ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

‘মনস্বিতা’ গ্রামীণ নারীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘মনস্বিতা’ গ্রামীণ নারীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া ঘুরে : ‘মনস্বিতা’য় নারীর প্রাজ্ঞতা। যে গ্রামের নারীরা শিক্ষায় পিছিয়ে ছিলেন, যেখানে মেয়েদের শিক্ষা মাধ্যমিকে পৌঁছাতেই কাঠখড় পোড়াতে হতো, সেখানে এখন উচ্চশিক্ষার অবারিত স্বপ্ন। এখন এই গ্রামে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বুনন শুরু হয় মাধ্যমিকেই। কারণ গ্রামেই রয়েছে ডিগ্রী কলেজ। এসএসসি’র চৌকাঠ পেরোতে পারলে তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। জীবন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে সকল বাধা পেরিয়ে তারা দলে দলে ছুটছে মনস্বিতা’য়।

ঝালকাঠির উপকূলবর্তী উপজেলা কাঁঠালিয়ার শৌলজালিয়া গ্রামের পিচঢালা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ‘মনস্বিতা’। যে কেউ এই রাস্তা ধরে গেলে নামটি দেখেই থমকে দাঁড়াবেন। এটি একটি কলেজের নাম। মনস্বিতা মহিলা ডিগ্রী কলেজ। ব্যতিক্রমী এই নামের কারণে সরকার থেকে কলেজের অনুমোদন পেতেও কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। কিন্তু উদ্যোক্তা এর নাম বদল করেননি। অবশেষে বহু চেষ্টায় মিলেছে অনুমোদন। ‘মনস্বিতা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘প্রাজ্ঞতা’ বা ‘ধী শক্তির অধিকারী’। গ্রামীণ নারীদের প্রাজ্ঞতায় সচেষ্ট থেকে নারীদের এগিয়ে নেয়াই এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।

 



কাঁঠালিয়ার আওরাবুনিয়ার আবদুল বারেক হাওলাদারের মেয়ে রুমা আক্তার কখনো ভাবতেই পারেনি এসএসসি’র পরে তার লেখাপড়া হবে। সে এবার মনস্বিতা মহিলা ডিগ্রী কলেজ থেকে এইসএসসি পরিক্ষা দিচ্ছে। বাড়ি থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরের কলেজেই তার পড়ার সুযোগ হয়েছে। এই কলেজটি না হলে তাকে অন্তত ১৫ কিলোমিটার দূরের কলেজে গিয়ে পড়তে হতো। ফলে তার স্বপ্ন থাকলেও তার পড়ালেখা মাধ্যমিকেই বন্ধ হয়ে যেতো। আরেকজন উত্তর তালগাছিয়া গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাক হাওলাদারের মেয়ে হাবিবা আকতার। মনস্বিতায় স্নাতক পড়ছে। এই কলেজটি না হলে তার পড়ালেখা মাধ্যমিকেই ইতি টানতে হতো। কাঁঠালিয়া উপজেলা সদর কিংবা নদী পেরিয়ে বেতাগী উপজেলা সদরে গিয়ে পড়তে হতো। একইভাবে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ভঙ্গ হতো উত্তর কচুয়া গ্রামের মর্জিনা আক্তার, উত্তর তালগাছিয়া গ্রামের শারমিন খান, মুক্তা আক্তারের।

শিক্ষার্থীদের কেউ ডাক্তার, কেউ পুলিশ অফিসার, কেউ আইনজীবী, কেউ সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারও বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব ছিল ৭ কিলোমিটার, ১০ কিলোমিটার আবার ১২ কিলোমিটার। এতটা পথ পেরিয়ে তাদের পক্ষে কলেজে যাওয়া হতো না। শৌলজালিয়া গ্রামের এই মহিলা কলেজটি হওয়ায় তারা স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বললো, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় তাদের পক্ষে দূরের কলেজে গিয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব হতো না। এখন সুযোগ হয়েছে স্বপ্ন দেখার।

