ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দুর্গোৎসবের ধর্ম-দর্শন ও সমাজ-দর্শন

প্রদীপ অধিকারী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্গোৎসবের ধর্ম-দর্শন ও সমাজ-দর্শন

প্রদীপ অধিকারী : শারদীয় দুর্গাপূজা শুধুই পূজা নয়, এটি উৎসব, দুর্গোৎসব। যেমন বিজয় উৎসব, বৈশাখী উৎসব। রাজনৈতিক দর্শন, সমাজ দর্শন, ধর্ম দর্শন ইত্যাদি অনুঘটক দ্বারা উদ্ভূত এই সকল উৎসব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সর্বোপরি সৃজনশীলতার আবহে মানবিক গুণাবলী অর্জনের পাদপীঠ। অপরাপর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্ম দর্শন মূখ্য হলেও দুর্গোৎসবের ক্ষেত্রে গৌণ, সমাজ দর্শনই প্রবল ভাবে প্রতিভাত।

কম্পিউটার যন্ত্রটি যেমন গণনা যন্ত্র হিসেবে জন্ম হলেও এর পরিব্যাপ্তি এত বিশাল হয়েছে যে গণনা কাজটি বাদ দিলেও এর কোন ক্ষতি হবে না, তেমনি শত শত বছর পরিশীলনের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলী অর্জনের যে কাঁচামাল (Rwa materials) এতে সম্পৃক্ত হয়েছে তাতে দুর্গোৎসব থেকে ধর্ম দর্শনটুকু ছেটে দিলেও এর কোন ক্ষতি হবে না। সমাজ দর্শন থেকে সম্পৃক্ত হয়েছে, সমাজের শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, লিঙ্গগত-সম্প্রদায়গত দৃষ্টিভঙ্গি, শিল্প-সৌন্দর্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সম্পদ-পরিবেশ, শৌর্য-বীর্জ, দান-ধ্যান, দায়-দায়িত্ব, শ্রদ্ধা-ভালবাসা, হাসি-কান্না, বিরহ-বেদনা , রাজনীতি-সমাজনীতি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর্থসামাজিক যোগসূত্র, সর্বোপরি সম্পৃক্ত হয়েছে সৃজনশীলতা সমৃদ্ধ জীবনাচরণের সার্বিক উপকরণ। দুর্গোৎসবের ব্যাপ্তি শুধু ধর্মীয় আচারে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সৃজনশীলতার গ্রিন হাউজ।

বিশ্বাস সৃজনশীলতার প্রতিবন্ধক, ফলে শুধু বিশ্বাস নির্ভর, পারলৌকিকতা নির্ভর ধর্মীয় আচার চিন্তা-মননে পেন্ডুলামের মত এককেন্দ্রিক গতির সৃষ্টি করে। জন্ম নেয় বুদ্ধি স্থবিরতা। চেতনার বোধিসত্তা তার বৈচিত্র হারিয়ে হয়ে উঠে ধু-ধু মরুভূমির মত। জন্ম নেয় উগ্রতা-হিংস্রতা পরাভূত হয় মানবতা। ভীরুতার ভেতর থেকে জন্ম নেয় বৈরাগ্য যা আত্মশক্তির সমাধিস্থল। দুর্গাপূজা উগ্রতা ও বৈরাগ্য বর্জিত। এর শৈল্পিক দিক ও সৃজনশীলতায় অংকুরিত হয় উদারতা, বিবেক জাগ্রত হয়, মনুষ্যত্ব ফুটে উঠে। বোধিসত্তা পল্লবিত হয়, বিকশিত হয়, সৃষ্টি হয় মুক্তবুদ্ধির পুষ্পবিথী।

দুর্গাপূজা ইহলৌকিক। দুর্গার নিকট ভক্তদের সকল প্রার্থনাই ইহলৌকিক। শাস্ত্রমতে দুর্গার ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও আ-কার ভয় ও শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রু থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। প্রতিটি বৈশিষ্টই জাগতিক এবং নৈমিত্তিক যেখানে পারলৌকক লোভ বা স্বর্গপ্রপ্তির কোন উপকরণ নেই। সৃজনশীলতা ও ইহলৌকিকতার সমন্বয়ে দুর্গোৎসব মানবিক গুণাবলী অর্জনের মহাবিদ্যালয়। এর উপকরণ সমূহ দ্বারা প্রতিটি মানুষ আবিষ্ট বা আন্দোলিত হতে বাধ্য, ফলে শ্রেণি-গোত্র, ধর্ম-বর্ণ, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, শিশু-বৃদ্ধ, পৌত্তলিক-অপৌত্তলিক নির্বিশেষে এর মায়াময়তা দ্বারা, এর সৌন্দর্যবোধ-শিল্পবোধ-বীরত্বগাথা দ্বারা, এর গীত-বাদ্য-নৃত্য দ্বারা, ‘যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ বলিষ্ঠ উচ্চারণ দ্বারা বিমুগ্ধ হয়, মানব সত্তার উপস্থিতির কারণে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় একাত্ম হয়। আর তাই এ উৎসব সর্বজনীন।

