ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জন্মে ব্যবধান আধা ঘণ্টা, জীবনে অনেক

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ১২ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জন্মে ব্যবধান আধা ঘণ্টা, জীবনে অনেক

আরিফ সাওন : একই দিনে জন্ম। একজন আগে, আরেকজন একটু পরে। মাত্র আধা ঘণ্টার ছোট-বড় তারা। জন্মের সময়ের ব্যবধান আধা ঘণ্টা হলেও এখন মুক্তামণি (১২) ও হীরামণির জীবনে ব্যবধান অনেক।

হীরামণি আধা ঘণ্টার বড়। তার জীবন কাটে হেসে-খেলে, ছোটাছুটি করে। সে স্বাভাবিক। এখন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

কিন্তু আধা ঘণ্টার ছোট মুক্তামণির জীবন স্বাভাবিক নয়। জীবনের ১০টি বছরই তার কেটেছে হাসপাতালে, চিকিৎসকদের কাছে ঘুরে ঘুরে। এখনো সে হাসপাতালে ভর্তি। জন্মের দুই বছর পর হাতে হওয়া একটি ছোট ফোঁড়া তার জীবনটা বদলে দিয়েছে। সাড়ে নয় বছর বয়স পর্যন্ত ততটা সমস্যা হয়নি। সাড়ে নয় বছরের পর তা অস্বাভাবিক আকারে বাড়তে থাকে। এই সাড়ে নয় বছর পর্যন্ত অনেক চিকিৎসকই দেখানো হয়েছে মুক্তামণিকে। তারা যে যার মতো চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু মুক্তার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং দিন দিন তার হাতের সমস্যা বেড়েছে।

এখন মুক্তামণির শরীরের চেয়ে তার ডান হাত অনেক মোটা। হাত দেখলে মনে হয় বয়স্ক গাছের অংশ। ওপরটা দেখতে ঠিক গাছের বাকলের মতো। হাত নিয়ে নড়াচড়া করতে পারে না। অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। সাড়ে নয় বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর হাতে অজানা রোগ বাড়তে থাকায় তার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়।

১১ জুলাই মুক্তামণিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়।

বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মুক্তার অবস্থা ভালো আছে। এখনো রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমরা বোর্ড গঠন করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করব। রক্ত লাগবে, নিউট্রেশন লাগবে- এগুলো প্রাথমিক চিকিৎসা। রক্ত দিয়ে একটু চাঙ্গা করে তারপর অপারেশন করব। আপাতত হাতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে দেখে চিকিৎসকরা সম্ভাব্য চার রোগের মধ্যে কোনো রোগে আক্রান্ত ধারণা করে সেভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। সম্ভাব্য রোগগুলো হচ্ছে- ডার্মাল ভাসকুলার ম্যালফরমেশন, লিমফেটিক ম্যালফরমেশন, নিউরোফাইব্রোম্যাটোসিস ও কনজেনসিয়াল হাইপারট্রিকোসিস।

১২ জুলাই বেলা সাড়ে ৩টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তা হাসপাতালের বিছানায় বসে আছে। ডান হাত ব্যান্ডেজ করা। হাতটি একটি বালিশের ওপরে রাখা। কিছুক্ষণ পর বিছানা ঠিক করার জন্য তাকে নিচে নামানো হয়। সে নিজে নিজে নামতে পারল না। তার মা-বাবা ধরে নামালেন। মা একপাশে ধরলেন আর বাবা আক্রান্ত হাতটি ধরে রাখলেন। বিছানা গোছানো হলে আবার তাকে বিছানায় তুলে শুইয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তামণির আধা ঘণ্টার বড় বোন হীরামণি ঘুরে বেড়াচ্ছে হাপাতালের এখানে-সেখানে। এদিক-ওদিকে না যাওয়ার জন্য হীরামণিকে বাবা ইব্রাহিম পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু মুক্তার তো এদিক-সেদিক যাওয়ার ক্ষমতা নেই। সে শুধু অসহায়ের মত মায়াবী চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে সবকিছু দেখছে।

মুক্তামণি বলে, হাতে চুলকায়, যন্ত্রণা হয়। একা নাড়াতে পারি না। খুব ব্যথা লাগে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অজানা রোগে আক্রান্ত মুক্তামণির চিকিৎসার ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছেন। যা লোকমুখে শুনেছেন মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন ও চাচা আহসান হাবিব।

 



আহসান হাবিব বলেন, শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া চিকিৎসকরা বলেছেন, তারা দায়িত্ব নিয়ে মুক্তামণির চিকিৎসা করবেন। তবুও কিছু কিছু জিনিস আমরা বাইরে থেকে নিয়ে আসছি। এতে কিছু টাকা ব্যয় হচ্ছে।

