ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কাল্পনিক ভূত-প্রেতের গল্পের অবসান হোক: শেষ কিস্তি

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫২, ১০ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাল্পনিক ভূত-প্রেতের গল্পের অবসান হোক: শেষ কিস্তি

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক: প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি, ভূত-প্রেত আসলে মনগড়া তথা কাল্পনিক গল্প। জ্বীন-পরী, ভূত-প্রেত ঠিক বয়ঃসন্ধিকালে ধরে থাকে বলে শুনেছি। যারা এর শিকার হয়েছেন তাদের সঙ্গে যদিও আমার কথা হয় নি, তবু বলছি সত্যিই যদি জ্বীন-পরী, ভূত-প্রেত থাকতো তাহলে এই সময়েই কি বেছে বেছে মানুষকে আক্রমণ করতো? আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে- ছোট বাচ্চা আর বড়দেরও কী জ্বীন-পরী ধরে? এই ব্যাপারটা আমি কখনও দেখেছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ব্যাপারটা হলো বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা।

১১ হতে ১৪ বছর বয়সের পর থেকে সকলেরই কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যা পাঠ্যপুস্তকে আমরা পড়েছি। এছাড়াও অনেকের আচার-আচরণে বেশ পরিবর্তন আসে। যেসব আচার-আচরণ ওভারঅ্যাঙ্কশাস ডিসঅর্ডার, চাইল্ডহুড সিজোফ্রেনিয়া, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এবং আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদি নামে নামকরণ করা হয়েছে। যা পরের অনুচ্ছেদে বর্ণনা দেয়া হলো। ঐ সময়টাতে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের অনেকেই জানে না যে, এ ধরনের ক্রাইসিসগুলো কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়। কেউ বুদ্ধি করে পেরে ওঠে, আবার কেউ ঐসব সমস্যার ব্যাপারে গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তখন একা একা আনমনে চিন্তা করে। নির্জন স্থান, অন্ধকার জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, নানা ভাবনা ভাবে। কেউ আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপচাপ একান্তে মনে মনে আজগুবি সব কল্পনা করতে থাকে। অনেকে আবার দুষ্ট ছেলেমেয়েদের পাল্লায় পড়ে গোলক ধাঁধায় পড়ে। সে সময় বড়রা বারবার তাকে জিজ্ঞাসা করার কারণে ঐ সময় তারা কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না। আর তখনই নানা-নানী, দাদা-দাদীদের জ্বীন-পরী আর ভূত-প্রেতের কথা মনে পড়ে যায়। তখন অভিভাবকদের বারংবার প্রশ্ন করার হাত থেকে বাঁচার জন্য সে বলে যে, তাকে জ্বীন-পরী অথবা ভূত-প্রেতে ধরেছে। লোকসমাজে তখন তাঁকে ভূতে ধরেছে বলে প্রচার করা হয়। এর সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো, ঐ সময়টাতে যে কোনো ধরনের সমস্যা হলে আপনজনকে দুশ্চিন্তার কারণ খোলামেলাভাবে বলা। যারা সিনিয়র তাঁরা প্রায় সবাই তখন সৎ উপদেশ দিতে পারবেন।

শৈশব বা বয়ঃসন্ধিকালের এক প্রকার গোলযোগ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এরূপ কোনো বিষয় সম্বন্ধে অতিরিক্ত চিন্তিত বা ভীত থাকে। এই অবস্থাটিকে ওভারঅ্যাঙ্কশাস ডিসঅর্ডার বলে। আবার বয়ঃসন্ধি শুরু হবার কিছুদিন আগে থেকে অনেক ছেলেমেয়ের এ জাতীয় মানসিক বিকৃতির লক্ষণ দেখা যায়। তখন ছেলেমেয়েরা নিজের মাকে চিনতে পারে না। অন্যের সঙ্গে অসঙ্গত ব্যবহার করে থাকে এবং শারীরিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না। এই অবস্থাটিকে চাইল্ডহুড সিজোফ্রেনিয়া বলে। বয়ঃসন্ধিকালে অনেক সময় ছেলেমেয়েদের মধ্যে লজ্জাভাব দেখা যায় না, এবং নিজের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব দেখা যায় অর্থাৎ নিজের পরিচয় সম্পর্কে সন্ধিহান থাকে। এটি আসলে একপ্রকার মানসিক গঠন সম্পর্কিত গোলযোগ। যাকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বলে। আবার অনেক সময় বয়ঃসন্ধিকালের শেষ দিকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক প্রকার মানসিক অবস্থা দেখা যায়। তারা সর্বদা নিজেদের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আতঙ্কিত থাকে। নিজেদের ভবিষ্যতে কী হবে এই চিন্তায় সর্বদা চিন্তিত হয়ে থাকে। এই জাতীয় অবস্থাকে আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার বলে।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা না জেনে কিছু কিছু অনিয়ম করে। যেমন মাদকদ্রব্য সেবন, শরীরের উপর নানা অত্যাচার ইত্যাদি। ঐ সময়টাতে ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিক খাবার না খেয়ে আজে-বাজে খাবার খায়। যা করা একেবারে উচিত নয়। আমাদের শরীরের রক্ত, পেশী, স্নায়ু, মস্তিষ্ক কোষ ও কোষ মধ্যে এমন কিছু উপাদান তথা খনিজ লবণ আছে যা নানা অনিয়মের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। আর এই হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে আমাদের শরীরে নানা ধরনের বিপত্তিও ঘটে থাকে। মানসিক দিক থেকেও নানা সমস্যা তৈরি হয়। রাত হলে আজগুবি সব ভয়-ভীতি এসে হাজির হয়। সব সময়ই কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটবে বা ঘটতেছে এমন মনে হয়। উৎকণ্ঠা হয়।  রাতে ঘুম ভাঙলে ঘরের আসবাবপত্রকে মানুষ বলে মনে হয় ও তাতে ভয় হয়। স্নায়বিক দুর্বলতার কারণে আসলে এ ধরনের ভয়-ভীতির উদ্রেক হয়। যারা বেশি বেশি ঘামে তাদের এই প্রবণতাটা বেশি থাকে। ঘাম বেশি হলে শরীর ও মন নিস্তেজ আর দুর্বল হয়। তাই বয়ঃসন্ধিকালে এ থেকে সবার সচেতন থাকা উচিত।

