তিনটি দেশের তথ্য দুদকে, অনুসন্ধানে নতুন গতি
এম এ রহমান মাসুম : আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির ঘটনায় অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাস্ট্রের নথিপত্র এখন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
এ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশের যে সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম এসেছে, তাদের কয়েকজনের আংশিক তথ্য সম্প্রতি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এসে পৌঁছছে। নতুন এ তথ্যের ফলে দুদকের অনুসন্ধানে নতুন গতি পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা পানামা পেপার্সের তালিকায় আসা বাংলাদেশি বেশ কয়েকজনের বিষয়ে বিভিন্ন দেশে তথ্য জানতে চিঠি দিয়েছিলাম। অনেক দেশ থেকে এখনো চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, অমেরিকা ও যুক্তরাজ্য থেকে চিঠির উত্তর পেয়েছি। চিঠির উত্তর পাওয়া গেলেও এখনো মেলেনি কাক্ষিত তথ্য। তবে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা এখন যাচাই-বাছাই চলছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমদের প্রেরিত চিঠির বিষয়ে ওই সব দেশ থেকে বলা হয়েছে আমরা যেন ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে অবগত করি। তা না হলে অর্থপাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের যে অভিযোগের কথা দুদক বলছে সেই তথ্য তারা দিতে পারবে না। আমরা এখন তাদের নির্দেশনা অনুসারে ওই সব ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি।’
পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদক এ পর্যন্ত ১৮ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর্নধারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পানামা পেপার্সের কাজ আমরা এখনো শেষ করতে পারিনি। মানুষের মনে একটি ধারণা থাকতে পারে- এতদিন ধরে দুদক কী করছে। সমস্যা হচ্ছে, মানিলন্ডারিং যখন হয় তখন কারো কাছে তথ্য থাকলেও হুট করে তা পাওয়া যায় না। একটা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটাকে বলে এমএলএআর (মিচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্ট রিকোয়েস্ট) পাঠানো। আমরা এটি একাধিকবার পাঠিয়েছি, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উত্তর মেলেনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, সাত বা আট বছর লেগেছে উত্তর পেতে। আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল বা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বারবার তাগিদ দিয়েছি। আবার অনেকে উত্তর দিচ্ছে যে, উনি ওই দেশের নাগরিক। তাই তথ্য দেওয়া যাবে না। এসব নিয়ে আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করছি।’
২০১৬ সালের প্রথম দিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) `পানামা পেপারস` নামে নথি প্রকাশ করে। যেখানে এক কোটি ১০ লাখ নথি ফাঁস করা হয়। ওই তালিকায় বিশ্বের কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানসহ শতাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রমাণ রয়েছে। যেখানে ৩৪ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে।
এরপর ওই বছরের ৭ এপ্রিল দুদকের উপপরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভূঁঞাকে প্রধান করে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছিল। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, দুদকের সহকারী পরিচালক মজিবুর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাত।
জার্মান দৈনিক জিটডয়েচ সাইতংয়ের অনুসন্ধানী সাংবাদিক বাস্তিয়ান ওবারমেয়ারের হাতে এসব নথি আসে। তারা এটাকে তুলে দেন আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সংস্থা আইসিআইজের কাছে। পরবর্তীকালে বিশ্বের ৭৮টি দেশের ১০৭টি সংবাদমাধ্যম এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে তা প্রকাশ করে।
এ বিষয়ে বিশ্ব মিডিয়ার বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির ঘটনার কবলে পড়ে ইতোমধ্যেই জনগণের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন মধ্য আমেরিকার দেশ আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফ, অমিতাভ বচ্চনসহ অনেকেরই নাম উঠে এসেছে।
কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত এ কেলেঙ্কারিতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৪ জন ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশিত হয়েছে। যাদের বিপরীতে মোট ৪৫টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এদের মধ্যে ২৩ জনের বাড়ির ঠিকানাও উল্লেখ আছে।
আইরিশ টাইমসের ডিজিটাল প্রোডাকশন বিষয়ক সম্পাদক ব্রায়ান কিলমার্টিনের তৈরি গ্রাফিকস ম্যাপে বাংলাদেশের ২৫ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও বেনিফিশিয়ারির নাম এসেছে। এর মধ্যে ২২ শেয়ারহোল্ডার, ১ সুবিধাভোগী ও ২ কোম্পানির কথা জানানো হয়েছিল।
আইসিআইজের হস্তগত গোপন নথি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রভাবশালী ক’জন ব্যবসায়ী বিদেশে কোম্পানি স্থাপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা, মার্কেন্টাইল কর্পোরেশন, ইউনাইটেড গ্রুপ অব কোম্পানিজ, স্কয়ার গ্রুপ অব কোম্পানিজ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, মমিন টি, সি পার্ল লাইন্স, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার, মাসকট গ্রুপ অব কোম্পানিজ, সেতু কর্পোরেশন, স্পার্ক লিমিটেড ও অমনিকেম লিমিটেড এবং অনন্ত গ্রুপের প্রাক্তন ও বর্তমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৩৪ ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসে। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান, ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, বাংলাদেশের নিউ এইজসহ ৭৮টি দেশের ১০৭টি সংবাদমাধ্যম এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করে।
যদিও তৎকালীন দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল রাইজিংবিডিকে জানিয়েছিলেন, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশের যে সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম এসেছে, কমিশনে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানে আনুষ্ঠানিক নথি খোলা হয়েছে। তবে দুদক আপাতত ওই সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অন্যান্য দুর্নীতির বিষয়টি অনুসন্ধান করবে। এর সঙ্গে যদি কর ফাঁকি চলে আসে তাহলে সে বিষয়টি এনবিআরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ নভেম্বর ২০১৭/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন