ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জাপায় রাজাকারদের কদর!

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাপায় রাজাকারদের কদর!

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন : ‘মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’ আখ্যা দেওয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতেই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারদের কদর বেশি-এমন অভিযোগ রয়েছে।

 

অভিযোগকারীদের দাবি, দলটি ক্ষমতায় থাকতেও তাদের পুনর্বাসন করেছে। ক্ষমতার বাইরে গিয়েও রাজাকারদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।

 

জাতীয় পার্টির কল্যাণে যুদ্ধাপরাধী অনেকেই আজ সংসদ সদস্য। বরং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। উল্টো পদ পদবি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। দলের সাংসদ আব্দুল হান্নানকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পরও তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নতুন কমিটিতে তাকে প্রেসিডিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।

 

তবে জাতীয় পার্টিতে রাজকারদের পুনর্বাসন করার বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেছেন দলটির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার।

 

রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আমাদের চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিক। ক্ষমতায় থাকতে তিনিই একমাত্র ঘোষণা দিয়েছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। এটা তার মুখের নয়, অন্তরের কথা। ক্ষমতায় থাকতে দেশের এই বীরশ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য তিনি কী করেননি আপনারাই বলুন?’

 

দলের পদ-পদবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে হাওলাদার বলেন, ‘পার্টিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্ব দেওয়া না হলে আমি কী করে পার্টির মহাসচিব? উল্লেখযোগ্য পদে রয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নুসহ একাধিক নেতা।’ পার্টির চেয়ারম্যান সবসময় বীর মুক্তিযোদ্ধদের সন্মানের চোখে দেখেন বলেও দাবি করেন তিনি।

 

জানা যায়, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলীয় সাংসদ আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি জানার পরও ২০১৪ সালের সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তাকে ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) এলাকায় সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয় দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতও হন তিনি।

 

কিন্তু একবছর না যেতেই ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এমপি হান্নানকে ছেলেসহ রাজধানী গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকে এখনো তিনি জেলে। বরং তার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। যে কোনো সময় অভিযোগ গঠন করা হবে।  মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলেও কিন্তু জাতীয় পার্টির কাউন্সিলে তার পদ, পদবি বাদ দেওয়া হয়নি। বরং তাকে প্রেসিডিয়ামের মত নীতি পর্যায়ের পদ দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এভাবেই এরশাদের জাতীয় পার্টিতে চিহ্নিত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের কদর করা হচ্ছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, এম এ হান্নানের বিষয়টি বিচারাধীন, চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত মন্তব্য করার সুযোগ নেই। যেহেতু এখনো বিচারে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হননি তাই তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাছাড়া বিষয়টি পার্টির চেয়ারম্যানের এখতিয়ার।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, জাতীয় পার্টিতে আব্দুল হান্নানের মতো অনেক চিহ্নিত রাজাকারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা যে রাজাকার কে না জানতো? জেনেশুনেই এসব দেশবিরোধীদের পদ পদবি ও সংসদ সদস্য করে সন্মানিত করা হয়েছে।

 

তাদের অভিযোগ, কুড়িগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। গতবছর তার বিরুদ্ধে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দলের নেতাকর্মীরাও বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করে প্রকাশ্যে তার বিচার দাবি করেছে। বিচারের দাবিতে এ সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। কিন্তু বিরোধী নেতা রওশন ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে আছে বলে অভিযোগ তাদের।

 

জানা গেছে,জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জাব্বার গত কমিটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। মঠবাড়িয়া এলাকায় তার বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালে তার অপকর্মের  তদন্ত শুরু হলে তিনি পালিয়ে যান। এখানো তিনি পলাতক।

 

২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল তাকে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ১২ মে তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ৫টি অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। তবে এখনো তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করতে না পারায় তার অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চলার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

 

জানা গেছে, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জাব্বারের ভাইস চেয়ারম্যানের পদটি খালি রাখা হয়েছে। যদি কখনো তিনি ফিরে আসেন তাহলে তাকে আব্দুল হান্নানের মতো ওই পদে দেখা যাবে, এমনটাই জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

 

এভাবে সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির মাওলানা সাখাওয়াতও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। গত কমিটিতেও তিনি ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাজধানীর উত্তরখান থেকে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধকালীন শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

 

চলতি বছরের ১১ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জাপা নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে সাখাওয়াতের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে রয়েছেন।

 

অভিযোগ আছে, শুধু ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় জাতীয় পার্টিতে রাজাকারদের পুনর্বাসিত করা হয়নি বরং ক্ষমতায় থাকতেও দলটিতে রাজাকারদের কদর ছিল । যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি দলের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন।

 

শুধু তাই নয়, সাবেক মন্ত্রী জাতীয় পার্টির নেতা আব্দুল আলিম ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মহিবুল হাসানও ছিলেন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আব্দুল আলিমের সাজা দেওয়া হয়। জেল হাজতেই অসুস্থ্য হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আর মহিবুল হাসান দীর্ঘদিন ধরে পলাতক রয়েছেন।

 

জানা গেছে, জাতীয় পার্টিতে সংসদ সদস্য মনোনয়ন, পদ-পদবি দেওয়া ইত্যাদিতে রাজাকারদের গুরুত্ব দেওয়া হলেও দেশের জন্য যারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের কম দেখা যায়,   পদোন্নতির ক্ষেত্রেও তারা অনেক ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার।

 

শুধু তাই নয়, এরশাদের জাতীয় পার্টিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তেমন কোনো বাড়তি আগ্রহ যেমন নেই, তেমনি তাদের জন্য দলে কোনো কোটা নেই। এমনকি দলের গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদকের পদটিও ননগেজেটেড মুক্তিযোদ্ধার দখলে। নতুন কমিটিতে সহ সম্পাদক পদ এখনো শূন্য। আর দলের সহযোগী সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা পার্টিতে যারা আছেন তাদের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা নন। এভাবেই চলছে মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিক এরশাদের জাতীয় পার্টি।

 

জানা গেছে, জাতীয় পার্টির নতুন কমিটির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে জাহাঙ্গির আলম পাঠানকে। তিনি একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা কিনা জানতে চাইলে দলের সহ দপ্তর সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, হ্যাঁ তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।  কিন্তু পরে জানা গেলে তিনি গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা নন।

 

এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গির আলম পাঠান অকপটে স্বীকার করেন-তিনি গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে তিনি নিজেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দাবি করেন। তিনি বলেন, দলের মহাসচিব হাওলাদার, চুন্নু, রাঙ্গা আনিস, বাবলু, ফিরোজ রশীদ এরা গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা।

 

দলের মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলা করার বিষয়টি স্বীকার করে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক পাঠান বলেন, শুধু জাতীয় পার্টিতে কেন, সব দলেই তো মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত।

 

জাতীয় পার্টিতে অবমূল্যায়ণ করার কারণে বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন চলচ্চিত্র নায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। তবে নতুন কমিটিতে আবারো তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ডিসেম্বর ২০১৬/নঈমুদ্দীন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়