ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নিঃস্বার্থ আলোক ছটা ছড়াচ্ছে ‘ল্যাম্পপোস্ট’

আমিনুর রহমান হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৪, ১১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিঃস্বার্থ আলোক ছটা ছড়াচ্ছে ‘ল্যাম্পপোস্ট’

আমিনুর রহমান হৃদয় : মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গিমুক্ত সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে শিক্ষিত ও দক্ষ যুব সমাজকে কল্যাণমূলক কাজে স্বেচ্ছা অংশগ্রহণে উৎসাহীত করে যাচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ‘ল্যাম্পপোস্ট’ নামে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি বিশ্বাস করে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। এজন্য সমগ্র জাতিকে নিজ নিজ দক্ষতা ও সামর্থ্য মোতাবেক কাজ করতে হবে।

বিচ্ছিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সাময়িক প্রতিরোধ হয়তো সম্ভব কিন্তু স্থায়ী প্রতিকার নয় এমনটিই মনে করছে সংগঠনটি। তাই তারা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজস্ব পরিসরে সাজিয়েছে নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি। যা উপযুক্ত সময় ও আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত করে যাচ্ছে।

বাৎসরিক ১৮টি প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি ও ১০টি ঐচ্ছিক কর্মসূচি লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে ‘ল্যাম্পপোস্ট’। সংগঠনটির অন্যতম মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, জাতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে আদর্শ উদাহরণ (রোল মডেল) তৈরির মাধ্যমে সরকারের সহযোগী হয়ে জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন ও জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অবদান রাখা।

সংগঠনটির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলা এড়াতে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও অলাভজনক এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সরাসরি সদস্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে আগ্রহীদের উপযুক্ততা ও যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সহযোগিতার সুযোগ দেয়া হয়।

সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগী হয়ে নয়, বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে চায় ‘ল্যাম্পপোস্ট’। স্থানীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নে স্বেচ্ছায় নিজ দক্ষতা ও সামর্থ্য মোতাবেক অংশীদারিত্ব ভিত্তিক সুষম কর্ম পরিকল্পনা ল্যাম্পপোস্ট এর মূল মন্ত্রণা।
 


ল্যাম্পপোস্টের টেকসই উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প সমূহের নাম- ১. বিনামূল্যে দুঃস্থ মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা (মাওশি); ২. তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সচেতন ও সুস্থ প্রজন্ম বিনির্মাণে উচ্চ বিদ্যালয় আইসিটি ক্যাম্পেইন ও বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা (উন্মেষ); ৩. ঝড়ে পড়া, অনগ্রসর ও দুর্বল ছাত্রদের বিনামূল্যে নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা (জন্মদিন); ৪. প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল পরিচালনায় সহযোগিতা (দিশারী); ৫. বিনামূল্যে কম্পিউটার বিষয়ক প্রাথমিক শিক্ষা ও আয় মূলক (ফ্রিল্যান্সিং) কোর্স ‘সবার জন্য কম্পিউটার’ (বাতিঘর); ৬. বিনামূল্যে দৈনিক পত্রিকা ও চাকরি বিজ্ঞপ্তি পড়ার ওয়াল স্ট্যান্ড (অনির্বাণ); ৭. পৌর এলাকার প্রতিটি আবাসিক এলাকার রাস্তার নামকরণ (স্বচ্ছ); ৮. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবসে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতা (মিছিল); ৯. দুঃস্থ ও মেধাবী ছাত্রদের সহযোগিতা ও বাৎসরিক কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা (স্বপ্নডানা); ১০. বাৎসরিক বৃক্ষ রোপণ ও শীতবস্ত্র বিতরণ (স্বাধীনতা); ১১. দুঃস্থ/অসহায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বয়স্ক ভাতা অথবা সমাজ সেবা অধিদপ্তর কর্তৃক সহয়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা (অস্তিত্ব); ১২. বিনামূল্যে অনলাইনভিত্তিক আইনি সহায়তা সেবা (অপরাজিতা); ১৩. বিনোদন ও গণমাধ্যম হিসেবে বাঙালি গ্রামীণ/লোকজ সংস্কৃতি রক্ষা ও সুস্থ্য ধারার দেশজ সংস্কৃতি রক্ষা কার্যক্রম (বায়ান্ন); ১৪. বিভিন্ন খেলাধুলোয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরি ক্যাম্প পরিচালনা (একাত্তর); ১৫. ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষিভিত্তিক কাউন্সিলিং ও বিনামূল্যে গবাদি পশু ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম (শিকড়); ১৬. মাদক ও জঙ্গি বিরোধী আন্দোলন (বিজয়); ১৭. শুদ্ধ কোরআন শিক্ষা কার্যক্রম (শুদ্ধি); ১৮. জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান- এর জীবন দর্শন প্রচারণায় ভ্রাম্যমাণ আলোকচিত্র ও ভিডিও প্রদর্শনী (বঙ্গবন্ধুর পাঠশালা)।

ঐচ্ছিক কর্মসূচির সমূহের নাম- ১.  বাৎসরিক পত্রিকা/মুখপাত্র প্রকাশনা, ২.  নতুন বছরের শুভেচ্ছা ক্যালেন্ডার বিতরণ, ৩. ক্রিকেট/ফুটবল/ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা আয়োজন, ৪. রক্তদান কর্মসূচি ও ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্পেইন, ৫. বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে সচেতনতামূলক ফিল্ম শো, পোস্টার বা লিফলেট বিতরণ যেমন, এইডস, ব্রেস্ট ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হাত ধোয়া, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং ইত্যাদি, ৬. পহেলা বৈশাখ উদযাপন (মঙ্গল শোভাযাত্রা, গ্রামীণ পিঠা উৎসব, হাডুডু বা ঘুড়ি উৎসব), ৭. রত্নাগর্ভা মা ও সূর্য সন্তান জরিপ, ৮. বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রয়োজন মাফিক যথাসাধ্য সহযোগিতা, ৯. দুঃস্থদের গণ বিয়ে পড়ানো, ১০. বেওয়ারিশ লাশ দাফন।

