ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পরিবেশগত ঝুঁকিতে রাজধানীর ৪৩ শতাংশ শিশু

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২৮ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরিবেশগত ঝুঁকিতে রাজধানীর ৪৩ শতাংশ শিশু

হাসান মাহামুদ : রাজধানীতে কয়েক বছরের ব্যবধানে পরিবেশগত ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুণ। শিল্পায়ন ও উন্নয়ন কাজের কারণে দূষিত হচ্ছে বাতাস। রাসায়নিক প্রভাব ছাড়াও বাতাসে ভাসছে ধূলিকণা, নির্মাণসামগ্রীর ক্ষুদ্রোপকরণ। বাড়ছে শব্দ দূষণ। দূষিত হচ্ছে বায়ু, মাটি, শব্দ এবং পানি। আর এ সবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। তাদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে উচ্ছ্বল শৈশব।

এ সংক্রান্ত একটি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, রাজধানীর প্রায় ৪৩ শতাংশ শিশু পরিবেশগত ঝুঁকির সরাসরি শিকার। রাজধানীর ১৫টি সড়ক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন কর্মকর্তা, চিকিসক এবং নগরবিদকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিচালিত বেসরকারি গবেষণায় এ চিত্র পাওয়া গেছে।

উল্লিখিত সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের শুধুমাত্র বায়ু ও শব্দদূষণের বিষয়ে বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দিলু রোড়, ইস্কাটন (অর্থনৈতিক সমিতির গলি থেকে সাপ্তাহিক ২০০০ এর গলি পর্যন্ত), মালিবাগ (প্রধান সড়ক থেকে আনুমানিক ১০০ গজ পর্যন্ত), মালিবাগ মোড় থেকে মৌচাক হয়ে মগবাজার, খিলগাঁও (ফ্লাইওভার থেকে রাজারবাগ), চৌধুরী পাড়া থেকে আফতাবনগর; এসব রাস্তার পাশের বাসাগুলোর অধিকাংশ ভাড়াটিয়া গত কয়েক মাসে শব্দ এবং ধুলোর কারণে বাসা পরিবর্তন করেছেন। এমনকি অফিস স্পেস পরিবর্তনের চিত্রও পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে জরিপ পরিচালনা করা হয় রাজধানীর পনের সড়কের পাশে ৫০টি বাসভবনে। মোট ১০০ জনের মতামত গ্রহণ করা হয়। এরপর সাধারণ জনগণের মতামত ও বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার আলোকে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হয় রাজধানীতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ১০ কর্মকর্তা, দুজন চিকিৎসক এবং একজন নগরবিদের। এপ্রিল থেকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। তবে জরিপে আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করার ক্ষেত্রে পূর্বের ছয় মাস (২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) গণনা করা রয়েছে। মোট দশটি প্রশ্নের ভিত্তিতে পরিচালিত জরিপের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, জরিপের শর্তানুসারে রেসপন্ডদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে না। এছাড়া জরিপে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য শিশুদের উপর প্রভাবের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ৬ মাস থেকে ৬ বছর বয়সীদের।

জরিপের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে দশটি প্রভাবকের প্রভাব মিলে নির্দিষ্ট এলাকার ৪২ দশমিক ৮ বা প্রায় ৪৩ শতাংশ শিশু পরিবেশগত ঝুঁকির সরাসরি শিকার। এই চিত্র পুরো রাজধানীর চিত্রের সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জরিপে অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসক এবং নগরবিদ।

জরিপকালে কিছু বাড়ির মালিক পাওয়া গেছে, যারা শব্দ ও ধুলো প্রতিরোধে ভবনের জানালার বাইরে আলাদা গ্লাস ব্যবহার করছেন। শান্তিনগর এলাকায় এমন ভাড়াটিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে- যারা মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজে সৃষ্ট শব্দ ও ধুলোর কারণে নতুন বাসায় উঠে মাত্র দু’মাস পরেই বাসা বদল করেছেন। এজন্য তাদের অগ্রিম প্রদান করা ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওই ভাড়াটিয়া, ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন আহমেদ।

