ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পোশাক দেখে লাশ শনাক্ত

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পোশাক দেখে লাশ শনাক্ত

আরিফ সাওন : ঢামেকের মর্গে লাশের ব্যাগ এসে পৌছেছে ৬৭টি। ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, ফায়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছে ব্যাগে একাধিক মরদেহ থাকতে পারে।

গত রাত থেকেই লাশ নেওয়া এবং সনাক্ত করা জন্য স্বজনরা ঢামেকের মর্গ এলাকায় ভিড় করে আছেন। তাদের কান্না আর আহাজারীতে ভারী হয়ে উঠেছে মর্গ এলাকা।

স্বজন মারা গেছে, আর তার মরদেহও পাওয়া যাচেছ না! মরদেহ দেখার জন্য স্বজনদের ঠেলাঠেলি করতে হচ্ছে! ধাক্কা খেতে হচ্ছে! মর্গের সামনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা! সে আরেক ট্র্যাজেডি!

কেউ কেউ অপেক্ষা করেই যাচেছন, ভেতরে লাশ আছে কিনা তাও জানেন না। তবু অপেক্ষা করছেন, মর্গের সামনের ভিড় একটু কমলে ভেতরে গিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন, তার স্বজন আছে কিনা। আবার কেউ মর্গের জানালা দিয়ে আংশিক পোশাক দেখে ধরে নিচেছন ওটাই তার স্বজনের লাশ!

কেউ তার ভাইকে খুজঁছেন, কেউ ভাগ্নেকে, কেউ ছেলেকে, কেউ বন্ধু, মামা কিংবা প্রতিবেশিকে। কেউ চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, আমার ভাইকে দেখবো, আমার ছেলেকে দেখাও। আমার বাবা কোথায়? কেউ কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যাচ্ছেন। কেউ তার স্বজনের নানা স্মৃতি বলেই যাচেছন।

নয়ন; বাবা মায়ের খুব আদরের সন্তান। চার বোনের একটি মাত্র ভাই। সবারই খুব আদরের। ভালোবাসার। আজ নয়নের মামাতো বোন পরীর গায়ে হলুদ আর আগামী কাল বিয়ে। কতো আয়োজন। কাতো দায়িত্ব। বিয়ের কতো কাজ। মামাতো বোনের বিয়েতে যাবে নয়ন। কিন্তু কি হলো! বিয়েতে তার যাওয়া হলো না! লাশ হয়ে শুয়ে আছেন ঢামেকের মর্গে। নয়নের মরদেহ খুঁজতে এসেছেন তার খালা, মামা, মা ও বোনেরা। তাদের আহাজারী অন্যদেরও অন্তরে আঘাত করে। সে কি কান্না! নয়নের খালা বলছেন, আমার বোনটা কিভাবে থাকবে, একটা মাত্র ছেলে। তাকে ছাড়া মায়ের দিন কেমনে কাটবে? বোন বলছে, আমার ভাইরে দেখবো। আমার ভাই কোথায়?

গতরাতে নয়নের শেষ কথা হয় তার বন্ধু সজলের সঙ্গে। রাত ১০টার দিকে। তারপর থেকে নয়ন নিখোঁজ।

নয়নের মামা সমির জানান, তারা নয়নের মরদেহ খুঁজতে এসছেন। বেলা সোয়া দুইটা পর্যন্ত তারা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। জানালার পাশ থেকে একটি মরদেহ দেখে  ৮০ ভাগ ধরে নিয়েছেন ওটাই নয়নের মরদেহ।

তিনি বলেন, ‘নয়ন যে প্যান্ট, বেল্ট ও গেঞ্চি পরা ছিলো। সেগুলো আছে। আর যে গেঞ্জিটা গায়ে ছিলো তাতে একটা মনোগ্রাম ছিলো। তাও দেখেছি। গায়ের রংও ঠিক আছে।

বেশিরভাগ মরহেদ এমনভাবে পুড়েছে যে, চেহারা দেখে বোঝা মুশকিল। তাই বেশির ভাগ লাশ শনাক্ত করা হচেছ পোশাক কিংবা হাতের আংটি, গলার চেইন, ব্রেসলেট, ঘড়ি কিংবা ক্ষেত্র বিশেষ গায়ের ‘বিশেষ চিহ্ন’- এসব দেখে।

কেউ কেউ স্বজনের ছবি, জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে মর্গের সামনে ঘুরছেন, আর স্বজনকে খুজঁছেন। দুপুরের দিকে মামা মো. ফয়সালকে খুঁজতে আসেন ভাগ্নে রফিকুল ইসলাম। তিনি ছবি আর জাতীয় পরিচয় পত্র হাতে উঁচু করে দাঁড়ান মর্গের পাশে। ছবি দেখান সাংবাদিকদের।

