ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর উপায় (দ্বিতীয় পর্ব)

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ২৪ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর উপায় (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : ক্যানসার একটি প্রাণঘাতী রোগ। সারা বিশ্বে রোগে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ক্যানসার। আমাদের ভুল জীবনযাপন, খাবার সম্পর্কে অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর ৩৬টি উপায় নিয়ে চার পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

* নিয়মিত ধূলি দূর করুন
কিছু গবেষণার একটি রিভিউ অনুসারে, ধূলিতে বিভিন্ন টক্সিক কেমিক্যাল থাকে, যেমন- থ্যালেট, ফ্লুরিনেটেড কেমিক্যাল ও ফ্লেইম রিটারড্যান্ট। তাই ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য ঘরকে নিয়মিত ধূলিমুক্ত রাখা উচিৎ। গবেষণা লেখক ভিনা সিংগলা ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে লিখেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ইনডোর ডাস্টে পাঁচ শ্রেণীর ৪৫টি কেমিক্যাল শনাক্ত করেছি। এসব কেমিক্যাল ক্যানসার ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।’ আমাদের ঘরের সবকিছু থেকে কেমিক্যাল রিলিজ হচ্ছে, যেমন- বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল, ফ্লোরিং, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিকস, কার্পেট ও পোশাক। এসব কেমিক্যাল এক্সপোজারের ঝুঁকি হ্রাস করতে ঘনঘন ঘর থেকে ধূলি দূর করুন।

* সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালাবেন না
সাইট্রাস মোমবাতি ঘরে সুঘ্রাণ ছড়ালেও, এটি ক্যানসার-সৃষ্টিকারী কেমিক্যালও ঘরের বাতাসে সৃষ্টি করে, যা আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যুক্তরাজ্যের একটি ছোট গবেষণা অনুসারে, যখন সুবাস লিমোনিন (এটি মোমবাতি, এয়ার ফ্রেশনার ও পরিষ্কারকরণ সামগ্রীতে লেবুর ঘ্রাণ যুক্ত করে) রিলিজ হয়, এটি বাতাসে ওজোনের সঙ্গে রিয়্যাক্ট করে ক্যানসার-সৃষ্টিকারী কেমিক্যাল ফরমালডিহাইড সৃষ্টি করে। লিমোনিন বাইরে চলে যাওয়ার জন্য জানালা খুলে দিন অথবা লিমোনিন আছে এমন প্রোডাক্ট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

* ঘরে কিছু হাউসপ্ল্যান্ট লাগান
গবেষণায় পাওয়া গেছে, হাউসপ্ল্যান্ট (যে উদ্ভিদ ঘরে লাগানো হয়) বায়ু থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে পারে, যার মধ্যে কিছু ক্যানসার-সৃষ্টিকারী কেমিক্যালও অন্তর্ভুক্ত আছে- এভাবে হাউসপ্ল্যান্ট ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ঘরে হাউসপ্ল্যান্ট লাগালে ইনডোরের ফরমালডিহাইডের মাত্রা হ্রাস পায়। বিশেষ কার্যকর হাউসপ্ল্যান্টের মধ্যে ইংলিশ আইভি, ফার্ন, জিরানিয়াম ও ল্যাভেন্ডার অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকান সোসাইটি ফর হর্টিকালচার সায়েন্স অনুসারে, ঘরের উদ্ভিদ ফরমালডিহাইড ও অন্যান্য কেমিক্যাল হ্রাস করতে পারে। গবেষণা লেখক কুয়াং জিন কিম বলেন, ‘আমাদের গবেষণার প্রমাণের আলোকে বলা যায় যে, কিছু উদ্ভিদ ঘরের পরিবেশ উন্নত করে এবং এর ইতিবাচক প্রভাব ঘরের অধিবাসীদের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ে।’

* ডায়েটে সবুজ শাকসবজি রাখুন
আপনি যে ধরনেরই ডায়েট নির্বাচন করেন না কেন, শাকসবজির ওপর মনোযোগ দেওয়া সবসময় একটি স্বাস্থ্যকর উপায় এবং এটি ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অবস্থিত পায়েডমন্ট হেলথকেয়ারের রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান শায়না কুমার বলেন, ‘উদ্ভিজ্জ খাবার খান এবং নিশ্চিত হোন যে বিভিন্ন বর্ণের খাবার খাচ্ছেন- কারণ বর্ণালী খাবার খাওয়ার মানে হচ্ছে আপনি অধিক পরিমাণে পুষ্টি, ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গ্রহণ করছেন। আপনার প্রতি সপ্তাহে তিন বাটি সবুজ শাকসবজি খাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত, যেমন- পাতাকপি, পালংশাক ও বাঁধাকপি।’ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট বলছে, প্রকৃতপক্ষে গবেষণা প্রমাণ করেনি যে সবুজ শাকসবজি ক্যানসার প্রতিরোধ করে, কিন্তু কিছু গবেষণায় ইতিবাচক সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ডা. কুমার বলেন, ‘যখন আপনি অধিক উদ্ভিজ্জ খাবার খান, আপনি অধিক মাত্রায় ফাইটোকেমিক্যাল ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গ্রহণ করেন যা ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে।’

