ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

“আমি বলি, ‘রয়ালিটি দাও পাণ্ডুলিপি নাও’’

হাসান আজিজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
“আমি বলি, ‘রয়ালিটি দাও পাণ্ডুলিপি নাও’’

একুশে গ্রন্থমেলা আমার কাছে সব সময় মৌসুমী ব্যাপার মনে হয়। এই ভাবনা আমাকে আনন্দ দেয় না। একটা জাতি চিন্তা করবে, সৃজন করবে; এজন্য বিশেষ মৌসুম লাগবে! বছরজুড়ে চর্চা হবে না- এটা কি করে হতে পারে?
অস্বীকারের উপায় নেই, বইমেলা যত নিকটে হয় ব্যস্ততা বাড়ে লেখক-প্রকাশকের। বই প্রকাশের ধুম পড়ে! বছরের অন্য সময় বই প্রকাশ হয় না বললেই হয়; নতুন বই দেখাই যায় না! আমাদের দেশে প্রকাশক যারা আছেন, একটু নামি লেখক, তারপর তাদের আশপাশে যারা আছেন তাদের নাম শুনে পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করেন। পাণ্ডুলিপি নির্বাচনের এটি এক ধরণের স্বীকৃত উপায়।
এখন সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও অবকাশ নেই। তাই যদি হতো একজন লেখককে বই প্রকাশ করতে গিয়ে বইয়ের বানান ঠিক থাকবে কি না এ নিয়ে ভাবতে হতো না। এই ভাবনাটা লেখকের নয়, প্রকাশকের। প্রকাশক পুরোপুরি ভারটা নেননি। একজনের দায়িত্ব আরেকজন পালন করতে গিয়ে সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে।

আমরা শোষিত জাতি। সেই শোষণ এখনও বদল হয়নি। এখনও ধন-সম্পত্তিতে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বিত্ত-বৈভবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শিক্ষা-সংস্কারেও অনেক পার্থক্য রয়েছে। ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলি বটে কিন্তু বিষয়টি খুব কম লোকই জানেন এবং অনুধাবন করতে পারেন। এখানে এক বা দু’দল আছেন যারা মনে করেন তাদের অরিজিন অন্য জায়গায়। তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা। অথচ সত্য হচ্ছে- এদেশের সাধারণ মানুষ নানান রকম গোত্রে বিভক্ত ছিলো। আজ থেকে সাতশো-আটশো বছর আগে ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণ হয়। এরপর বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মানুষ এখানে এসেছে। মিশরীয়, সিরিয়ান, ইন্দো-ইউরোপিয়ান এসেছে। বসতি গড়ে তুলেছে। সংস্কৃতি আদান-প্রদান হয়েছে। গোত্রে-গোত্রে, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্ক দুই রকমই ছিলো। সেটা যেমন আত্মীয়তার, অন্যদিকে লড়াইয়ের। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাইরের রক্ত মিশেছে এখানকার মানুষের রক্তে। এই মানুষের ভেতর থেকে সম্প্রদায় করে নেয়া এবং সেই সম্প্রদায় অনুযায়ী চলন অভ্যাস তৈরি করা সমীচীন  নয়। 

আমি মনে করি, সংস্কারে-বিশ্বাসে অনেক রকম পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এই পার্থক্যের উপরে হচ্ছে মানুষ। কাজেই মানুষে-মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। আমি সেজন্য সব সময় একটা কথা বলি- মানুষ আলাদা কিন্তু মানব এক। সর্বত্রই এক ‘মানব’। আলাদা কেউ নেই। ওই রবীন্দ্রনাথের গানের মত : মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে/ ...আমি একা নির্ভয়ে।’

বিশ্বজোড়া আমার বাড়ি আছে, আত্মীয় আছে, স্বজন আছে। আমি মনে করি যে, এই পৃথিবীই হচ্ছে আমার স্বদেশ। পৃথিবীর মানুষ হচ্ছে আমার স্বজন। পৃথিবীর সকল গৃহ আমারই গৃহ; আমার নিবাস। এভাবে যদি দেখতে পারা যায় তাহলে এই পৃথিবীটা কিন্তু নিজের করে নেয়া যায়।
সব দেশের, সব মানুষই এক রকম। পার্থক্যগুলো হয়ে যায় নানা রকম বৈষম্যের কারণে। সামাজিক চলমান পরিস্থিতি ওই বৈষম্যেরই প্রতিফলন। যাই হোক, বইমেলা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখানে নানা রকম জটিলতা রয়েছে। অনেক লেখক ঠিকমত রয়ালিটি পান না। নতুন হওয়া সত্ত্বেও যে লেখকের বই বিক্রি হয়, তাকে যদি রয়ালিটি না-দেয়া হয় সেটা দুঃখজনক। সব রকম পরিশ্রমের দাম আছে। প্রতিভার মূল্যায়ণ করা উচিত। এক অর্থে আমার ভাগ্য কিছুটা ভালো- সামান্য হলেও পাঠকপ্রিয়তা আছে। যারা প্রকাশক তারা আগ্রহ নিয়ে আমার বই প্রকাশ করেন। আমি ঠিকমতো রয়ালিটি পাই। আমাকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। পারে না এজন্য যে, অনেক সময় আমি অগ্রীম রয়ালিটি নিয়ে নেই। অন্তত পঞ্চাশ থেকে ষাট শতাংশ পর্যন্ত রয়ালিটি বই প্রকাশের আগেই নিয়ে নেই।

