ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর উপায় (তৃতীয় পর্ব)

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ২৬ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর উপায় (তৃতীয় পর্ব)

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : ক্যানসার একটি প্রাণঘাতী রোগ। সারা বিশ্বে রোগে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ক্যানসার। আমাদের ভুল জীবনযাপন, খাবার সম্পর্কে অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর ৩৬টি উপায় নিয়ে চার পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।

* চর্বি খাওয়া কমিয়ে দিন
লাল মাংস খাওয়া কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চর্বি ভোজন হ্রাস করাও ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, চর্বিবহুল ডায়েট ইঁদুরদের মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টি করেছে। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, যেসব পুরুষ প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট খেয়েছিল তাদের অত্যধিক আগ্রাসী প্রোস্টেট ক্যানসার ছিল। ক্যানসারের ওপর চর্বির প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এখনো স্পষ্টভাবে বোধগম্য হওয়া যায়নি, কিন্তু বিভিন্ন প্রমাণের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, অতিরিক্ত চর্বি শরীরের জন্য ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অবস্থিত পায়েডমন্ট হেলথকেয়ারের রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান শায়না কুমার বলেন, ‘আমি রোগীদের উচ্চ চর্বি সমৃদ্ধ মাংস ভোজন সীমিত করতে বলি- প্রোটিনের অন্যান্য ভালো উৎস রয়েছে, যেমন- মাছ, ডিম, বিনস সমৃদ্ধ স্যূপ, কুইনোয়া পাস্তা ও ভেজি র‍্যাপ। যখন উচ্চ চিনি বা উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার খান, এসব খাবার আপনার ডায়েটের মূল্যবান জায়গা দখল করে- এর ফলে আপনার ইমিউন সিস্টেম ওভারটাইম কাজ করে, যা ক্যানসার-সৃষ্টিকারী প্রদাহের কারণ হতে পারে।’ তিনি ডায়েটে চর্বি সীমিত করার জন্য ৮০ শতাংশ হোল ফুড (যেমন- ফল, শাকসবজি, বাদাম ও লেগিউম) এবং ২০ শতাংশ প্রাণীজ খাবার (যেমন- দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার, মাংস ও ডিম) খেতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

* প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার সংরক্ষণ করবেন না
থ্যালেট হলো কেমিক্যাল যা প্লাস্টিককে নমনীয় করতে ব্যবহার করা হয় এবং ক্যানসারের সঙ্গে এটির সংযোগ সম্পর্কে এখনো স্পষ্টভাবে বোধগম্য হওয়া না গেলেও কিছু থ্যালেটকে মানুষের জন্য কার্সিনোজেন (ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ) হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ অনুসারে। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল নিরাপদ থাকতে প্লাস্টিক পাত্রে খাবার মাইক্রোওয়েভ না করতে পরামর্শ দিচ্ছে এবং মাইক্রোওয়েভিংয়ের সময় প্লাস্টিক র‍্যাপ যেন খাবারকে স্পর্শ না করে- এর পরিবর্তে আপনার খাবারকে ওয়াক্স অথবা পার্চমেন্ট পেপার কিংবা পেপার টাওয়েল দিয়ে ঢেকে দিন। এছাড়া পুরোনো অথবা স্ক্র্যাচ পড়েছে এমন প্লাস্টিক পাত্র ফেলে দিন, এর পরিবর্তে কাচের পাত্র ব্যবহার করুন। ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ মেডিক্যাল সেন্টারের অনকোলজিস্ট এবং ক্যানসার সেন্টারের ওয়েলনেস অ্যান্ড ইন্টেগ্রেটিভ প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. লেনি ফ্রান্সিস বলেন, ‘কাচের পাত্রে খাবার সংরক্ষণ হচ্ছে একটি স্বাস্থ্য পরিকল্পনা যা আমি রোগীদেরকে রিকমেন্ড করি।’

