ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

৮ অভ্যাসে স্মৃতিশক্তি লোপ

ইয়ামিন আরচুভ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৮ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৮ অভ্যাসে স্মৃতিশক্তি লোপ

প্রতীকী ছবি

ইয়ামিন (আরচুভ) : ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি এবং বোধশক্তি লোপ পাওয়া জাতীয় রোগকে মেডিকেলের পরিভাষায় ‘ডিমেনশিয়া’ বলা হয়। এটি জন্মগত রোগ নয়।  বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, কিছু সাবধানতা এবং সচেতনতা এই সমস্যাগুলো এড়ানোর জন্যে যথেষ্ঠ। চলুন জেনে নেই, ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে।

অস্বাস্থ্যকর খাবার: সাধারণত আমরা জানি, হৃদপিণ্ডের সুস্থতা এবং দেহের ওজন ঠিক রাখার জন্য পরিমিতহারে পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাদ্যগুলোকেই আমরা বেশি অগ্রাহ্য করি। যুক্তরাষ্ট্রের আলঝেইমার ড্রাগ ডিসকভারি ফাউন্ডেশন এবং এডিডিএফ এর কগনিটিভ ভাইটালিটি প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাওয়ার্ড ফিলিট বলেন, ‌‌পরিমিত ফ্যাট, প্রোটিন, মিনারেল এবং ভিটামিন মস্তিষ্কের স্বাভাবিক সক্ষমতার জন্য অপরিহার্য।

গবেষণায় আরো প্রমাণিত হয়েছে, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে স্মৃতিহানি এবং বোধশক্তি লোপ পাওয়ার আশঙ্কা বেশি। ফল, শাকসবজি, বাদাম এবং শস্যই মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।  লাল মাংস অর্থাৎ গরু, ভেড়া বা ছাগলের মাংসের পরিবর্তে বেছে নিতে পারেন মুরগি অথবা মাছ।

দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা:  উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস, আলঝেইমারের মতো অন্যতম বড় দুইটি ঝুঁকি ডিমেনশিয়া রোগের আশঙ্কার বড় কারণ হতে পারে।   ডায়াবেটিসের মাত্রা ৭৩ শতাংশ হলেই ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, এমনকি যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের চেয়ে ডায়াবেটিস রোগীদের ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া (মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের অভাবে স্মৃতিশক্তি লোপ)  হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। হাওয়ার্ড ফিলিট বলেন, মধ্যবয়স্ক উচ্চ রক্তচাপ হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে আলঝেইমার এবং ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া উভয় ঝুঁকি থাকে। মেডিটেশন, ডায়েট, ব্যায়াম করলে উভয় রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যহারে কমে। এসব দুরারোগ্য ব্যাধি এড়াতে চাইলে নিয়মিত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মনিকাতে অবস্থিত সেইন্ট জন হেলথ সেন্টারের নিউরোলজিস্ট ক্লিফোর্ড সেগিল বলেন, যারা ডাক্তারদের কাছ থেকে নিয়মিত পরামর্শ নেন তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, এমনকি ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগও ডাক্তারদের পরামর্শে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

নেশা জাতীয় পানীয়: মদের সাময়িক সুখ দেহের দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ বাড়িয়ে দেয়। নেশা জাতীয় পানীয়ের আধিক্যে উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং লিভারের রোগসহ স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

ড. সেগিল বলেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মস্তিষ্কের নিউরো সংযোগগুলোর বিক্ষিপ্ততা এবং ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার ফলে বার্ধক্যের আগেই স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। একাধিক গবেষণায়, মদ্যপানের সঙ্গে মানুষের বোধশক্তি লোপ পাওয়ার সুসম্পর্ক পাওয়া গেছে।

এছাড়াও এক টানা কয়েক বছর মদ পানের ফলে নানা কারণে স্মৃতিশক্তি লোপ পায় যা সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা তৈরি করতে পারে, এই ধরনের রোগকে মেডিকেলের ভাষায় ওয়েনিক-কোরসকোফ সিন্ড্রোম বলে।

গবেষকদের পরামর্শ মতে রেড ওয়াইন মস্তিষ্কের জন্যে ফলপ্রসু, রেড ওয়াইনের ফ্লাভোনয়েড উপাদান বয়স্কদের স্মৃতিশক্তি অক্ষুন্ন রাখতে সাহায্য করে।

ধূমপান: ড. ফিলিট বলেন, সিগারেট এবং সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে বিষাক্ত উপাদানসহ  ৪৭০০ ধরনের  রাসায়নিক পদার্থ  থাকে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধূমপায়ীদের সব ধরনের ডিমেনশিয়ার (স্মৃতিশক্তি ও সব ধরনের স্নায়ুবিক বোধশক্তি লোপ)  ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে শতকরা ৭৯ শতাংশ ধূমপায়ীদের অকালে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্তের আশঙ্কা অনেক বেশি।

তবে আশার আলো এই যে,  ধূমপায়ীদের তুলনায় সাবেক ধূমপায়ীদের ডিমেনশিয়ার  ঝুঁকি  অনেক কম। তাই যত শিগগির সম্ভব ধূমপান ত্যাগ করাই ভালো।

অলস জীবন: যুক্তরাষ্ট্রে পরিশ্রমহীনতা এবং ব্যায়ামের অভাবে বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা ভুরি ভুরি, প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমেরিকানরা শারীরিকভাবে পরিশ্রমবিমুখ।