২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত, এই ছয় মাসে এসব জরিপভুক্ত এলাকায় ১২টি পরিবার বাসা পরিবর্তন করেছে। অর্থ্যাৎ, নির্মাণকাজ চলছে এমন এলাকায় শব্দ ও বায়ু দূষনের কারণে ২৪ শতাংশ বাসা পরিবর্তন হয়েছে। ঠিক একই কারণে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে ১৬ জন বাচ্চার। অর্থ্যাৎ, স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছে ৩২ শতাংশ বাসার। জরিপে উল্লেখিত সময়ে কানের ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হয়েছে ৮ শিশুকে। যার অনুপাত ১৬ শতাংশ। ক্ষুধামন্দা, অবসাদগ্রস্ততা, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ রোগের কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে মোট ২৮ শিশুকে, যার অনুপাত ৫৬। কয়েকদিনের জন্য হলেও ডাক্তারের কাছ থেকে আবহাওয়া বদলের পরামর্শ পেয়েছেন ২৮ শিশুর বাবা-মা। এই অনুপাতও ৫৬।

এ সময়ে আগের বছরগুলোর তুলনায় সন্তানদের তুলনামূলক বেশি সময় দিতে হয়েছে ৩০ জন বাবা-মাকে। এর হার ৬০ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, সন্তানদের অসুস্থতা এবং অন্যান্য কারণে তাদের পরিবারে সময় দেওয়া বাড়াতে হয়েছে। এ কারণে নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যালয় বদল করেছেন ৮ জন পিতা। এমনকি ২ জন মা তাদের চাকুরী বদল (ট্রান্সফার) করেছেন। জরিপের ভিত্তিতে এই হার ২০ শতাংশ।

পাশের ফ্লাটে কিংবা বাসার ছাদে কিছুটা হলে খেলাধুলা করে সময় কাটানো ১৪ শিশু (২৮ শতাংশ) এখন ঘরকুনো হয়ে পড়েছেন বলে বাবা-মায়েরা জানিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বারান্দা ও ছাদে এখন সবসময় ধুলোর আস্তর জমে থাকে। তাই তারা নিজেরাও শিশুদের বারান্দা ও ছাদে পাঠানোর পক্ষপাতি নয়। এ বিষয়ে চিকিৎসকরা বলেছেন, এটি আসলে শিশুর অধিকার হরণের শামিল। কিন্তু অবস্থা প্রতিকূল এবং কারণটি ভিকটিমদের কাছে প্রাকৃতিক বলে, একে অধিকার হরণ হিসেবে সরাসরি চিহ্নিত করাও যাচ্ছে না।

অসুস্থতা ও অনিয়মে স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কারণে নোটিশ পেয়েছেন ১৮ শিশুর বাবা-মা। জরিপের ভিত্তিতে এর শতাংশ ৩৬ শতাংশ। পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে শিশুদের উপরোক্ত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে হয়েছে বলে মনে করেছেন শতভাগ বাবা-মা।

