ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মূখ্য হোক অসুর বিনাশের প্রতীকী রূপ || রুমা মোদক

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ১০ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মূখ্য হোক অসুর বিনাশের প্রতীকী রূপ || রুমা মোদক

পৃথিবীর অধিকাংশ সভ্যতা মূলত নদীকেন্দ্রিক। যেমন সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা, নীল নদের তীরে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউরিপেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। এই ভারতীয় উপমহাদেশ নামে খ্যাত বর্তমান ভূ-খণ্ডটি মূলত সিন্ধু সভ্যতার অপর নাম। সিন্ধু নদীর তীরবর্তী সভ্যতা পরিচিত ছিল ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামে। আর এর অধিবাসীরাই পরিচিত হিন্দু নামে। মূলত ‘হিন্দু ধর্ম’ কোনো বিশেষ ধর্মের নাম নয়। এটি কোনো প্রবর্তক কর্তৃক প্রবর্তিত কোনো বিশেষ ধর্ম নয়। প্রচলিত ধর্মগুলির প্রত্যেকটির একজন প্রবর্তক আছেন, আছে নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি ও আচরণ। সিন্ধু নদী তীরবর্তী সিন্ধু সভ্যতায় নানা মত ও নানা পথের সংমিশ্রণ ঘটেছে। গড়ে উঠেছে নানা দর্শন। ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পরা এই সভ্যতার উত্তরাধীকারীরা নানা দেব-দেবীর উপাসক হয়ে উঠেছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর ভারতীয় অংশে সিংহবাহিনী নারী দেবী দুর্গার আবির্ভাব বৈদিক যুগের পরে। কৃষিজ সভ্যতা ধারণকারী সিন্ধু সভ্যতার বুক চিরে যখন এশিয়া মাইনর এলাকা থেকে আর্য সভ্যতার পশুপালক অধিবাসীদের অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন অনার্য দেবদেবীদের সাথে আর্য দেবদেবীদের মিথস্ক্রিয়ায় এক পর্যায়ে দশভূজা দেবীর আবির্ভাব। আর্যদের আগমনের পূর্বে এই উপমহাদেশে প্রাপ্ত হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার দেবীমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেলেও তা সিংহবাহিনী দেবী দুর্গার সাথে কোনো মিল নেই। মূলত দেবী দুর্গার প্রভাবশালী আবির্ভাব ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও শ্রীশ্রী চণ্ডীতে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়। উল্লেখ আছে সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুন্ঠের আদি বৃন্দাবনে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। একই পুরাণ মতে মধু ও কৈটভ দুই অসুর নিধনে ব্রহ্মা দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপর শিব ত্রিপুর নামে এক অসুরের সাথে যুদ্ধ করে বিপদে পড়ে তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেন। দুধাসা মুনির অভিশাপে ইন্দ্র চতুর্থবারের মতো দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। দেবী ভগবত পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। দেবি দুর্গার আশীর্বাদে তিনি কাম-ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হন।

দেবী দুর্গার আবির্ভাব ও পূজাকে কেন্দ্র করে যতোগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনি শ্রীশ্রী চণ্ডীর। চণ্ডীর দুর্গাসংক্রান্ত কাহিনিগুলো বিশ্বাসীদের কাছে এতোই গ্রহণযোগ্য যে, চণ্ডীপাঠ দুর্গাপূজার একটি আবশ্যকীয় অংশ। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে গ্রন্থিত রয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণের নির্বাচিত কিছু অংশ যাতে দেবী দুর্গা সম্পর্কিত তিনটি উল্লেখযোগ্য কাহিনি রয়েছে। প্রথম কাহিনিতে দেখা যায়- একবার যুদ্ধে পরাজিত হলে ধার্মিক রাজা সুরথ লক্ষ্য করেন তাঁর প্রিয় অমত্য সভাসদরা সবাই তাঁর পক্ষ পরিত্যাগ করে বিজয়ীদের পক্ষাবলম্বন করেছে। এতে তিনি মনের দুঃখে-ক্ষোভে বনে গমন করেন ও মেধা মুনীর (পক্ষান্তরে মেধস মুনী) আশ্রমে আশ্রয় নেন। সেখানে তার সাথে দেখা হয সারথি, স্ত্রী পুত্র কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে যিনি আশ্রমে এসেছেন। উভয়ে বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলেন, যাদের দ্বারা তারা প্রতারিত হয়েছেন তাদেরকেই কেন তারা ভুলতে পারছেন না? মেধা মুনী তখন তাদের কাছে ব্যাখ্যা করে বললেন, এ সবই ঘটছে মহামায়ার প্রভাবে। মেধা মুনীর আশ্রমে তিন বছর কঠোর তপস্যায় তারা দেবী মহামায়াকে তুষ্ট করেন।

দ্বিতীয় কাহিনিটি সুপ্রচলিত ও জনপ্রিয় মহিষাসুর মর্দিনীর কাহিনি। মহিষাসুর দেবতাদেরকে একশ বর্ষব্যাপী একযুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে বিতাড়িত দেবতাগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে সাথে করে শিব ও নারায়ণের সকাশে গেলেন। তারা মহিষাসুরের বৃত্তান্ত শুনে ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন। সেই প্রজ্জ্বলিত তেজ থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। শিব ও নারায়ণের তেজের সাথে মিলিত হলো অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকে নির্গত সুবিশাল তেজরশ্মি। হিমালয়ে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে নারীমূর্তি ধারণ করল। ফলে দেবী দুর্গার অন্য নাম হলো কাত্যায়নী। প্রত্যেক দেবতা  তাকে অস্ত্র দান করলেন এবং দেবী মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করেন এবং তিনি দশভূজা দেবীরূপে পূজিত হন। শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গা সংক্রান্ত তৃতীয় ও সর্বশেষ কাহিনি হলো শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনি। শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুর স্বর্গ ও দেবতাদের যজ্ঞস্থান ধ্বংস করে দিলে দেবতারা হিমালয়ে গিয়ে বৈষ্ণবী শক্তি মহাদেবীকে স্তব করতে লাগলেন। যা দেবী সর্বভূতেষূ মাতৃরূপেণ সংহিতা... জাতীয় সকল স্তবই এই স্তবসমূহের অন্তর্গত। শুম্ভ নিশুম্ভকে বধ করার জন্য দেবী ব্রহ্মাণী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নরসিংহী, ঐন্দ্রী প্রমুখ রূপ ধারণ করেন। এবং শেষপর্যন্ত কালিকারূপ ধারণ করে রক্তবীজরূপী অসুরদের বধ করেন।