কারো শেষ কথা হয় বোনের সঙ্গে, কারো মায়ের সঙ্গে, কারো বা স্ত্রীর সঙ্গে। কেউ গিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবেন। কিন্তু কি হয়েছে? ওষুধ কিনতে গিয়ে হয়েছেন লাশ।

আহসানউল্লাহ (৩৫) দুই সন্তানের বাবা। স্ত্রী সন্তান ও তার বাবা মা গ্রামে থাকেন। তাদের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। তিনি শেষ কথা বলেন বাড়িতে তার স্ত্রী মনু বেগমের সঙ্গে। তাকে জানান, তিনি ফার্মেসিতে অষুধ কিনতে যাচেছন। এরপর থেকে আর খোঁজ নেই আহসানউল্লার। অবেশেষে খোজ মিলল মর্গে। বৃহস্পতিবার দুপুরে শার্ট আর লুঙ্গি দেখে তার মরদেহ সনাক্ত করেন তার ভাই আনোয়ার হোসেন। আহসানউল্লার বাড়িতে দুপুর পর্যন্ত কেউ জানে না যে, তিনি আর বেঁচে নেই। বাড়িতে কিভাবে জানাবেন ভাবছেন তার খালাতো ভাই পলাশ। তিনি বলেন, ‘খালু খুব বয়স্ক। তিনিও অসুস্থ। তাকে এই খবর দিলে তিনি কীভাবে সামলাবেন বুঝতে পারছি না।’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আরেক নিহতের নাম মোশারফ হোসেন বাবু (৩৫)। তার মরদেহ শনাক্ত করেছেন তার ভগ্নিপতি নুর হোসেন।

তিনি জানান, মোশারফ সু মেটারিয়াল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করতেন। কাজ শেষে এক ফ্যাক্টরিতে যাচিছলেন। ওই সময়েই সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। তিনি ও তার বন্ধু এক রিকশায় ছিলেন। ঘটনাস্থলেই মোশারফ ও সেই রিকশাচালক মারা যান। তবে মোশারফের বন্ধু বেঁচে আছেন। তিনি ঢামেকের বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন। মোশারফের দুটি মেয়ে আছে। একজনের বয়স ৭ বছর আরেক জনের ৫ বছর। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে তিনি ধানমন্ডী এলাকায় থাকতেন।

মর্গের সামনে শুধু স্বজনরাই নন, এসেছেন উৎসুক জনতাও। নাজির উদ্দিন রোড থেকে এসেছেন মো. মুনসুর ও মো. মাকসুদ নামের দু’জন।

তারা বলেন, আগুনের যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ঘটেছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে। তাই এই বিষয়টি আমলে নেওয়া দরকার। বাসা বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, হোটেলে দুর্ঘটনা ঘটছে। রাস্তায় ঘটছে। এখন যে অবস্থা দেখছি তাতে কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। বেশিরভাগ গাড়িতে সিলিন্ডার। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমরা সিলিন্ডারের নামে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ঘুরে বেড়াচিছ। তাই সিলিন্ডার যাতে নিরাপদ হয় সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

এই দুর্ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে অনেকে অনেক মন্তব্য করছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সাংবাদিকদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।

বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সভাপতি আহাদ উদ্দিন হায়দার তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে বড় প্রাণনাশী দুর্ঘটনাগুলো প্রমাণ- উদ্ধারকাজে তিন প্রতিবন্ধকতা: সরঞ্জাম ও দক্ষতার অভাব, কৌতুহলী জনতা ও খবর সংগ্রহের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।’

এই স্ট্যাটাসের কমেন্টে বিডিনিউজের বাগেরহাট প্রতিনিধি অলীপ ঘটক লিখেছেন, ‘বড় কোন ঘটনা ঘটলে গনমাধ্যম হাউজগুলো খবর সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। কে আগে কোন অজানা তথ্য মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেন। কোন গনমাধ্যম কত ভাল খবর তুলে আনতে পারে সেই প্রতিযোগিতার কারণে উদ্ধার কাজ বিঘ্নিত হয়। যা খুবই দুঃখজনক। আগে খবর সংগ্রহ জরুরী নাকি মানুষের প্রাণ বাঁচানো। আমরা সাংবাদিকতা করছি, নিয়মনীতির কথা বলছি কিন্তু তার তোয়াক্কা কি করছি? তাই গনমাধ্যম হাউজগুলো এসব বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হবে বলে প্রত্যাশা করি।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়