দিলু রোড়ের এক বাসিন্দা জরিপে জানিয়েছেন, সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য ডাক্তার তাদের পরামর্শ দিয়েছেন বাসা বদল করতে। না হলে তাদের দুটো সন্তান দীর্ঘমেয়াদী কানে সমস্যায় পড়তে পারেন বলে ডাক্তার সতর্ক করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিকিৎসক ডা. আকতার উজ-জামান বলেন, রাস্তার ধারের গাড়ির হর্ণ বা নির্মাণ কাজের শব্দ বিষয়টিকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে ধরে নেন অনেকে। কিন্তু যারা দিনের অধিকাংশ সময় শব্দদূষণের শিকার হচ্ছেন তাদের অনেক রকমের বিপর্যয় সহ্য করতে হয়। বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব মারাত্মক সমস্যা হয় শিশুদের। এর ফলে যে কোনো শিশু ভবিষ্যতে কানে আর কিছুই না শুনতে পারার আশঙ্কা তৈরি হয়। একই সঙ্গে অতিরিক্ত শব্দদূষণে তার ব্রেনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, মায়ের গর্ভ থেকে একটি নবজাতক পৃথিবীতে আসার পরেই নতুন পরিবেশ এবং আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হয়। যার উপর নির্ভর করে তার সুস্থ্যতা। বাহ্যিক প্রকৃতি এবং আবহাওয়া যদি দূষিত হয় তাহলে শুরু থেকেই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবার পাশাপাশি রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিও বাড়ে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, শব্দদূষণের ফলে শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বাচ্চাদের মেজাজ খিটমেটে করে তুলে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয়। পরবর্তীতে পড়াশোনায় অমনযোগী হয়ে পড়ে তারা। তাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এই শব্দদূষণও একটি কারণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন চিকিৎসকরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ-এর একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০টি বড় বড় রোগের কারণ ১২ ধরনের পরিবেশদূষণ। তার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের শব্দদূষণের মাত্রা ৬০ থেকে শুরু করে কোনো কোনো স্থানে ১০৬ ডেসিবল পর্যন্ত রয়েছে। যা মানুষের শারীরিক-মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরো বেশি বলে মন্তব্য করেছেন চিকিৎসকরা।

গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশগত কারণ বিশেষত শিশু জন্মের পূর্বে ও পরে মায়ের দৈহিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি শিশুস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই, নবজাতককে জন্মপূর্ব এ সকল রোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন প্রসূতির জন্য শিশুর জন্ম পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার এবং পরিবেশ সম্মত আবাসস্থল।

নগরবিদরা বলছেন, এসব উন্নয়নকাজ নাগরিকজীবনের চাহিদা। তাই আগামী কয়েকবছর রাজধানীতে উন্নয়নকাজ চলবে। কিন্তু এসব উন্নয়নকাজের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপনও হচ্ছে না, এসবের সমাধানও হচ্ছে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই যার কোনো নজির নেই।

এমনিতেই রাজধানীর বাতাসে বিষাক্ত সিসা, কার্বন ডাই অক্সসাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার রয়েছে। এর সঙ্গে এসব নির্মাণকাজের কারণে এসব উপাদান আরো বেশি মাত্রায় তৈরি হচ্ছে। যার ফলে বাতাসের ধূলিকণায় নিঃশ্বাসের সাথে শ্বাসপ্রণালীতে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনি ড্যামেজ, লিভারে সমস্যা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত করছে নগরবাসীকে। যার বেশি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। কারণ তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে অনেক কম। নানা জটিল রোগ আক্রান্ত হয়ে পড়ায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে আরো কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সত্য যে, এতে আক্রান্ত শিশুরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।

পরিবেশগত ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা পেতে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন নগরবিদ। তিনি বলেছেন, প্রথমত অফিসিয়াল ব্যস্ততার পাশাপাশি পিতা-মাতাকে অবশ্যই পরিবারে সময় দেওয়া বাড়াতে হবে। যেহেতু, নগরায়ন এবং উন্নয়ন কাজ রাষ্ট্রীয় বিষয়। এসব রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন। আর যে কোনো দেশেই উন্নয়ন কাজের জন্য জনগণকে কিছুটা হলেও সহ্য করতে হয়। যদিও উন্নত দেশগুলোতে এ জন্য ক্ষতিপূরণ পায় নাগরিকরা।

এছাড়া অন্য সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস, বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপন, বায়োগ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সৌরশক্তিচালিত সেচ যন্ত্র প্রভৃতি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলে দ্রুত পরিবেশগত ঝুঁকি কমানো সম্ভব।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ২৮ মে ২০১৭/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়