* ক্যান সম্পর্কে সতর্ক থাকুন
শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে যে বিপিএ ইঁদুরদের মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু মানুষের ওপর গবেষণা নীতিগতভাবে কঠিন। কিন্তু এই কেমিক্যাল যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। প্লাস্টিকেও বিপিএ থাকে, যদিও বর্তমানে অনেক প্লাস্টিক প্রোডাক্টের লেবেলে ‘বিপিএ নেই’ কথাটি লেখা থাকে। বিপিএ’র অন্য একটি উৎস হচ্ছে ক্যান। স্ট্যানফোর্ডের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় গবেষকরা আবিষ্কার করেন, যেসব লোক একটি ক্যানের খাবার খেয়েছিল তাদের মূত্রে যারা ক্যানের খাবার খাননি তাদের তুলনায় বিপিএ’র ২৪ শতাংশ উচ্চ কনসেন্ট্রেশন ছিল। যারা দুইটি বা এর বেশি ক্যানড প্রোডাক্ট খেয়েছিল তাদের ৫৪ শতাংশ উচ্চ কনসেন্ট্রেশন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিলের (এনআরডিসি) সিনিয়র বিজ্ঞানী মিরিয়াম রটকিন-এলম্যান ক্যানড প্রোডাক্ট পরিহার করতে পরামর্শ দিচ্ছে, বিশেষ করে টমেটো প্রোডাক্টের মতো উচ্চ অ্যাসিডিটি আছে এমন ক্যানড খাবার।

* অলসতা পরিহার করুন
ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, শারীরিক সক্রিয়তা। ১.৪ মিলিয়ন লোকের ওপর চালানো গবেষণার একটি বড় রিভিউ অনুসারে, যেসব লোক ব্যায়াম করেছিল তাদের ১৩টি ক্যানসারের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। যেসব লোক শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকে তাদের শরীরে চর্বি তেমন একটা জমতে পারে না- এটিও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়, কিন্তু ব্যায়াম অন্যান্য আরো উপায়েও আপনার ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট অনুসারে। পায়েডমন্ট হেলথকেয়ারের এমপ্লয়ি ওয়েলনেস, ওয়ার্কলাইফ অ্যান্ড ফিটনেসের পরিচালক ডা. জেনিফার হোপার বলেন, ‘নিয়মিত ব্যায়াম প্রদাহ হ্রাসে সাহায্য করতে পারে, ইমিউন সিস্টেমের কার্যক্রম উন্নত করে এবং ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু হরমোনের মাত্রা কমায়।’ শারীরিক সক্রিয়তা ডাইজেস্টিভ ট্র্যাক্টে জিনিসের মুভমেন্টেও সাহায্য করে, যার ফলে কার্সিনোজেন (ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ) এক্সপোজারের সম্ভাবনা কমে যায়। হোপার বলেন, ‘আপনার সার্বিক ঝুঁকি কমাতে প্রতিসপ্তাহে চার থেকে ছয় ঘন্টা ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। প্রথম প্রথম কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু প্রতিদিনকার ব্যায়ামকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে সম্পাদন করে আপনি ব্যায়ামের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, যেমন- প্রতিদিন ২০ মিনিট দ্রুত হাঁটার লক্ষ্য নির্ধারণ করে একে তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারেন যার প্রত্যেক ভাগে সাত মিনিট পড়বে।

* হাইড্রেটেড থাকুন
মিশ্র গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, প্রচুর পরিমাণে পানি পান মূত্রাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি প্রচুর পানি পান করতে পরামর্শ দিচ্ছে। যেহেতু কূপের পানির সঙ্গে ক্যানসারের সংযোগ পাওয়া গেছে, তাই পানি পানের পূর্বে ফিল্টার করাই সর্বোত্তম। প্রকৃতপক্ষে, এনআরডিসি বলছে যে বোতলের পানিও ট্যাপের পানির মতো শতভাগ নিরাপদ নয়। ডা. ফ্রান্সিস বলেন, ‘যদি আপনার পানির উৎস সম্পর্কে সন্দেহ থাকে, তাহলে পানি ফিল্টার করুন।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমি প্রতিদিন যথাসম্ভব প্রচুর পানি পান করি এবং আমি কর্মস্থলে একটি বড় গ্লাসের বোতলে পানি এনে আমার ডেস্কের ওপর রাখি যেন সারাদিন জুড়ে পানি পান করতে মনে থাকে।’

* ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন
চর্বিযুক্ত ফাস্ট ফুড আপনার স্বাস্থ্যের ওপর যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা ইতোমধ্যে জানি যে, উচ্চ চর্বিযুক্ত ডায়েটের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলার অন্য কারণও রয়েছে: ইউনিভার্সিটি অব নটর ডেমের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, ফাস্টফুডের প্যাকেটে পারফ্লুরিনেটেড কেমিক্যাল (পিএফসি) থাকে- এই কেমিক্যালের সঙ্গে কিডনি ক্যানসার ও অণ্ডকোষের ক্যানসারের সংযোগ পাওয়া গেছে। পিজ্জা বক্স, মাইক্রোওয়েভ পপকর্ন ব্যাগ ও চাইনীজ ফুড কন্টেইনারেও এই কেমিক্যাল থাকতে পারে।

* অর্গানিক খাবার খান
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হার্বিসাইড গ্লাইফোসেট মানুষের জন্য একটি সম্ভাব্য কার্সিনোজেন (ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ)। অল্প উপাত্তের জন্য এ গবেষণাটি কিঞ্চিত সমালোচিত হলেও আইএআরসি খাদ্যে শস্যে বিষাক্ত পেস্টিসাইডের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বলছে: যদি আপনি পেস্টিসাইডের (খাদ্য শস্যে পেস্টিসাইড বা বালাইনাশকের ব্যবহার বেশি হলে খাদ্য বিষাক্ত হয়) ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকেন, তাহলে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোধগম্য না হওয়া পর্যন্ত অর্গানিক ফল ও শাকসবজি নির্বাচন করুন। ডা. কুমার বলেন, ‘ডার্টি ডজেন বা ১২টি বিষাক্ত কেমিক্যাল থেকে বাঁচতে অর্গানিক কৃষিজাত খাবার কিনুন, যেমন- আপেল, সেলেরি, চেরি টমেটো ও শসা। আপনার বাজেটের ওপর ভিত্তি করে ক্লিন ফিফটিন (অর্গানিক অথবা নন-অর্গানিক) কিনুন, যেখানে ন্যূনতম পেস্টিসাইড রেসিডু থাকে। ক্লিন ফিফটিন কৃষিজাত খাবারের মধ্যে শতমূলী, অ্যাভোক্যাডো, বাঁধাকপি ও ফুটি অন্তর্ভুক্ত।’ যদি আপনি অর্গানিক ফল ও শাকসবজি কিনতে না পারেন, তাহলে সাধারণ ফল ও শাকসবজি ভালোভাবে ধুয়ে খেতে পারেন।

* সূর্যের নিচে বেশিক্ষণ থাকবেন না
প্রতিদিন অল্প সময় (১০ বা ১৫ মিনিট) সূর্যের নিচে কাটানোতে উপকারিতা রয়েছে, কিন্তু সূর্যের নিচে বেশিক্ষণ থাকলে আপনার স্কিন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, যেসব নারীর রক্তে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ডি ছিল তাদের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি নিম্নমাত্রার ভিটামিন ডি ছিল এমন নারীদের তুলনায় ৬৭ শতাংশ কম ছিল। ডা. ফ্রান্সিস বলেন, ‘ভালো প্রমাণ রয়েছে যে উচ্চমাত্রার ভিটামিন ডি কিছু ক্যানসারের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।’ ভিটামিন ডি পেতে সূর্যের নিচে অল্পসময় ব্যয় করতে পারেন, কিন্তু স্কিন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে বেশিক্ষণ থাকবেন না। চর্বিযুক্ত মাছ, ফর্টিফায়েড সিরিয়াল ও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্টে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়