ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ এবং একবিংশ শতকের প্রজন্ম

ড. মাহফুজা হিলালী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২১, ৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ এবং একবিংশ শতকের প্রজন্ম

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার


বলবার অবকাশ রাখে না যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলাসাহিত্যের বাতিঘর। আবার এ কথাও ঠিক, জন্ম নিয়েই কেউ অনন্য প্রতিভার অধিকারী হন না। একটি নির্দিষ্ট পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে তাঁকে চলতে হয়। ছোটোবেলার পথপরিক্রমা রবীন্দ্রনাথের জীবনের অনন্য অধ্যায়। কলকাতায় শ্যাকরাগাড়ির যুগে জন্ম হয়েছিল তাঁর; সে সময় মেয়েরা বাইরে আসা-যাওয়া করতো দরজাবন্ধ পালকিতে। সে যুগে যাঁরা যুগের থেকে এগিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের থেকেও বেশি এগিয়েছিলেন; এগিয়েছিলেন ব্যক্তিত্ববোধ, ধর্মবোধ, সমাজবোধ এমনকি রাষ্ট্রবোধেও। এই অনন্য রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলো কোন কারণে তা গবেষণার বিষয় তো বটেই, শিক্ষারও। গবেষণা হয়েছে অনেক; সাহিত্যবোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের উপর আলোচনা করেছেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে জমিদার নন্দন এবং জমিদার হিসেবে উপস্থাপন করতে বেশি পছন্দ করেন। এবং বলতে পছন্দ করেন দুধ-ঘি খেয়ে বড়ো হয়েছেন বলে তিনি বেশ প্রতিভাবান। এ প্রসঙ্গে বলা সঙ্গত, অনেকেই ধনীর নন্দন বটে, তবে কেউই রবীন্দ্রনাথ নন। তাহলে রবীন্দ্রনাথের ভিত গড়ে উঠলো কিভাবে? আজকের সাধারণ মানুষের কাছে সেই বোধ পৌঁছানোর সময় এসেছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এখন শুধু সাহিত্যিকদের বিষয় নন, তিনি সার্বজনীন। তাঁর জীবনধারাও পরিবর্তন করতে পারে অস্থির সময়ের দিকভ্রান্ত মানুষদের।


সকাল দেখে সারা দিনের অবস্থা যেমন অনেকাংশে জানা যায়, তেমনি শিশুর ছেলেবেলায় সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিলে পরবর্তী জীবন গড়ে দেওয়া যায় অনেকাংশে। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার দিনগুলো কেমনভাবে গড়ে উঠেছিল তা দেখবার বিষয়। যদিও রবীন্দ্রনাথের শিশু বয়স চাকরদের মহলে কেটেছে, তবু সেখানে ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিয়মের হস্তক্ষেপ। অবাধ স্বাধীনতা এবং আনন্দের ভেতরেও সূক্ষ্মভাবে শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা ছিল। বাড়িময় একা একা ঘুরে বেড়ানো, একা অথবা সমবয়সীদের সাথে খেলা করা, দুপুরে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন বাড়ির কার্নিশে অথবা গোলাবাড়িতে গিয়ে রোমাঞ্চকর রহস্যময় অনুভূতির স্বাদ নেওয়া, বিদেশি চাকরদের কাছে তাদের অঞ্চলের গল্প শোনা- সবই তিনি করতেন। তবে তাই বলে এটাই তাঁর শিশুবেলার একমাত্র চালচিত্র ছিল না। এর সমান্তরালে চলতো নিয়মের রীতি। স্কুলজীবন শুরুর আগে পর্যন্ত সকালবেলা গুরুমহাশয়ের কাছে পড়া চলতো। সারাদিন চাকররাই তাঁর দেখাশোনা করতো, তাই অনাদরের স্বাধীনতায় মন ছিল মুক্ত। বাগানে ঘোরা, তেতলার স্নানের ঘরে ইচ্ছে মতো জলের কল ছেড়ে স্নান করা কোনোটাতেই বাধা ছিল না। সন্ধ্যায় রেড়ির তেলের ভাঙা সেজের চারপাশে বসে সমবয়সী সবাই রামায়ণ-মহাভারত শুনতেন; আর রাতে ঘুমানোর সময় রূপকথার গল্প শোনা।