ড. ফিলিট বলেন, নির্ভুল এবং তথ্যবহুল গবেষণায় দেখা যায়, ব্যায়াম মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। নিয়মিত এবং যথাযথ ব্যায়াম বার্ধক্যজনিত রোগসহ দেহের নানা ধরনের রোগ এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিও কমায়।

ব্যায়ামের ফলে হৃদপিণ্ড এবং মাংসপেশীতে অক্সিজেনের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় আপনার মস্তিষ্কের সক্ষমতা বাড়তে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্করা যেন প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি  অথবা ৭৫ মিনিট ভারী ব্যায়াম করে, যা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে প্রায় ৫ বার কাজ করার সমতুল্য।

উদ্যমহীনতা: দেহের মতো মনের যত্ন নেয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ। শুয়ে বসে অলস সময় কাটিয়ে মস্তিষ্ক কর্মহীন রাখা মানে প্রতিনিয়ত ডিমেনশিয়া রোগকে স্বাগত জানানো। মেডিকেল অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অপারেশন্স ফর দ্য আলঝেইমার্স অ্যাসোসিয়েশন এর সিনিয়র ব্যবস্থাপক হিথার সিন্ডার বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে যে, মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখলেই নিউরো সংযোগসহ এর সব ধরনের সক্ষমতা বাড়ে।

সিন্ডারের পরামর্শ অনুযায়ী উপকৃত হতে চাইলে, জিগসা অথবা ক্রসওয়ার্ড পাজেল মেলানোর চেষ্টা করুন, দাবা এবং ব্রিজসহ বুদ্ধিবৃত্তিক খেলায় অংশগ্রহণ করুন। অনলাইনে অথবা এলাকার প্রতিষ্ঠানে কোনো কোর্স করুন।

একাকীত্ব: গত বছর ‌ব্রিগহাম অ্যান্ড উইমেনস হাসপাতালের একদল গবেষক গবেষণায় দেখিয়েছেন, একাকীত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং বেটা-আমিলয়েড (বার্ধক্যজনিত রোগের জন্য দায়ী এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড) এর মধ্যে সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে।

ড. ফিলিট বলেন, এই গবেষণার সঙ্গে আগের গবেষণার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, সামাজিক মানুষদের চেয়ে সমাজ বিচ্ছিন্নদের আলঝেইমার হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। এমনকি আপনি যদি অন্তর্মুখীও (অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ে কম আগ্রহ যাদের) হন এবং একাকী সময় উপভোগ করেন, তবুও বইয়ের ক্লাবে যোগদান, গবাদি পশুর খামারের স্বেচ্ছাসেবক অথবা খেলার মাঠে যাওয়াসহ সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ বাড়ান ।

নিদ্রাহীনতা: ড. ফিলিট বলেন, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া আলঝেইমারের ঝুঁকি বাড়ায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণার ফলে বিশেষজ্ঞদের এই ধারণা জন্মেছে যে, শতকরা ১৫ ভাগ আলঝেইমার রোগের সঙ্গে অনিদ্রার যোগসূত্র আছে।

আলঝেইমার অ্যান্ড ডিমেনশিয়া নামের পত্রিকায় প্রকাশিত অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫০০ জন নারীর মধ্যে যারা ছয় ঘণ্টার কম ঘুমায় তাদের ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এই সকল রোগের ঝুঁকি কমাতে ড. ফিলিটের পরামর্শ হলো, ঘুমানোর সময় নির্ধারণ করতে হবে এবং সময়ানুযায়ী ঘুমাতে হবে, অ্যাপিনার মতো অনিদ্রা জাতীয় সমস্যার সঠিক  চিকিৎসা করতে হবে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা এড়াতে, ঘুমানোর দুই থেকে তিন ঘণ্টা পূর্বেই ব্যায়াম এবং খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলা উচিত।

মাত্রাতিরিক্ত ঘুম: বয়স ভেদে আপনার ঘুমের অভ্যাস নানাভাবে পরিবর্তন হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেমন, একজন অবসরপ্রাপ্ত ষাটের ওপরে বয়স এমন ব্যক্তি   প্রতি রাতে নয় ঘণ্টা ঘুমায়, অথচ সদ্য জন্মগ্রহণকারী শিশু তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমালেই বাবা-মা খুশি।

৭৫০০ জনের সেই একই গবেষণা থেকে গবেষকরা আরো জানিয়েছেন, যারা প্রতি রাতে আট ঘণ্টার চেয়ে বেশি ঘুমায় তাদের ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি ৩৫ শতাংশ।
গভীর নিদ্রার জন্য ঘুম সহায়ক ওষুধ গ্রহণেও দেহের সমস্যা তৈরি হতে পারে। ড. সেগিল বলেন, অনিদ্রাজনিত ঘুমের সমস্যায় পড়া বেশিরভাগ রোগীই যথাযথ চিকিৎসার ফলে সুস্থ হয়ে ওঠে। অনিদ্রা দূর করার জন্য বেনাড্রিল জাতীয় ওষুধগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই ওষুধগুলো আলঝেইমার প্রতিরোধক রাসায়নিক পদার্থগুলোকেও দেহ থেকে কমিয়ে দেয়।

সুতরাং ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া এবং নিদ্রাহীনতা দূর করার জন্যে আর কি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন তা ডাক্তারকে জানানো উচিত।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মে ২০১৭/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়