শুধু কী তাই, বয়ঃসন্ধিকালের পরেও অনেকের অনেক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। এই তো সেদিন একটা অন্যরকম বাস্তব কাহিনি পড়লাম। কাহিনিটা হলো- একটা প্রতিবাদী মেয়ে বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িতে গিয়েই বাকরুদ্ধ  হয়ে পড়ে। তাতে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েন। শ্বশুরবাড়ি আসার পরেই এ অবস্থা, তাতে শ্বশুরবাড়ির লোকজনও ভয় পেয়ে যায়। মেয়ের বাড়ির লোকজনও এজন্য তাঁদের দোষারোপ করে। ব্যাপারটা কেন ঘটলো তা কিছুতেই ধরা পড়ে না। এমন মুহূর্তে ডাক্তার কৌশলে ঐ মেয়েটাকে নানা কিছু জিজ্ঞাসা করেন। এতেই তার জবান খুলে যায়। তখন সে বলে যে, বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এসে ঐ বাড়ির লোকজন তার বাবা-মা সম্পর্কে অশালীন কথা বলেছে এবং কটূক্তি করেছে। কিন্তু সে তার প্রতিবাদ করতে পারে নি। কারণ, তার মা তাকে শপথ করিয়েছে যে, শ্বশুর বাড়িতে যাই ঘটুক তা যেন সে মুখ বুঝে সহ্য করে। প্রতিবাদী মেয়েটি বিষয়টি মেনে নিতে পারে নি। আর তাতেই তার মানসিক অবস্থা পাল্টে গিয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো।

কেউ কেউ আবার মানুষ মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ দেখে ভয় পায়। খারাপ অথবা ভালো যে যাই হোক না কেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন কেউ পৃথিবীতে ফিরে আসেন না। যদি ধরেও নিই যে, ফিরে আসে তাহলে জীবিত অবস্থায় যে কারো কোন ক্ষতি করে নি, তিনি মারা গেলে কীভাবে অন্যের ক্ষতি করবে? এই দেখুন না বাঘ-ভাল্লুক, সাপ জীবিত অবস্থায় মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে, জখম করতে পারে অথবা মেরে ফেলতে পারে। অথচ বাঘ-ভাল্লুক, সাপ যখন কারো সামনে মরে পড়ে থাকে তখন কী কেউ তাকে দেখে ভয় পায়। একদমই না। বিষয়টা সেভাবে ভাবলেই এই অমূলক ভয় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। কিন্তু এ নিয়ে আমরা কখনও একবারও ভেবে দেখি না। মনের ভয় দূর করার জন্য ব্যাপারটা আসলে খুবই মনোযোগ সহকারে ভেবে দেখা উচিত।