* বাড়তি ওজন কমান
ওজন বেড়ে যাওয়া অথবা স্থূল হওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য কখনোই ভালো নয় এবং এটি আপনার ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। পায়েডমন্ট হেলথকেয়ারের এমপ্লয়ি ওয়েলনেস, ওয়ার্কলাইফ অ্যান্ড ফিটনেসের পরিচালক জেনিফার হোপার বলেন, ‘শরীরকে চর্বিহীন রাখা এবং স্বাস্থ্যসম্মত বডি মাস ইনডেক্স বজায় রাখা ক্যানসারের সার্বিক ঝুঁকি হ্রাস করে।’ আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি অনুসারে, ক্যানসারে মারা যায় এমন পাঁচজনের মধ্যে একজনের অত্যধিক শারীরিক ওজন থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিন/মন্টেফিয়োর হেলথ সিস্টেমের সিনিয়র এপিডেমিওলজিস্ট জিওফ্রে কাবাট বলেন, ‘অতিরিক্ত ওজন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে, বিশেষ করে মেনোপজ-পরবর্তী স্তন ক্যানসার, এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার ও কিডনি ক্যানসার।’ যদিও গবেষকরা ওজন ও ক্যানসারের সংযোগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানেন না, তবে অতিরিক্ত ওজনের কারণে হরমোনের মাত্রা, কোষের গ্রোথ নিয়ন্ত্রণকারী ফ্যাক্টর ও ইমিউন সিস্টেমের অসামঞ্জস্যতার ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিক্যাল সেন্টারের হেড অ্যান্ড নেক অনকোলজিক সার্জারি ডিপার্টমেন্টের প্রধান রবার্ট এল. ফেরিস বলেন, ‘স্থূলতা প্রদাহ বৃদ্ধি করে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।’ সুইডেনের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, যেসব কিশোরদের উচ্চ বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) থাকে, তাদের পরবর্তীতে লিভার ক্যানসার হওয়ার বর্ধিত ঝুঁকি থাকে। তাই অল্প বয়স থেকেই স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিক্যাল সেন্টারের অনকোলজিস্ট এবং ক্যানসার সেন্টারের ওয়েলনেস অ্যান্ড ইন্টেগ্রেটিভ প্রোগ্রামের পরিচালক লেনি ফ্রান্সিস বলেন, ‘কিছু ক্যানসার প্রতিরোধ করতে এবং কিছু ক্যানসারের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ওজন নিয়ন্ত্রণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ডায়েট ও এক্সারসাইজের মাধ্যমে নিজের যত্ন নিন।’

* পর্যাপ্ত ঘুমান
প্রতিরাতে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে: দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের ঘাটতি ও নিম্নমানের ঘুমের সঙ্গে ক্যানসারের সংযোগ রয়েছে। অনেক গবেষণায় বিভিন্ন ক্যানসারের (যেমন- প্রোস্টেট ক্যানসার, কোলরেক্টাল ক্যানসার ও স্তন ক্যানসার) সঙ্গে ঘুমের ঘাটতির সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়েছে। ক্যানসার ট্রিটমেন্ট সেন্টারস অব আমেরিকা অনুসারে, ঘুমের ঘাটতি প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং ইমিউন ফাংশনকে ব্যাহত করে, যা ক্যানসার বিকাশের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া ঘুম হরমোন মেলাটোনিন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসেবে কাজ করতে পারে- যদি আপনি পর্যাপ্ত ঘুমাতে না পারেন, তাহলে এই উপকারিতা পাবেন না। ডা. কাবাট বলেন, ‘সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ঘুম গুরুত্বপূর্ণ।’

* স্ট্রেস কমান
যদিও স্ট্রেস বা মানসিক চাপ ক্যানসার সৃষ্টি করে কিনা তা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বোধগম্য হওয়া যায়নি, কিন্তু ইউটিএমডি অ্যান্ডারসন ক্যানসার সেন্টার এবং ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার গবেষণার একটি রিভিউ বলছে যে, স্ট্রেস ক্যানসার বিকাশের কারণ হতে পারে। গবেষণা লেখকেরা লিখেন, ‘গত ৩০ বছরের গবেষণা ক্যানসার বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে এমন সাইকোসোশ্যাল ফ্যাক্টর শনাক্ত করেছে, যেমন- স্ট্রেস, ক্রনিক ডিপ্রেশন ও সামাজিক সমর্থনের অভাব। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অন্য একটি গবেষণা এর কারণ শনাক্ত করেছে: স্ট্রেস জিনের সক্রিয়তা ক্যানসার কোষের গ্রোথ বৃদ্ধি করতে পারে। মাইন্ডফুলনেস ব্রিদিং বা মেডিটেশন এবং ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি স্ট্রেসের মাত্রা কমাতে পারে, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। ডা. ফ্রান্সিস বলেন, ‘আমি দৌঁড় ও বেয়ার ক্লাসের পাশাপাশি যোগব্যায়াম চর্চা করি যা স্ট্রেস দূর করে এবং আমাকে আমার কমিউনিটির সঙ্গে মিশতে সুযোগ দেয়।’

* বেশি করে ব্রকলি খান
ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য এই সবজিটির বিশেষ শক্তি রয়েছে। ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, ব্রকলিতে প্রচুর পরিমাণে সালফোরেপ্যান নামক ডায়েটারি কম্পাউন্ড থাকে যা কোষকে ম্যালিগন্যান্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। ডা. ফেরিস বলেন, ‘আমাদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সালফোরেপ্যান কয়েক প্রকার ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে। ব্রকলি স্প্রাউট নির্যাসের শক্তিশালী ডোজ একটি ডিটক্সিফিকেশন (বিষমুক্তকরণ) জিনকে সক্রিয় করতে পারে এবং মস্তিষ্ক ও ঘাড়ের ক্যানসারের রোগীদের ক্যানসার ছড়ানো প্রতিরোধ করতে পারে।’ ডা. ফেরিস বলেন, ‘মুখের ক্যানসারের উচ্চ ঝুঁকির লোকদের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গ ক্যানসার ইনস্টিটিউট বর্তমানে ব্রকলি স্প্রাউটের নির্যাস নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে।’

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়