আমি বলি, আগে রয়ালিটি দিয়ে দাও, তারপর পাণ্ডুলিপি নাও। কারণ আমি জানি, বছরজুড়ে অল্প হলেও আমার বই বিক্রি হয়। আমার দু’একজন প্রকাশক আছেন, যাদের কাছে আমি বিভিন্ন সময় টাকা দাবি করি। বলি, আমাকে কিছু টাকা পাঠিও। তারা পাঠিয়ে দেয়। ফলে ব্যক্তিগতভাবে এই গ্রন্থজগত নিয়ে, রয়ালিটি নিয়ে আমার অতৃপ্তির কারণ নেই। কিন্তু সামগ্রিক অতৃপ্তি আছে। সেটা সামগ্রিক সাহিত্যও বটে।
কোন মানে আমরা সামগ্রিক সাহিত্যে পৌঁছেছি? এমনকি যদি প্রশ্ন করা হয়- বাংলা সাহিত্যের সেরা কাজগুলোর সঙ্গে কি আমাদের এই সময়ের কাজ তুলনা করা যাবে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি এখন আছে কেউ? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী কে আছে? এমনকি ‘লালসালু’র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌- তিনিও তো অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক ছিলেন। আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ কবে বেড়িয়েছে কিন্তু এখনও মোটামুটিভাবে সেই লেখার উল্লেখ হয়। তারা আধুনিক কালে কালে। ‘আধুনিকতা’ হলো একটা মনোভাব। এ হলো চিরকাল চকচকে। ওটাতে মরচে ধরে না। হোমার তার সময়ে আধুনিক ছিলেন, এখনও আধুনিক। ‘রামায়ণ’ ‘মাহাভারত’ যারা লিখেছেন তারা কি আধুনিক ছিলেন না? তারা সর্বকালের হয়ে আছেন। হয়ে গেছেন। তাদের সৃষ্টি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। তাদের চিন্তার ওপর ভিত্তি করে পল্লবিত হয়েছে অনেক চিন্তা, অনেক লেখা।

গত দু’তিন বছর বইমেলায় যাওয়া হয়নি। বইমেলায় ঘুরতে ভালো লাগে। যদিও এখন খুব একটা ঘোরাঘুরি আমি করি না। মেলায় গেলে আমার প্রকাশকের স্টলে বসি, চা খাই, গল্পগুজব করি। কেউ এসে বই কিনে নিয়ে যায়। আমাকে দেখে বইটি এগিয়ে দিয়ে বলে ‘কিছু একটা লিখে দিন’। আমিও চট করে তার নামটা জেনে দুই লাইন লিখে দেই। এখন আরও সহজ- লিখেও দিতে হয় না! যারা আসে ফটোগ্রাফ নিতে চায়। এতে আমার কোনো কষ্ট নেই।  আমার ওপর আলো পড়ে- ওটুকুই। কিন্তু সে তো আগুন নয় যে ছ্যাকা লাগবে। বরং ভালোই লাগে।

আমাদের এখানে প্রকাশকরা সহজে বই প্রকাশ করতে চান না। ফলে বিশেষ সমস্যায় পড়ে নতুন লেখক। এখানে প্রকাশকদের দক্ষ সম্পাদক নেই। যারা পাণ্ডুলিপিগুলো দেখবে এবং বলবে- এই পাণ্ডুলিপি তোমরা প্রকাশ করতে পারবে না। বাইরের অনেক দেশে এমন আছে। যেহেতু এখানে সেই সুযোগ নেই, কাজেই প্রকাশক যারা আছেন তারা তাদের হিসাব মিলিয়ে নিয়ে বই প্রকাশ করেন। যিনি কিছু লেখেন, পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন তিনি স্বভাবতই আশা করেন সেটা প্রকাশিত হোক। এবং যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকাশিত হোক। বই লেখার পরে, অনেক দিন ধরে পড়ে আছে পাণ্ডুলিপি- এরকম হলে সেই লেখক মনে করেন ‘এটা আমার দুর্ভাগ্য, আমাকে কেউ পড়ে না।’ সে কারণেই লেখক উন্মুখ হয়ে থাকে তার পাণ্ডুলিপিটা কখন বই আকারে বের হবে। এভাবেই প্রতি বছর প্রায় চার হাজার বা সাড়ে চার হাজার বই প্রকাশ হয়। এগুলোর ভেতর থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিংবা ষাটটা বই হয়তো প্রথম শ্রেণির হবে। বাকী বইগুলোর এক বছর পড়ে কেউ খোঁজ রাখবে না। এই পরিণতি সেই বইগুলোর ভাগ্যে দাঁড়াবে।
তারপরও একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য চর্চা বাড়ে। লেখকরা চর্চা করে, পাঠক বই কেনেন। যতো রকম পাঠক আছেন, সবার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের বই প্রকাশ হওয়া উচিত। সে বই প্রবন্ধের হোক, কথাসাহিত্য কিংবা কবিতা। সবই পাঠকের জন্য। পাঠক যদি এগুলো না দেখেন বা পড়েন তাহলে সেই লেখকের জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
অপঠিত লেখক যদি বলেন, পাঠক খুব অশিক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তাদের মন গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত নয়। সেগুলো তো ভালো কথা নয়।

 

অনুলিখন : স্বরলিপি




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়