 



সূত্র বলেছে, গ্রামে একটি একটি ছোট্ট টিনশেড ভবনে কলেজটির যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে। কাঁঠালিয়া-রাজাপুর সংযোগ সড়কের পাশে শৌলজালিয়া ইউনিয়নের শৌলজালিয়া গ্রামে কলেজটির অবস্থান। এরইমধ্যে বহু শিক্ষার্থী এ কলেজের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার পথে পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছে। কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০০। বর্তমানে এখানে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিভাগ এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে বিএম শাখা পরিচালিত হচ্ছে। স্নাতক পর্যায়ে বিএ, বিএসসি এবং বিবিএ (পাস) অধ্যায়নের সুযোগ রয়েছে এখানে। এরই মধ্যে কলেজটি ভালো ফল করে সুনাম কুড়িয়েছে। এ কলেজটি নারী শিক্ষা প্রসারে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে। কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম কামরুজ্জামান বলেন, এই কলেজটি না হলে এই এলাকার অনেক মেয়েদের লেখাপড়া হতো না। এখানে আমরা মেয়েদের লেখাপড়ার পরিবেশ নিশ্চিত করেছি। মেয়েরা নির্বিঘ্নে কলেজে আসতে পারে। সম্প্রতি সরকার থেকে একটি ভবন বরাদ্দ পাওয়া গেলেও কলেজে স্থান সংকট রয়েছে। ফলে ক্লাস পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়। অধ্যক্ষ, প্রভাষক ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীসহ প্রায় ২৫ জনের জনবল নিয়ে কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে।

‘নারী শুধু শিক্ষিত নয়, তারা হবে সংসার, সমাজ ও দেশ গঠণের দক্ষ কারিগর’ এই স্লোগান ধারণ করে ব্যতিক্রমী পাঠদান প্রক্রিয়ায় কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানালেন, কলেজে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন শিখন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পাঠদান প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের আলোচনায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কলেজে উপস্থিতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। শিক্ষার্থীদের টিউটোরিয়াল পরিক্ষার ফল নিয়ে বছরে দু’বার অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় করা হয়। কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে গ্রন্থাগার ও তথ্যপ্রযুক্তি চর্চা কেন্দ্র। গ্রামে মহিলা ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ প্রসঙ্গে কাঁঠালিয়ার দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি ফারুক হোসেন খান বলেন, এটা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। এই অঞ্চলে নারী শিক্ষা প্রসারে এর আগে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ কলেজটি না হলে অনেক মেয়েদের লেখাপড়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেতো। এই কলেজের কল্যাণে আগামীতে গ্রামের অনেক মেয়েদেরকে হয়তো উচ্চ পদে চাকরি করতে দেখবো।

 



শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গ্রামীণ পরিবেশে কেন এমন একটি মহিলা ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠার এ উদ্যোগ- এমন প্রশ্নই করেছিলাম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ফাতিমা খানমের কাছে। জবাবে বললেন, ‘গ্রামের নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ইচ্ছা থাকা সত্বেও কলেজ দূরে হওয়ার কারণে অনেক মেয়ের লেখাপড়া মাধ্যমিকেই শেষ হয়ে যায়। ফলে তারা ভালো কোন পদে চাকরি পায় না। গ্রামের নারীদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করতেই এই উদ্যোগ। তাছাড়া আমরা তো মরেই যাবো। এমন কিছু করে যাওয়া উচিত, যা আমাদেরকে মনে রাখে।’