সামর্থ্য মোতাবেক নিজস্ব উদ্যোগে ল্যাম্পপোস্ট পরিচালিত বর্তমান কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে- মাওশি, অনির্বাণ, অপরাজিতা, বিজয়, স্বাধীনতা, শুদ্ধি ও বঙ্গবন্ধুর পাঠশালা। এছাড়াও ঐচ্ছিক কর্মসূচি হিসেবে মাসে গড়ে অন্তত একটি জনসচেতনতা বা জনস্বার্থ মূলক কর্মসূচি পালন করে আসছে ল্যাম্পপোস্ট। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপিং, খাদ্যে ফরমালিন বিরোধী প্রচারণা, দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ, খাদ্য শ্রমিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা ও কৃমির ওষুধ বিতরণ, জ্বালানী তেল/গ্যাস বিষয়ে সচেতনতা ক্যাম্পেইন অন্যতম।

জনশক্তি, দক্ষতা ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নিজে এগিয়ে যাওয়া সংগঠনটি আর্থিক অসচ্ছ্বলতার কারণে অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে না বলে জানান সংগঠন সংশ্লিষ্টরা।
 


সংগঠনের শুরুটা ছাত্রজীবনে হলেও সংগঠনের অন্যতম নীতিনির্ধারকদের বর্তমান পেশা- মহিউদ্দীন জনি (উন্নয়ন কর্মী, জাইকা ও স্থানীয় সরকার প্রশাসন), সোহানুর রহমান (কর্পোরেট ম্যানেজার), আরিফুজ্জামান (ব্যবসা), ডা. ক্যাপ্টেন রুহুল আমীন প্রিন্স (সেনা ডাক্তার) ও সাইফুর রহমান (শিক্ষক)। সংগঠনের প্রাণ অগণিত স্বেচ্ছাসেবকদের উল্লেখযোগ্যঅংশ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীরা।

সংগঠনের সাফল্য গাঁথার সঙ্গে বেশ কিছু অপারগতা ও সীমাবদ্ধতার কথা প্রকাশ পেল ল্যাম্পপোস্ট নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে। সংগঠনটির সভাপতি সোহানুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ল্যাম্পপোস্ট এর মূল বৈশিষ্ট্য হল- আমরা কখনই প্রভাবশালী বা রাজনীতিবিদদের চাঁদার মুখাপেক্ষী হয়ে কার্যক্রম পরিকল্পনা করি না। নিজেদের সামর্থ্য মোতাবেক চাঁদা দিয়ে যতটুকু সম্ভব সেটাই বাস্তবায়ন করা হয়। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ স্বেচ্ছায় কর্মসূচিভিত্তিক পৃষ্ঠপোষক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে স্বাগত জানিয়ে ইভেন্টভিত্তিক প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহের তালিকা দেয়া হয়। দাতা যেন নিজ উদ্যোগে খরচ করে আমাদের সহায়তা করার সুযোগ পান। এতে তার আত্ম সন্তুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সংগঠন হিসেবে বাড়ে ল্যাম্পপোস্ট এর প্রতি আস্থা। যেহেতু নগদ অর্থ সকল ঋণাত্মক সন্দেহের উদ্বেগ ঘটায় তাই এই নীতির উদ্ভাবন।’

সাধারণ সম্পাদক ডা. ক্যাপ্টেন রুহুল আমিন প্রিন্স বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ কর্মসূচি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর। বর্তমান সময়ে এর ব্যবহার চাইলেও আমরা অস্বীকার করতে পারব না। তাই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করতে জড়তা ও ভয় কাটিয়ে এর ব্যবহারে আগ্রহী করতে আমাদের কিছু পরিকল্পনা আছে কিন্তু নেই বাস্তবায়ন সামর্থ্য। স্বেচ্ছাসেবকদের ল্যাপটপ, ক্যামেরা, পেন ড্রাইভ আর ভাড়া করা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দিয়ে সহসাই খুব বেশিদূর এগোনো সম্ভব হচ্ছে না আমাদের। শখের ব্যক্তিগত জিনিস চেয়ে চেয়ে এনে কতবার আর কাজ করা সম্ভব বলুন? এদিকে স্থায়ী সমাধান বড় অংকের বিষয়। ইচ্ছা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

রুবেল, তিথি, আরাফাত, নিঝুম, হৃদয়, হাসিনুর, লিমন, শাহরিয়ার, রনি, শুভ, হিরা, সবুজ, সানি দের সমন্বয়ে গঠিত তারুণ্য দিপ্ত ‘টিম ল্যাম্পপোস্ট’ সর্বদা সাড়া দিতে প্রস্তুত দেশের যেকোনো শহর কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জরুরি মুহূর্তে। দুর্যোগ, কুসংস্কার, দারিদ্রতা, অ-শিক্ষার মতো সামাজিক জড়াকে ছুড়ে ফেলে ল্যাম্পপোস্ট এর নিঃস্বার্থ আলোক ছটা ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর তারা। আমন্ত্রণের অপেক্ষায় প্রস্তুত আলোর মিছিল নিয়ে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ মার্চ ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়