ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলা ছন্দের সূত্রস্রষ্টা নেই কোনো আলোচনায়

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা ছন্দের সূত্রস্রষ্টা নেই কোনো আলোচনায়

অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের কবিগুরু বইয়ের প্রচ্ছদ

হাসান মাহামুদ: ‘কবিতা’ প্রসঙ্গটি আসলে প্রথমেই মনে আসে ছন্দের কথা, মাত্রার কথা। ছন্দ ছাড়া কবিতা যেন ভাবাই যায় না। কবিতায় ছন্দের আবেদন যুগে যুগে ছিল, থাকবেও। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলা কবিতাকে আমরা ভালবাসলেও, বাংলা ছন্দের মূলসূত্র স্রষ্টাদের আমরা খুব একটা মনে রাখিনি।

যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘বেতাল ভট্ট’-কে কয়জন চিনেন? এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেতাল ভট্ট একজন ছন্দ স্রষ্টা। বেতাল ভট্ট হচ্ছে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়-এর ছদ্মনাম। তিনি একাধারে শিক্ষক, ছন্দবিদ, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। একই সঙ্গে ‘বাংলা ছন্দের মূলসূত্র’ সৃষ্টির জন্য তিনি বিখ্যাত।

১১৫ বছর আগে আজকের দিনে (১৯০২ সালের ২৫ মে) এই মহান ছন্দবিদের জন্ম। ছন্দবিদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম জলপাইগুড়ির পার্টিগ্রামে। তিনি বেতাল ভট্ট ছদ্মনামেও লিখতেন।

অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় তার সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে আপন মহিমায় উজ্জল। কিন্তু এই ছন্দকবিকে আমরা খুব কমই জেনেছি। বিংশ শতাব্দির সাহিত্যিক হওয়ার পরও আমরা অনেকে তার নাম জানি না। এমনকি মুক্ত তথ্যকোষ ‘উইকিপিডিয়া’তেও অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় সর্ম্পকে কোনো তথ্য সংযুক্ত করা হয়নি।

বাংলা কবিতার বিবর্তন নিয়ে যে ক’জন সাহিত্য সমালোচক লিখেছেন, তাদের প্রতেক্যেই অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় সর্ম্পকে আলোচনা করে গেছেন। কবিতার ছন্দ নিয়ে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থের নাম ‘আধুনিক সাহিত্যে জিজ্ঞাসা’। এতে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সমালোচনা রয়েছে, প্রকারান্তরে বাংলা সাহিত্য সমালোচনাই রয়েছে। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মানসী’। এটি কাব্য সমালোচনার গ্রন্থ। এছাড়া অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় যে কাজটির জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও নন্দিত হয়েছিলেন, তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলোচনা করা। তিনি তার ‘কবিগুরু’ গ্রন্থে এই কাজটি করেছেন। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা আরো একটি বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়, যার নাম ‘নবাব কাহিনী ও অন্যান্য’। তার প্রতিটি বই প্রকাশ করেছেন দে’জ পাবলিশিং (ভারত)।

ছন্দবিদ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে, বাঙালির সহজাত আলস্যপ্রবণতার একটি জনপ্রিয় প্রকাশ জীবনানন্দের ছড়ানো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। কথাটি অন্তত এইদিক থেকে ভাবাতে পারে, যে একটি জাতির মনের ব্যাকরণ ধরতে চাওয়া হচ্ছে একজন কবির কবিতার প্রকরণ থেকে।

বিশ শতকের প্রথমার্ধেই ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলা ছন্দের মূলসূত্র’। এর মাধ্যমে তিনি প্রচলিত ছন্দের সংযুক্তি করেন এবং কিছু যুক্তি-তর্কও উপস্থাপন করেন। বাংলা কবিতা লিখতে সাধারণত যে তিনটি ছন্দের ব্যবহার হয়, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই তিনটি ছন্দেরই আলাদা নামকরণ করেছিলেন যুক্তি সহকারে। বিশ শতকে রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ে অমূল্যধনের যে সব নামকরণ ও যুক্তি বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। যার কারণে তিনি ছন্দবিদ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন।