বাঙালির মূল যে ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব, তা মূলত ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের অনুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস তাতে সামান্য পরিবর্তন করে এই অকালবোধনের অংশটি সংযুক্ত করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। শিব রাবণকে রক্ষা করতেন বলে রাবণ অজেয় হয়ে উঠেছিল। পরে ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শিবের স্ত্রী দুর্গার পূজা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই রাবণ বধ সম্ভব। ব্রহ্মার পরামর্শে শ্রীরাম আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে রাম কল্পারম্ভ করেন। ১০৮টি নীলপদ্মে দেবীকে সন্তুষ্ট করার শপথ করেন। পরবর্তী সময়ে একটি ফুল দেবী তাঁকে পরীক্ষাকল্পে সরিয়ে নিলে রাম নিজের চোখ উপড়ে দেবী দুর্গাকে নিবেদন করেন। এতে দেবী দুর্গা তুষ্ট হয়ে রামকে রাবণ বধের বর দান করেন।

মূলত এই জলবেষ্টিত বঙ্গভূমির অধিবাসীরা অনার্য জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাদের কোনো পুরাণ বা পৌরাণিক দেব বন্দনার রীতি ছিলো না। এই নিম্নভূমির মানুষের ধর্মীয় আচরণ ছিলো ব্রত ও উপবাসকেন্দ্রিক। শ্রী রামের এই অকালবোধন কবে থেকে বাঙালির প্রধনতম ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনী পূজা। কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণের নাম উল্লেখ করেন বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলনকারী হিসেবে। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে মোঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংস নারায়ণ খ্যাতি লাভের নিমিত্তে আট লাখ টাকা ব্যয়ে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন। নদীয়ায় ভবানন্দ মজুমদার বড়মিয়ার সাবর্ন রায় চৌধুরী, কোজবিহার  রাজবাড়ি সর্বত্রই মহাসমারোহে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় সার্বজনীন পূজা শুরু হয়। দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি লেখা। যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা সার্বজনীন এসব পূজার সাথে যুক্ত হন। ঢাকার দুর্গোৎসবের ইতিহাস পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনীতে। সেখান থেকে জানা যায় ১৮৩০ সালে সূত্রাপুরে নন্দলাল বাবুর বাড়িতে ঘটা করে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়।

বিশ শতক পর্যন্ত দুর্গাপূজা ছিল পারিবারিক। জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা করতেন। চারদিন ব্যাপী আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে ইংরেজ তোষণ ও এর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। ইংরেজদের আমন্ত্রিত করে নৃত্য-গীত-বাদ্যের বিনিময়ে তাদের সাথে সুসম্পর্ক ঝালাইয়ের কাজটি সম্পন্ন হতো এই পূজাকে উপলক্ষ্য করে। এর ধারাবাহিকতা এখনো পরিলক্ষিত হয় গ্রামে গ্রামে পূজা উপলক্ষ্যে যাত্রাগান, পালাগান ইত্যাদির আয়োজনে।

ধনাঢ্যদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এই পূজা সার্বজনীন মাত্রা লাভ করে ইংরেজ আমলের শেষ দিকে। ইংরেজবিরোধী জাতীয়তাবোধের উন্মেষে দেবী দুর্গা জমিদারদের প্রতিপত্তি প্রকাশের মহোৎসবের মাত্রা ভেদ করে নতুন মাত্রা লাভ করে। হুগলি জেলায় বারোজন বন্ধুর অর্থাৎ বারোজন ইয়ারের একত্রিত হয়ে বারোয়ারী পূজার উদ্ভব। অকাল বোধনের শারদীয় দুর্গোৎসব কালক্রমে আজ বাঙারী হিন্দুর সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সেই উৎসব পূজোর শাস্ত্রীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বর্ণপ্রথার ভেদাভেদহীন উৎসবের রূপ গ্রহণ করেছে। জমিদারের আঙিনা ছেড়ে এ উৎসব উঠেছে সর্বসাধারণের আঙিনায়। স্বজন-পরিজনদের মিলনে উৎসব রঙীন হয়ে উঠেছে উদযাপনের নানা রঙে। পৌরানিক যুগে আবির্ভূতা সিংহবাহিনী অসুরনাশিনী দেবী দুর্গার লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের কাঠামো নবতর ব্যাখ্যায় পুরাকালের পৌরাণিক ব্যাখ্যার উর্দ্ধে ভিন্ন রূপে চমকিত করছে কালের ব্যাখ্যায়। মূলত কালের প্রয়োজনে অলৌকিকতার অতীত এই সম্মিলনের আনন্দই মূখ্য হোক মানুষের জীবনে। মূখ্য হোক অসুর বিনাশের এই প্রতীকী রূপ সময়ের বিবর্তনে নব নব অ-সুরের বিনাশে সুরের আবাহনে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়