ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শাস্তির আওতায় আসছেন সচিবসহ ১৩ কর্মকর্তা

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২০ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাস্তির আওতায় আসছেন সচিবসহ ১৩ কর্মকর্তা

এম এ রহমান : হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিতে এবারে বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব ‍ও যুগ্মসচিবসহ ১৩ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশ আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয় ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য বা অভিযোগনামা চেয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ওই চাহিদার বিপরীতে তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগনামা তৈরি করা হচ্ছে। যা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র রাইজিংবিডিকে নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন রাইজিংবিডিকে বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলে মন্ত্রণালয় তাদের অভিযোগনামা চেয়েছে। আমাদের তদন্ত টিম মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুসারে অভিযোগনামা তৈরি করছে। যা এখনো তৈরি হয়নি। বর্তমানে তা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এর আগে চলতি বছরের ‍২ জুলাই ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা এবং ৪৬ ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠানসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পাশাপাশি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে দুদকের অনুসন্ধান টিম।

বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশে নাম উল্লেখ করা ১৩ কর্মকর্তা হলেন-পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ড. মোহাম্মদ আলী খান, যুগ্মসচিব (উন্নয়ন-১, হাওর) নুজহাত ইয়াসমিন, যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা অনু বিভাগ) মন্টু কুমার বিশ্বাস, পাউবোর মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর কবির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিওন) একেএম মমতাজ উদ্দিন। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কমিটির সাতজন হলেন যুগ্মসচিব কাজী ওবায়দুর রহমান, শামিম আরা খাতুন, মো. খলিলুর রহমান, উপসচিব নন্দিতা সরকার, মুহম্মদ হিরুজ্জামান, সহকারী প্রধান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ রাসেল ও মো. সিদ্দিকুর রহমান।

প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়েছিল, ১৩ কর্মকর্তা সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ যথা সময়ে শুরু ও শেষ করার ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধান, পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনে সীমাহীন অবহেলার কারণে বন্যার পানি ঢুকে এবার হাওরে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। নিয়ম অনুযায়ী পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি শুরুর আগেই ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করার কথা ছিল। বাস্তবে তা করা হয়নি। এতে হাওরের ফসল, মৎস্যসহ অন্যান্য সম্পদ ধ্বংস হয়েছে।

সুপারিশে আরো বলা হয়, রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬ অনুযায়ী সিনিয়র সচিব মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান, অধস্তন কার্যালয়গুলোর প্রধান হিসাবদানকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তরের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথা সময়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হয় তা নিশ্চিত করবেন। এ ক্ষেত্রে পাউবোর ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৫৬ দিন পর। একই সঙ্গে পাউবোর আওতাধীন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট কমিটি নিবিড়ভাবে তদারক করেনি। সময়মতো বাঁধ নির্মাণ না করার কারণেই দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে আরো বলেন, দুদক টিমের সুপারিশ আমলে নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট ভিত্তিতে অভিযোগগুলো তথ্য-প্রমাণসহ জানতে চেয়েছে। অর্থ্যাৎ কোনো কর্মকর্তা ঠিক কী কী অবহেলা বা দুর্নীতি করেছে তা স্পষ্ট করে জানতে চেয়েছে। যদিও দুদকের সুপারিশেও অনেক কিছু উল্লেখ ছিল। তারপরও এবারের অভিযোগনামায় আরো স্পষ্ট আকারে তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হবে। যাতে মন্ত্রণালয় যথাযথ বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

এদিকে দুদকের অনুসন্ধান পর্যায়ে সুনামগঞ্জ জেলার আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দুর্নীতি খুঁজে পাওয়ার পরপরই ২৩৯ স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) কমিটির সদস্য পদের তালিকা ও তাদের কাজের বিবরণসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে তলব করে। যদিও অধিকাংশ নথিপত্র এখনো দুদকে পাঠায়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। এমনটা অভিযোগ করেছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পিআইসি মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন থোক বরাদ্দের মাধ্যমে বাঁধের সংস্কার কাজ করে থাকে। প্রতি অর্থবছরে ওই কমিটির সদস্য সংযোজন ও বিয়োজন হয়ে থাকে। সাধারণত ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যা, স্থানীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক মনোনীত দুইজন, উপজেলা পরিষদ থেকে একজন কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক মনোনীত একজনসহ মোট পাঁচ থেকে সাত সদস্যের সমন্বয়ে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। সুতরাং হাওর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার দায় ওই কমিটির ওপর বর্তায় বলে দুদক জানায়।

চলতি বছরের ২ জুলাই হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে ৬১ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

মামলায় সুনামগঞ্জের হাওরে বন্যা আসার সার্বিক তথ্য জানার পরও তা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৪টি প্যাকেজের অসমাপ্ত কাজের জন্য নতুনভাবে টেন্ডার আহ্বান না করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও আগের ঠিকাদারদের কাজের অনুমতি দেওয়াসহ কাজ না করে বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

পাউবোর ১৪ আসামি হলেন-সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (বরখাস্ত) মো. আফছার উদ্দীন, সিলেট বিভাগের প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম সরকার, প্রাক্তন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই, সুনামগঞ্জের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, খলিলুর রহমান, সেকশন কর্মকর্তা মো. শহিদুল্যা, ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ খান, খন্দকার আলী রেজা, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শাহ আলম, মো. বরকত উল্লাহ ভূঁইয়া, মো. মাহমুদুল করিম, মো. মোছাদ্দেক, সজীব পাল ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লার ৪৬ জন ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের আসামি করা হয়েছে।

মামলার পরপরই সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (বরখাস্ত) মো. আফছার উদ্দীন ও ঠিকাদার বাচ্চু মিয়াসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুদক পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে উপপরিচালক আবদুর রহিম, সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি, সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ এবং উপসহকারী পরিচালক নেয়ামুল কাজী অভিযোগটি অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ পরিচালনা করছে।


**



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অক্টোবর ২০১৭/এম এ রহমান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়