অনেকে আবার কবরস্থান দেখে ভয় পায়। কিন্তু কেউ কেউ বলেন যে, কবরস্থান হলো নিরাপদ জায়গা। এখানে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। আমার এক চাচীর বোন সম্পর্কে আমার খালা তিনি তাঁর স্বামীর অত্যাচারের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য একটা কবরের মধ্যে তিন দিন তিন রাত লুকিয়ে ছিলেন। তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, তিনি কবরে থাকার সময় ভয় পেয়েছিলেন কি-না। উত্তরে বলেন যে, তাঁর ভয় হয় নি। বরং তাঁর স্বামী যে তাঁকে তাড়া করেছিল সে তাড়াকেই তাঁর বেশি ভয় লেগেছিল। তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে, যদি তাঁর স্বামী ধরতে পারতো তাহলে তাঁকে মেরে ফেলতো। তাছাড়া, অনেক কবরস্থানে ২/৪ জন লোককে ডিউটিতে রাখা হয়। তারা তো ঠিকঠাক মতো ডিউটি করে যাচ্ছেন। কই তাঁরা তো কখনও এসব ভয়-টয় পান না। করবস্থানে আসলে কেউ উচ্চবাচ্য করেন না, হৈ চৈ নেই, সে কারণে নীরব মনে হয়। আর তাতেই মনে হয় যে না জানি কী? আমি একবার আজিমপুর কবরস্থানে সাহস করে ঢুকে ব্যাপারটা যাচাই করে দেখেছি। এক্ষেত্রেও মৃত মানুষ আর বাঘ-ভাল্লুক এবং সাপের ঐ গল্পটা প্রযোজ্য। কারো মনের ভেতরে দুর্বলতা লুকিয়ে থাকলেই এমনটা হয়। ব্যাপারটা আসলে তেমন কিছুই নয়।

আমার আব্বা একদিন আমাদের একটা ভয়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। একদিন তিনি আমাদের বাড়ির পাশে একটা অব্যবহৃত রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকের একটা জমিদার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি রাস্তার পাশে একটা ঝোঁপে দেখতে পেলেন যে, কেউ একজন দূর থেকে তাঁকে সামনে এগুতে নিষেধ করছেন। কিন্তু তিনি ভয় পাবার ব্যক্তি ছিলেন না। তাই সাহস করে কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, আসলে সেটি আর কিছু নয়, একটা কচু পাতা বাতাসে দোল খাচ্ছে। এছাড়া, আমার এক বিজ্ঞান স্যার ক্লাসে একদিন গল্প বলছিলেন যে, ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। বিজ্ঞানমনস্করা বরাবর যা করে থাকেন তিনিও তার অন্যথা করেন নি। তিনি বলছিলেন যে, ভূত-প্রেত আসলে মানুষের মনের কল্পনা। একটা ঝোঁপে একটু আগুনের ফুলকি দেখলেই অনেকে মনে করেন যে, ঐ ঝোঁপে ভূত না হলে প্রেত আছে। ঝোঁপ-ঝাড়ে আসলে অনেক সময় জৈব গ্যাস তৈরি হয়। তা থেকে অনেক সময় ধোঁয়া বের হয়। কেউ যদি আবার তাতে সিগারেট বা বিড়ির আগুন ফেলে দেয় তা থেকে আগুন ধরে যায়। দূর থেকে তাই দেখে অনেকে জ্বীন-ভূত বলে মনে করেন, এই আর কী। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে দেখেছি যে, ব্যাপারটা আসলেই তাই। ভূত-প্রেত বলে পৃথিবীতে কিছুর অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মনে ভূত-প্রেতের ভয় ঢুকিয়ে দেয়া অনুচিত। এতে করে শিশুরা দুর্বল মন নিয়ে বড় হয়। তা থেকে সারাটা জীবন তারা ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে দেয়। এসব ভয় দেখিয়ে সুবিধা হয়েছে কি-না জানি না, তবে ক্ষতির পাল্লা অনেক ভারি। শৈশবে যদি এই ভয় জেঁকে বসে তাহলে তা থেকে একটা স্থায়ী মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে করে একা থাকতে ভয়, রাতের অন্ধকারে ইত্যাদি সমস্যা আমৃত্যু চলতে থাকে। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। আজ থেকে শিশু-কিশোরদের মনে ভূত-প্রেতের ভয় ঢুকিয়ে দেয়া গল্পের অবসান হোক। বাকি সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হোক পৃথিবীতে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই।

আজ ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’। লেখাটি মূলত শিশু-কিশোর এবং এই দিবসকে কেন্দ্র করে লেখা। কারণ, আমি মনে করি ভূত-প্রেতের ভয় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যা লেখাপড়া, কাজকর্ম থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব পড়ে। যে ক্ষতি পরবর্তীতে অনেক সময়ই পুষিয়ে নেয়া যায় না। এর নিষ্পত্তি ঘটা জরুরি। আর ভূত-প্রেতের গল্প নয়, তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে অনেক অনেক লেখার আছে তা নিয়ে লিখুন। শিশু-কিশোররা একান্তে কম্পিউটার, রোবট ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে শিখুক। তা থেকে শিশু-কিশোররাও উপকৃত হবে, তা থেকে সমাজ এবং দেশও অনেক উপকৃত হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়