ইব্রাহিম হোসেন বলেন, হাত থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে দেখে ডাক্তাররা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। ডাক্তাররা ভরসা দিচ্ছেন, আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যাবে।

মুক্তার বাবা মো. ইব্রাহিম হোসেন মুদি ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তার তিন সন্তান। মুক্তামণি ও হীরামণি জমজ দুই বোন। ছোট ছেলে আল আমিনের বয়স ১ বছর ২ মাস। মুক্তার মায়ের নাম আসমা খাতুন। তারা সবাই এখন ঢামেকে আছেন। তাদের বাড়ি সাতক্ষীরার সদর উপজেলার দক্ষিণ কামার পাশা গ্রামে।

তিনি বলেন, মুক্তা ও হীরা যখন জন্মায় তখন তাদের কোনো সমস্যা ছিল না। জন্মের দুই বছর পরে মুক্তার মা হঠাৎ একদিন মুক্তার হাত ধরে। তখন মুক্তা ‘ব্যথা ব্যথা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। এ বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমি ভালো করে হাত দিয়ে দেখি ছোট একটা গুটি হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তার বুকে ওপরের দিকের একটি হাড় সামান্য একটু উঁচু ছিল। আমাদের ওখানে ভালো একজন হোমিও ডাক্তার আছে। শিশুদের যে অসুখই হোক না কেন, তিনি ওষুধ দিলে সেরে যেত। আমি মুক্তাকে ওনার কাছে নিয়ে যাই। তিনি বলেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। টিউমারের মতো হয়েছে, আর হাঁড় একটু বেড়েছে। আল্লাহর রহমতে ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। দেড় থেকে দুই বছর ওখানে চিকিৎসা করাই। ওষুধ খেলে ফোঁড়াটা কমে, না খেলে আবার বেড়ে যায়। মুক্তার বয়স যখন চার বছর তখন তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে আর্থোপেডিকের ডা. মাকসুদুল আলম সিদ্দিকীকে দেখাই। তিনি বলেন, গুটিটা আরো বড় না হলে বোঝা যাবে না। আমি তার কাছে পরামর্শ চাইলাম যে, এখন আমি কী করতে পারি। তখনও তিনি একই কথা বলেন, বড় না হলে বোঝা যাবে না। এরপর ডা. মাজেদুল হককে দেখাই। তিনি বলেন, ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তার ওষুধেও কোনো ফল না পেয়ে আর্থোপেডিকের আরেকজন ডা. ইব্রাহিম খলিলকে দেখাই।

মুক্তার বাবা আরো বলেন, যেখানে যে ডাক্তার, কবিরাজ, ওঝা দেখাতে বলছে, যার কথা শুনেছি, তার কাছেই মেয়েকে নিয়ে গেছি। সাড়ে নয় বছর থেকে বাড়তে থাকে। তারপরও সিআরপি, পঙ্গু, পিজিসহ অনেক জায়গায় দেখানো হয়েছে। কেউ বলেছে ক্যান্সার, কেউ বলেছে টিবি হয়েছে। কেউ বলেছে চর্ম রোগ। আবার কেউ অপারগতা প্রকাশ করেছে। কোনো ডাক্তারই রোগ ধরতে পারেনি। রোগ শনাক্ত না করেই ওষুধ দিয়ে গেছে। তাই ছয় মাস আগে চিকিৎসা বন্ধ করে দেই। তবে বেশিরভাগ চিকিৎসকদের অবহেলা লক্ষ করেছি। কেউই দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসা করেনি, দায়সারা।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ডাক্তাররা সঠিক রোগ নির্ণয় না করে ট্রিটমেন্ট দেওয়ায় মুক্তার আজ এ অবস্থা। আমি মনি করি, এমন জায়গায় (ঢামেক) যদি প্রথমে আমার মেয়েকে নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে আগেভাগে আল্লাহ সুস্থ করলেও করতে পারতেন। আমি গরিব মানুষ, আপনার কাছে গেলাম, আপনি তো আমাক সঠিক পরামর্শ দেবেন, তাই না? বহুত হয়রান হয়েছি। দেখেন, চোখের সামনে আমার এই সন্তান, সন্তানের দিক তাকালে মনে হয় না দুনিয়ায় বেঁচে থাকি। তারপরও কী করব বলেন। মেয়েকে নিয়ে ছুটছি, ছুটছি তো ছুটছি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জুলাই ২০১৭/সাওন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়