ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কাতার সংকট : ভিন্ন দেশ থেকে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা

শায়েখ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাতার সংকট : ভিন্ন দেশ থেকে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা

শায়েখ হাসান : কাতারের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাসের (এলএনজি) সমস্যা সমাধান হতে সময় লাগবে।

আবার, সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর টানাপোড়েনের মাঝে চুক্তি অনুযায়ী দেশটি থেকে এলএনজি আমদানির ঘোষণাও দিতে পারছে না। তাই আশু সমস্যার কথা ভেবে অন্য কয়েকটি দেশে থেকে এলএনজি আমদানির কথা ভাবছে সরকার।  

এলএনজি আমদানিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এমন সুপারিশ তুলে ধরেছে বলে পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানিয়েছে। এমনকি এলএনজিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলেও তারা জানিয়েছে।

কমিটি বলেছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহের আশা করছে সরকার। এমনকি কাতারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের মার্চে দেশে এলএনজি আসারও কথা ছিল। এ লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মাণ হচ্ছে ভাসমান টার্মিনাল। এর বাইরে টার্মিনাল নির্মাণের কথা রয়েছে ভারতের দুটি ও ব্যক্তিখাতে বাংলাদেশের আরো একটি কোম্পানির। কিন্তু কাতারকে ঘিরে চলমান সংকট জ্বালানির জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে। কাতার এলএনজির প্রধান উৎস দেশ হওয়ায় সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি বেড়ে যেতে পারে এর মূল্য। এতে ঝুঁকিতে পড়বে এলএনজিতে বিনিয়োগও।

বৈশ্বিক এলএনজি বাজারের বিরাট অংশ দখল করে আছে কাতার। বৈশ্বিক এলএনজির বৃহত্তম রপ্তানিকারক মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। ২০১৬ সালে প্রায় ৭ কোটি ৭২ লাখ টন এলএনজি রপ্তানি করেছে তারা। কাতারের এলএনজির বড় ক্রেতাদের বেশির ভাগই এশিয়ার। জাপান ও চীনের পাশাপাশি ভারতও বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে দেশটি থেকে। ইন্টারন্যাশনাল গ্যাস ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছরে বিশ্ববাজারে মোট এলএনজির এক-তৃতীয়াংশ জোগান দিয়েছে কাতার।

দেশে শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পরিসর বাড়ছে। ফলে গ্যাসের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। তবে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান না পাওয়ায় গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য থাকছে। শিল্প-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও আবাসিকসহ সব খাত মিলে বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩২০ থেকে ৩৫০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। অর্থাৎ ৬০ থেকে ৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে। জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে তাই ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড। বার্ষিক হারে টার্মিনালটি ভাড়ায় ব্যবহার করবে পেট্রোবাংলা। এলএনজির কাঁচামাল আমদানি করা হবে কাতার থেকে। এ বিষয়ে কাতারের রাশগ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিও করেছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮ সালের মার্চ নাগাদ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে জিওটেকনিক্যাল ও জিওফিজিক্যাল সমীক্ষা শেষে বর্তমানে ডিজাইন ও ড্রইংয়ের কাজ চলছে।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, আজ ১৭ জুন কাতারে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকে এলএনজি আমদানির বিষয়গুলো চূড়ান্ত করে প্রাথমিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম কাতার যাওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু প্রতিনিধি দল দেশটিতে যায়নি।

অপরদিকে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক এলএনজি সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও পেট্রোবাংলার এমওইউ স্বাক্ষর করার কথা ছিল ১৩ জুন ঢাকায়। কিন্তু কাতার সংকটের কারণে এসব আটকে গেছে। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, কাতার সংকট দীর্ঘায়িত হলে এলএনজির উৎস নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে পেট্রোবাংলাকে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। সৌদি কিংবা কাতারের যেকোনো এক পক্ষের প্রতি অবস্থান নিলে ব্যবসা-বাণিজ্যে জটিলতা ও ঝুঁকি দেখা দেবে। এসব দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক অবনতি হলে এলএনজির মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা জটিলতা দেখা দেবে।

তিনি বলেন, তবে চলমান সংকটের মধ্যেও কাতার থেকে পাকিস্তান এলএনজি আমদানি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের ওপরও অনেকের চোখ থাকবে।

যদিও জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে না। দোহার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করলেও কাতার থেকে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানিতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ কাতারের সঙ্গে আমরা এখনো সম্পর্ক ছিন্ন করিনি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির যে পরিকল্পনা সরকার করছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মধ্যেপ্রাচ্যের কাতার। কাতার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই আমাদের পরিকল্পনায় ছেদ ঘটবে।

তিনি বলেন, বিশ্বে এলএনজি বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে কাতার। বিশ্বে এলএনজির বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ মধ্যপ্রাচ্যের এ ক্ষুদ্র দেশটি। ২০১৬ সালে প্রায় ৭ কোটি ৭২ লাখ টন এলএনজি রপ্তানি করেছে তারা। কাতারের এলএনজির বড় ক্রেতাদের অধিকাংশই এশিয়ার। জাপান ও চীনের পাশাপাশি ভারতও বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করে দেশটি থেকে। ইন্টারন্যাশনাল গ্যাস ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, বিগত বছরে বিশ্বে মোট এলএনজির এক-তৃতীয়াংশ যোগান দিয়েছে কাতার।

প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের পরিকল্পনায় কাতারের এলএনজি থাকলেও এখন আমরা বহুমুখী চিন্তা করব। আমাদের যে পরিমাণ এলএনজি দরকার তা কয়েকটি দেশ থেকে আনার উদ্যোগ নেব। তবে কাতার সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলেই আমাদের প্রত্যাশা।

এদিকে এলএনজি আমদানিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করেছে। এ কমিটি শুধু এলএনজি আমদানিতে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করবে। এলএনজি আমদানিকে কেন্দ্র করে সরকার নানামুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে ইতোমধ্যে চুক্তি করেছে সরকার। এর বাইরে পেট্রোবাংলা আরো দুটি স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে পাওয়ারসেল একটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি সামিট পাওয়ার একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

আমদানিকৃত এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরাট পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব এসেছে সরকারের কাছে। এর মধ্যে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি খুলনায় ৭৫০ থেকে ৮৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। দেশের বৃহৎ বেসরকারি কোম্পানি সামিট পাওয়ার ১৬৫০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে।

এমসিপি নামে অন্য একটি কোম্পানিও ৮৫০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার বাংলাদেশে ৪ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। এলএনজিকে কেন্দ্র করে এত সব পরিকল্পনার পর এর প্রধান উৎসদেশ কাতারকে নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ায় এলএনজি আমদানিতে সমস্যা তৈরির পাশাপাশি দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়তে পারে এলএনজি খাতে বিনিয়োগকারীরা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৭/শায়েখ/হাসান/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়