পৌত্তলিকতার অজুহাতে যারা দুর্গোৎসবকে প্রতিবন্ধী মনে করেন, তারা শিক্ষাকে সহজ করার জন্য শিক্ষা-উপকরণ ব্যবহার করেন, কলস থেকে জল খাওয়ার জন্য ঠিকই গ্লাস ব্যবহার করেন। প্রকারান্তরে ও পৌত্তলিকতা বিরোধীদের অন্তর-দৃষ্টিই প্রশ্ন সাপেক্ষ, যার ফলে রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মগণের পৌত্তলিকতায় আপত্তি তাদের জন্যই বিপত্তির কারণ হয়েছে, পৌত্তলিকতার গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি।

দুর্গার বর্তমান পূজিত রূপটি রণাঙ্গিণী বেশে। শ্রীশ্রী চণ্ডীর মহিষাসুর বধের অবয়বে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ের অবকাঠামোতে। সমাজ কাঠামোতে এ যুদ্ধ নিরন্তর। এমন কী আমাদের দেহ কাঠামোতেও। আমরা প্রতি নিঃশ্বাসে শুভ শক্তি গ্রহণ করছি অশুভ শক্তি বর্জন করছি। সমাজ গর্ভে পরিপূরক শক্তি সংরক্ষণ এবং প্রতিবন্ধক শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে চলমান, মানুষের সৃজনী শক্তি অর্থাৎ স্নায়ুশক্তিই এর প্রধান নিয়ামক। এমন কী স্নায়ু শক্তি দ্বারা পেশি শক্তির প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চলমান। অশুভ বিনাশী এ যুদ্ধে দেবীর সঙ্গে রয়েছেন গণেশ। পুরাণ মতে যিনি গণশক্তি এবং কার্যসিদ্ধির দেবতা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রশ্রিত অশুভ শক্তি বিনাশে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি। গণেশের বাহন মুষিক। ইঁদুর ব্যক্তির কর্মফল হরণ করে। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি হতে হবে ব্যক্তিস্বার্থ বর্জিত। এ যুদ্ধে দেবীর পাশে রয়েছেন লক্ষ্মী। বৈষয়িক ধনৈশ্বর্য ও চারিত্রিক ধনৈশ্বর্যের প্রতীক যা যুদ্ধ জয়ের মৌলিক উপকরণ। নির্মল প্রস্ফুটিত পদ্মকুসুমে উপবিষ্ট এই দেবীর বাহন পেঁচক। দিবান্ধ, নিশাচর প্যাঁচা। সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্য প্রয়োজন নির্জনতা, লোকচক্ষুর অন্তরাল, যার প্রতিফলন তাবৎ মহামনিষীগণ।

পাশে রয়েছেন সরস্বতী। জ্ঞান-শক্তির প্রতীক। জীবের সার্বিক জীবনাচরণের নিয়ন্ত্রক। পাণিতে পুস্তক-বীণা, শ্বেত-শুভ্রতায় বিকশিত সংগীত-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শুচিতা। বাহনে শ্বেত-হংস। হংস যোগ-সাধনার প্রতীক, জ্ঞান চর্চার অনিবার্য নিয়ামক। সঙ্গে রয়েছেন সেনাপতি কার্তিক। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক, রণাঙ্গনের প্রত্যক্ষ শক্তি। বাহনে ময়ূর, শৌর্যের সঙ্গে সৌন্দর্যের সেতু বন্ধন। দেবীর পূজিত রূপের প্রতিটি আঙ্গিকে প্রস্ফুটিত সমাজ দর্শন।

দেবী জগতমাতা, মহামায়া। যে মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ অনন্ত চরাচর, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা। এই মায়ার বাঁধনেই মানুষ সংসার বাঁধে, পাখিরা বাসা বাঁধে। এই বন্ধনের স্পন্দনেই উচ্চারিত হয়, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ তিনি সর্বভূতে মাতৃরূপে বিরাজমান, যে মাতৃত্ব বাঘিনীকে করে স্নেহ দায়িনী, যে মাতৃত্বে নিজের জীবন উৎসর্গ করে মাকড়সা সন্তান জন্ম দেয়। দেবী প্রণামে উচ্চারিত হয়, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ , সর্বভূতে শক্তিরূপে বিরাজমান, পরমাণুর কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তুকণাই সহজাত শক্তির বন্ধনে আবদ্ধ।