ছন্দ ছাড়া কবিতা কখনোই সম্ভব নয়। কবিতাকে একসময় পদ্য নামেই অভিহিত করা হতো। এখন অবশ্য পদ্য না বলে আধুনিক নামকরণ করা হয়েছে কবিতা। পদ্য বা কবিতার আলাদা নামকরণের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কেউ কেউ। পদ্য কিংবা কবিতা যে নাম ধরে ডাকা হোক না কেন, উভয়ের মধ্যেই ছন্দের প্রয়োগ রয়েছে।

কবিতার আধুনিক সময়ের আগ পর্যন্ত কবিতায় ছন্দ বলতে যে ধরনের ছন্দকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো কিংবা যে ধরনের ছন্দের বেশি প্রয়োগ হতো কবিতায়, তা আজ সেভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। কবিতায় সেই ধরাবাঁধা নিয়মের যে ছন্দ, সে ছন্দ থেকে কবিরা কবিতাকে মুক্তি দেওয়ার পথ খুঁজেছেন মাত্র।

এখন কথা হচ্ছে, ছন্দ আসলে কী? ছন্দ হচ্ছে ঢং কিংবা রীতি। কবিতার শরীরে দোলা লাগানোর যে কায়দা, তাই মূলত ছন্দ। কবিতাকে নানান দোলায় দোলানো যায়। তেমনি কবিতায় ছন্দও নানারকমের। এই নানারকমের ছন্দ দিয়েই কবিতাকে নানান দোলায় দোলাতে হয়। কবিতায় ছন্দকে মোটামুটিভাবে ছন্দবিশেষজ্ঞরা তিন ভাগে বিবেচনা করে থাকেন। যেমন- ১। অক্ষরবৃত্ত ২। মাত্রাবৃত্ত ৩। স্বরবৃত্ত। এই নামগুলো দিয়েছেন প্রখ্যাত ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে প্রবোধচন্দ্র সেন পরে যৌগিক ছন্দ, মিশ্রকলাবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত ছন্দও বলেছেন। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নাম দিয়েছিলেন ‘তানপ্রধান’। মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় নাম দিয়েছিলেন ‘ধ্বনিপ্রধান’। স্বরবৃত্ত ছন্দকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দ’।

এই তিনটি ছন্দকে নানা সময়ে নানা রকম নামে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া পরে আরো দুটি ছন্দের সৃষ্টি হয়েছিল- গদ্য ছন্দ ও মিশ্রছন্দ। গদ্য ছন্দ ও মিশ্রছন্দ আসলে কবিতার মধ্যে মানুষের প্রাত্যহিক স্বাভাবিকতাকে আহরণ করারই এক-একটি উদ্যম। আধুনিক সময়ে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ছন্দে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা মুক্তক ছন্দের প্রয়োগ করে ইতিহাসে যুগান্তর আনলেন। এসবই অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বা বেতাল ভট্ট পরবর্তী আবিস্কার। তাই এসব নিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা বা নামকরণ পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে কবিতায় যে ছন্দ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ। তা ছাড়া গদ্য ছন্দ ও মুক্তাক্ষর ছন্দও বর্তমান সময়ের কবিতায় ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। এভাবেই চিরাচরিতভাবে বাংলা কবিতায় ছন্দের ব্যবহার ছিল, ছন্দের ব্যবহার বর্তমানেও হচ্ছে, সুদূরেও ছন্দের ব্যবহার থাকবে বা ব্যবহার হবে। হোক না তা যে কোনো ছন্দে বা নতুন কোনো ছন্দ সৃষ্টি প্রয়োগের মাধ্যমে। বাংলা কবিতায় ছন্দ বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে। আমরা চাই এর সাথে সাথে কবিতার আদিপাঠও কবিরা করুক। কবিতার কাঠামো ঠিক করে দিয়ে গেছেন যেসব সাধক, কবিতা চর্চ্চাকারীরা তাদেরও জানুক। ছন্দকার ও ছন্দবিদরা অমর হোক।

লেখক: সাংবাদিক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৭/হাসান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়