রবীন্দ্রনাথ বয়সের একটু আগেই স্কুল শুরু করেছিলেন। এটা ঘটেছিল তাঁর নিজের জেদের কারণেই; বড়োদের সাথে স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরতেন বলে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন অভিভাবকরা। যখন থেকে স্কুল শুরু হলো তখন চললো অন্য নিয়ম। অন্ধকার থাকতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে হতো ‘কুস্তি লড়া’র জন্য। শহরের ডাকসাইটে পালোয়ান ‘কানা পালোয়ান’য়ের সাথে তাঁদের প্যাঁচ কষতে হতো। কুস্তি শেষ করে ঘরে এসে মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রের কাছে শিখতেন মানুষের হাড় চেনার বিদ্যা। দেয়ালে কঙ্কাল ঝুলিয়ে কোন্ হাড়ের কী নাম তা শেখানো হতো শিশুদের। এরপর সকাল সাতটায় শুরু হতো নীলকমল মাস্টারের কাছে গণিত, সাহিত্য, প্রাকৃতবিজ্ঞান পড়া। এ সবই পড়তেন বাংলাভাষায়। কারণ তাঁদের বাড়িতে বাংলাভাষায় শিক্ষা নেওয়াটাই ছিল নিয়ম। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ইংরেজিতে কোনো বাঙালির লেখা চিঠি এলে তা না পড়েই তিনি ফেরৎ পাঠিয়ে দিতেন। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ এই বয়সেই ‘সীতার বনবাস’ থেকে ‘মেঘনাধবধ’ কাব্য পর্যন্ত পড়েছিলেন। বিকেল সাড়ে চারটের পর জিমনাস্টিকের মাস্টারের কাছে ঘণ্টাখানেক চলতো শারীরিক কসরত। মাঝখানের কিছু সময় স্কুলে থাকতেন (অবশ্য স্কুলে তিনি কমই যেতেন। তবে বাড়ির বিদ্যায় ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না)। জিমনাস্টিকের শিক্ষক চলে গেলে ছবি আঁকার শিক্ষক এসে হাজির হতেন। আর সন্ধ্যা নামলে অঘোর মাস্টারের কাছে ইংরেজি শেখা। ছুটির দিনে গান শিখতেন। আবার তাঁর সেজদাদা যখন বেহাগে গান গাইতেন, তিনি তখন নিজের মনে সে গান তুলে নিতেন। এভাবে নানাবিদ্যার নানা আয়োজনে ভরে থাকতো রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার দিনগুলো।


রবীন্দ্রনাথের মানসগঠনে জন্য সবচেয়ে অনুকূল ছিল বাড়ির পরিবেশ। বাড়িতে বাঙালি ঐতিহ্য চলতো পুরোদমে আবার চালচলন ছিল বিলেতি। সহবত-আচার-আচরণ ইংরেজদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, আত্মীক দিক থেকে পুরোপুরি ভারতীয়। বাড়ির আঙিনা থেকে ভালুক নাচওয়ালা, সাপুরের সাপ খেলা, ভোজবাজিওয়ালা কখনো ফিরে যেতো না। এই খেলাগুলো দেখে তাঁদের মনে নতুন আবেগ তৈরি হতো। মার্বেল, ব্যাটবল, লাটিম ঘোরানো, ঘুড়ি-ওড়ানোতেও কোনো বাধা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ একা একা বারান্দার রেলিংগুলোকে ছাত্র বানিয়ে ছাত্র-শিক্ষক খেলতেন, পুরোনো পালকিতে ঢুকে তেপান্তরের মাঠ পেরোনোর খেলা খেলতেন। এভাবে শিশু রবীন্দ্রনাথ আপন মনে কল্পনার রঙে ছবি আঁকতেন- ঢুকে যেতেন কল্পনার জগতে। এছাড়া সন্ধ্যায় বাড়ির আঙিনায় বড়োদের নাটক হতো। ছোটোরা তা প্রতিদিন দেখতে পেতো না ঠিকই কিন্তু পরিবেশটা মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির অনেকেই গান গাইতেন, তাই ভোরে রেওয়াজের সুর উঠতো বাড়ির বিভিন্ন ঘর, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আগেই বলেছি সে সময় বাঙালি নারীরা ছিলেন অবরোধবাসিনী; কিন্তু ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা বাংলা-ইংরেজি-সংগীত শিক্ষা নিতেন। তাই প্রগতির হাওয়া বইতো বাড়ির আঙ্গিনায়। তাঁদের বাড়ির প্রতিদিনের পরিবেশ ছিল এ রকম। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ি এলে কিছুটা পরিবর্তন হতো। সবাই খুব সতর্কভাবে চলাফেরা করতেন। সবাই কথাবার্তায় বেশি পরিমাণে ভদ্রতা আনতেন এবং আস্তে কথা বলতেন। এছাড়া বাড়ির চাকর থেকে সদস্যরা ভালো-সুন্দর কাপড় পরতেন। দেবেন্দ্রনাথ বাড়ির সকলকে নিয়ে উপাসনায় বসতেন। এ সময় চলতো আত্মিক শুদ্ধতার আরো এক ধাপ উপরের আরাধনা। তাঁদের বাড়িতে একজন মুসলিম দরজি ছিল। বাড়ির দরজি নেয়ামত খলিফার নামাজ পড়া দেখে মুসলিম সমাজের চাল-চলনও দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। একজন পরিপূর্ণ মানুষ তৈরির সূচনা হয়েছিল এভাবেই।