দুর্গাপূজার ধর্ম দর্শনের তাবৎ উচ্চারণ সমকালীন জ্ঞান দর্শনের প্রতিফলন। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পারস্পরিক শ্রদ্ধামূলক নয়, রিপু-তাড়িৎ, প্রভুত্বমূলক। যার ফলশ্রুতি নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যা-নৃশংসতা। ধর্ম দর্শনে দুর্গার প্রতি মহিষাসুরের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিরূপ। ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর পুরুষ কর্তৃক অবধ্য, অর্থাৎ কোন পুরুষ তাকে হত্যা করতে পারবে না। বর্তমানেও নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি, পুরুষ কর্তৃক অবধ্য। জেগে উঠতে হবে নারীকেই। ত্রিনয়নী দশভুজা দুর্গার ন্যায় আদ্যাশক্তি নিয়ে জেগে উঠতে হবে। কৃষিভিত্তিক সমাজে একজন পুরুষ দুই হাতে যে পরিমাণ কর্ম সাধন করে, একজন নারী তার পাঁচগুণ কর্ম করে, প্রতীকী অর্থে প্রতিটি নারীই দশভুজা। দুর্গার তৃতীয় নয়নে নির্গত জ্যোতির ন্যায় সিঁথীতে ধারণ করতে হবে শস্ত্র। মনে রাখতে হবে পৃথিবী এখন আর বাহুবল ভিত্তিক নয়। দুর্গার ত্রিশুলের ন্যায়, চক্রের  ন্যায় ধারণ করতে হবে লেসার গান, প্লাজমা গান, ব্লাস্টার। বধ করতে হবে আজকের মহাসুর ইভটিজারদের। যেমন কুপ্রস্তাব দেয়ার শাস্তিস্বরূপ চমুণ্ডাকে বধ করে দেবী চামুণ্ডা নাম ধারণ করেছিলেন [মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীমাহাত্ম, পঞ্চম অধ্যায়]।

শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের যুদ্ধে রক্তবীজ নামে অসুরের রক্ত মাটিতে পড়লে লক্ষ অসুর জন্ম নেয়। অর্থাৎ আসুরিক শক্তির সংস্পর্শ লক্ষ আসুরিক শক্তি জন্ম দেয়। দেবী কালীর সহযোগিতায় অসুরের রক্ত মাটিতে পড়ার আগে, নিজেই পান করে রক্তবীজকে বধ করেন। সমাজ দর্শনে দুর্গোৎসব নারী শক্তি ও নারী মুক্তির মহীসোপান। নারী মুক্তির বোধকে বিবেকজাত করার জন্য কুমারীর প্রতি মাতৃত্ববোধ জাগ্রত কবার জন্য দুর্গা পূজার বিধিতে মহাঅষ্টমী তিথিতে সস্পৃক্ত হয়েছে কুমারী পূজা।

সম্পদ-প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণের অধিবিদ্যায় পূজার বিধিতে সপ্তমী তিথিতে রয়েছে মহাস্নান। দেবীর প্রতিবিম্বকে স্নানের এই অয়োজনে প্রয়োজন হয় শুদ্ধজল, নদীর জল থেকে শুরু করে সমুদ্রের জল, ফুল-জল থেকে ঝরনা জল, রাজদ্বার মৃত্তিকা থেকে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, ব্যবহার হয় প্রকৃতির বিচিত্র উপকরণ যা প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি সম্পদ, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, জলজ সম্পদ, প্রাণিজ সম্পদ, ভুমি সম্পদ সংরক্ষণের প্রেরণা। সর্বোপরি এই বিধান পরিবেশ সংরক্ষণের বিশ্বদর্শন।

দুর্গোৎসবের সমাজ দর্শনের সমন্বয়ক উপকরণটি হচ্ছে এর আর্থসামাজিক বিন্যাস। ব্রাহ্মণ-চাষি-মালি থেকে শুরু করে কুম্ভকার-তাঁতী-গোয়ালা পর্যন্ত সমাজের সকল পেশার মানুষ আর্থিকভাবে এই মহোৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততার ফলেই উৎসবটি হয়েছে সর্বকালীন।

সর্বোপরি দুর্গোৎসব কাঠামো-অবয়বে, বিধি-বিধানে, আচার-উচ্চারণে বিশ্ব-কল্যাণের পূর্ণাঙ্গ সমাজ দর্শন।

 

লেখক : কলামিস্ট। সভাপতি, হিন্দু কল্যাণ সংস্থা, টঙ্গী থানা শাখা, ঢাকা।

[email protected]



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়