ করেন।

জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মিজান এ পর্যন্ত মোট ১৭টি সাফল্য সনদ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য ক্রেস্ট ও সাফল্য পুরস্কার।

এরইমধ্যে মিজানের আবিষ্কৃত দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টু আই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে ছোট ছোট অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

খুলনা বিভাগীয় সাবেক কমিশনার আব্দুস সামাদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও সে বেশ কিছু নতুন জিনিস উদ্ভাবন করে রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। আমরা তাকে উৎসাহিত করেছি। সে ডিজিটাল মেলাসহ জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছে।’

২০১৭ সালে পরিবেশবান্ধব যন্ত্র উদ্ভাবনে বিশ্ব পরিবেশ পদক নির্ধারিত হওয়ায় ৫ জুন মিজানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

মিজান জানান, তার স্বপ্ন দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা। তার বর্তমান উদ্ভাবন গবষেণা চলছে দূষিত বায়ু শোধন যন্ত্র উদ্ভাবনের।



রাইজিংবিডি/যশোর/৩ ডিসেম্বর ২০১৭/বি এম ফারুক/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়