কলেজ প্রতিষ্ঠার পর নারী শিক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে শুধু যে মেয়েরা পড়ছে তা নয়, অনেকের চাকরি হয়েছে। বিধাব নারী ফৌজিয়া বেগম ২ মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিনা যাপন করছিলেন। তাকে কলেজে চাকরি দেয়া হয়েছে। তার দুই মেয়ে এখন এখানে পড়ছে। ৩ মেয়ের বাবা রুস্তুম আলীর ৩ মেয়ে। কোন কাজ করতেন না। মেয়েদের পড়ানোর শর্তে তাকে চাকরি দেয়া হয়েছে। নিজ গ্রামে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনের কথা বলতে গিয়ে ফাতিমা খানম বলেন, ১৯৮৬ সালের দিকে নোয়াখালী অঞ্চলে ডানিডায় চাকরিরত অবস্থায় তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে ‘মানুষ তো মরেই যাবে- কী রেখে যাবে?’ প্রথমে সে বছরের শুরুর দিকে একটি স্কুল শুরু করেছিলেন। নজরদারির অভাবে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্কুলের চিন্তা বাদ দিয়ে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার চিন্তা আসে। ১৯৯১ সালের দিকে বরিশালে মেয়েদের পরিচালিত একটি দোকান করেন। সেখান থেকেই মেয়েদের কলেজ প্রতিষ্ঠার চিন্তা আরও জোরদার হয়। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এ বিষয়ে আলাপ করেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া এবং নিজের সকল সঞ্চয় মিলিয়ে প্রথমে ১৪ কাঠা জমি কলেজের নামে দেন তিনি। পরে এর সঙ্গে আরও জমি যোগ হয়ে এখন কলেজের জমির পরিমাণ এক একর ২৬ শতাংশ।

 



প্রতিষ্ঠাতা জানালেন, ১৯৯৯ সালের দিকে একটি টিনশেড ঘর তুলে কলেজের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। টিনের চালা আর বাঁশের খুঁটি দিয়ে ৪০ হাত লম্বা ও ২০ হাত চওড়া ঘরে কলেজের যাত্রা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে কলেজে ভর্তি শুরু হয়। প্রথমে ৩৯টি ছাত্রী ভর্তি হলেও নিয়মিত ক্লাসে আসতো মাত্র ৯জন। অনেকেই ভর্তি হলেও লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। ২০০৩ সালে কলেজ থেকে প্রথম পরিক্ষায় অংশ নেয়। প্রথমবার এইসএসসিতে ৯জন পরিক্ষা দেয়। শিক্ষক না থাকায় প্রথমবার ফল ভালো হয়নি। পরের বছর ৫৭জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০জনের বেশি উত্তীর্ণ হয়। এরপর কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০০০ সালে সরকার অনুমোদিত এ কলেজটি ২০১০ সালে এসে এমপিওভূক্তি হয়। আর একাডেমিক স্বীকৃতি পায় ২০০৪ সালে। 

নিজের গ্রামে নারী শিক্ষার পতাকাবাহী ফাতিমা খানম বলেন, অনেক কষ্টে কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও পরিচালনায় অনেক সমস্যা হয়েছে। এখনও অনেক বাঁধার মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রথম দিকে এ এলাকায় কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। যাদের সামর্থ্য ছিল, কেবল তারাই কলেজে যেতো। এলাকার সব পরিবারের মেয়েদের কলেজে আনতে অনেক সমস্যা হয়েছে। প্রথম দিকে কো-এডুকেশন করার বিষয়েও প্রবল চাপ ছিল এলাকা থেকে। কিন্তু গোটা কাঁঠালিয়া উপজেলায় মহিলা কলেজ না থাকায় এটিকে মহিলা কলেজ হিসাবে রাখার বিষয়ে আমরা সচেষ্ট ছিলাম। ফাতিমা খানম জীবনের সব সঞ্চয়, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া অনুদান, পুরস্কারের অর্থকড়ি, সবই কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করেছেন। তিনি বরিশাল বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন ২০১৫ সালে। এর আগে ইনোভেটিভ কাজের স্বীকৃতি হিসাবে অশোকা ফেলোশীপ পান। বর্তমানে তিনি কাঁঠালিয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়