এগারো বছর বয়সের সময় পিতার সাথে হিমালয়ে বাস কালে তিনি আরো একধাপ এগিয়ে যান অর্থাৎ উপনিষদ শিখে নেন ভালো ভাবে। সেই সাথে শিক্ষারও প্রসার হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে সে সময় শিশু রবীন্দ্রনাথকে শিক্ষা দিতেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার পেতেন এবং সেগুলো পালন করতেন। এভাবে দায়িত্ববোধও তার ভেতরে তৈরি হয়। শিক্ষাজীবনের এই ধারায় কোনোটিই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিকের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান এবং অভ্যেস তাঁর ভাণ্ডারে জমা হয় নিশ্চিত। বিশ্ব কবির ভিত্তিপ্রস্তর পোঁতা হয় এ সময়ই।


আজকের বাংলাদেশের শিশুরা প্রাতিষ্ঠানিকের চাপে প্রতিদিনের আনন্দভ্রমণ থেকে বঞ্চিত। না খেলা, না বাঙালি ঐতিহ্যের ছোঁয়া; কেবলই নিরানন্দ মুখস্তবিদ্যা, স্কুল, কোচিং, প্রাইভেট টিউটর। আবৃত্তি, নাচ, গান শেখাও আনন্দময় নয়- প্রতিষ্ঠানের যাঁতাকলে নিরানন্দ। শহরে ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট গণ্ডিতে কল্পনাও বিস্তৃত হতে পারে না। আবার গ্রামের মানুষগুলো মানসিকভাবে এতোটাই শহরমুখী হয়েছেন যে, তারাও আর শিশুর শৈশব স্বীকার করতে চান না। ছেলেমেয়েদের এক কৃত্রিম জীবনে বেঁধে রাখেন। এভাবে বাঙালি জীবনের উন্মুক্ত প্রান্তর শিশুদের জন্য গণ্ডিবদ্ধ হয়ে উঠছে। তাই বলে প্রজন্ম অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যেতে পারে না। সময় এসেছে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে রেনেসাঁসের।


ভৌগলিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের কারণে রবীন্দ্রনাথের আকাশ এবং প্রকৃতি হয়তো নতুন প্রজন্মকে দেওয়া সম্ভব নয়, তবে বাঙালি ঐতিহ্য এবং আনন্দময় জীবন দেওয়া খুব কষ্টসাধ্য নয়। আজকের প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথের মতো ‘ছেলেবেলা’ পাইয়ে দিতে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা স্বীকার করতেই হবে। তবেই মেধা-মননসম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি সম্ভব, সম্ভব বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।


রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় পরিবার থেকে নানা রকম শিক্ষার আয়োজন করেছিল ঠিক, তবে তা নিরানন্দ ছিল না; কিংবা শিশুমনের বিরোধীও ছিল না। শিশুর মনের উপযোগী করে শিক্ষা দেওয়া হতো। বাঙালির লোক ঐহিত্যের বিভিন্ন খেলা বাড়িতে দেখানো হতো এতে পড়ার ক্লান্তি যেতো দূর হয়ে। আবার গল্প শুনতে কোন শিশু অপছন্দ করবে! নিয়ম করে ভারতীয় ঐতিহ্যের গল্পগুলো শুনিয়ে তাদের একদিকে যেমন আনন্দ দেওয়া হতো, অন্যদিকে তেমনি শেখানোও হতো। বর্তমানের শিশুদের বাধ্য করা হয় গান শিখতে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাড়ির পরিবেশ এমন ছিল যে, তিনি কেবল গান শিখতে নয়, বরং গান লিখতে, সুর করতে চাইতেন। স্কুলের পরিবেশের কারণে তিনি স্কুলে যাননি ঠিকই কিন্তু বাড়িতে বই পড়তে তাঁর কোনো অনিহা ছিল না। আজ একবিংশ শতকে বাংলাদেশের শিশুদের সেই পরিবেশ দিলে এক একটি শিশু সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কাণ্ডারী হবে নিশ্চিত।

লেখক : নাট্যকার, গবেষক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়