ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঝুঁকিতে চালকল শ্রমিকরা

কাঞ্চন কুমার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২১, ২৪ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঝুঁকিতে চালকল শ্রমিকরা

কুষ্টিয়া সংবাদদাতা : একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চালকল শ্রমিকরা। তবে এর দায় নেন না কেউ।

দেশের সর্ববৃহৎ চালের মোকাম খ্যাত কুষ্টিয়ার খাজানগর। বর্তমানে এখানে ৩৫০টি চালকল রয়েছে। এখানে কর্মরত প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। যার ৭০ ভাগ নারী। তবে এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এখানে সবাই এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। হোক সেটা ভারি কিংবা হালকা কাজ।

এসব কাজের নেই যথাযথ মূল্যায়ন। দেশে প্রচলিত শ্রম আইনের বিধান এখানে কার্যকর নয়। নেই কাজের নিশ্চয়তা। আজ এখানে তো কাল সেখানে। না আছে নিয়োগপত্র। চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন শ্রমিকরা। দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত বা চিকিৎসা বাবদ মালিক পক্ষ মানবিক কারণে কিছু সাহায্য করেন। তবে এসব দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার শ্রমিকের পরিসংখ্যান দিতে পারেননি খোদ চালকল মালিক সমিতির নেতারা।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে বটতৈল, খাজানগর, কবুরহাট, দোস্তপাড়া, বল্লভপুর ও পোড়াদহ অঞ্চলের চালকলে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ২১৩ জন শ্রমিক। এ সকল রোগীর অধিকাংশই ছিল গুরুতর আহত।

দোস্তপাড়া এলাকার শ্রমিক আশরাফ জানান, চালকল শ্রমিকরা দুর্ঘটনার শিকার হলে অধিকাংশই সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন। প্রথম দিকে কিছু খরচ মিল মালিক করলেও পরে আর খোঁজ নেন না তারা। বাধ্য হয়ে আর্থিক সংকটে তারা ক্লিনিক থেকে বাড়ি চলে যান। বেঁচে থাকার তাগিদে মুখ বুজে কাজ করে চলেছেন যতক্ষণ জীবনীশক্তি দেহে আছে। দুর্বল হয়েছেন, তো ছিটকে পড়েছেন। অসুস্থ হয়েছেন তো বিনা চিকিৎসায় অনাহারে, অর্ধাহারে ধুকে ধুকে মরছেন। কোথায় কোন শ্রমিক না খেয়ে আছেন অথবা দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করে শয্যাশায়ী আছেন- তা দেখার কেউ নেই। 

পঙ্গুত্বের শিকার আলফাজের স্ত্রী খাদিজার অভিযোগ, তার স্বামী চার বছর আগে ট্রাক থেকে ধানের বস্তা নামানোর সময় মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে দুই মাস হাসপাতালে থেকে কোনো রকমে সুস্থ হয়ে ফিরলেও কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন শয্যাশায়ী। ওই সময় মিল মালিক কিছু ওষুধ কিনে দিলেও পরে আর খোঁজ নেননি। এখন তাকে রাত দিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করে সংসারের খাওয়ার জোগাড় করতে হয়।

খাজানগর স্বর্ণা অটো রাইচ মিলে কর্মরত শ্রমিক আশরাফ জানান, এই মোকামে সম্প্রতি অটো মিলের সংখ্যা দিন দিন রাড়ছে। এতে শ্রমিকের সংখ্যা কমতির দিকে। যারা কাজ করছেন, তাদের যদি স্বয়ংক্রীয় যান্ত্রিক মিলে কাজের দক্ষতা থাকে, কেবল তারাই কিছু সংখ্যক নিয়োগপত্রসহ কাজ করতে পারছেন। এর বাইরে অধিক সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে সাধারণত মালামাল লোড-আনলোডের। এসব শ্রমিকের কাজ অধিক পরিশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এর দায়-দায়িত্ব তাদের নিজেদের। তারা ডে-লেবার হিসেবে কাজ করে থাকেন। এদের একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ ৫০ বস্তা ধান/চাল গাড়ি থেকে গুদাম অথবা গুদাম থেকে গাড়িতে লোড-আনলোড করে বস্তা প্রতি ৫ বা ৭ টাকা হারে মজুরি পান। 

চালকল শ্রমিক কামিরুল জানান, ধান থেকে চাল বাজারজাত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিরতিহীন কর্মধারায় নিযুক্ত থাকতে হয় শ্রমিকদের। সেই কারণে এই কাজে থাকতে হলে কোনো আপত্তি চলবে না। এমনকি অসুস্থ হলেও কাজ শেষ করেই তাকে চুক্তি নির্ধারিত মজুরি নিতে হবে। মাঝামাঝি কাজ ফেলে গেলে তার মজুরি নেই।

তিনি আরো জানান, খাজানগরের চালকল শ্রমিকরা যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজই করুক না কেন, কর্মকালীন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থ যাই হোক, তার সব দায়িত্ব শ্রমিকের। গত পাঁচ বছরে তার দেখা অন্তত ১৫টি মিলের শ্রমিকদের মধ্যে দুর্ঘটনায় ১৩ জন নারী-পুরুষ এখন স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। 

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার সরকার জানান, ভারি বোঝা বহন করার সময় দুর্ঘটনার শিকার অথবা স্পাইন করোনারির সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন শ্রমিকরা। এসব রোগীর সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের সংখ্যা কম। একদিকে তারা অপুষ্টিতে থাকে, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত ভারি বোঝা বহন করতে গিয়ে এসব স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হন। চিকিৎসা নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিণতি হয় স্থায়ী পঙ্গুত্ব।



রাইজিংবিডি/কুষ্টিয়া/২৪ নভেম্বর ২০১৭/কাঞ্চন কুমার/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়