ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফের দখল হচ্ছে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০০, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফের দখল হচ্ছে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড

আহমদ নূর : দূর থেকে তাকালে মনে হয়, রেলক্রসিংয়ে গাড়ি আটকাতে প্রতিরোধক (ব্যারিয়ার) দেওয়ায় সড়কে দীর্ঘ যনজটের সৃষ্টি হয়েছে। তবে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যায় অন্য চিত্র।

সড়কে অবৈধভাবে ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান রাখা হয়েছে। ফলে গাড়ি চলাচলের পথ সংকুচিত হওয়ায় অন্য যানবাহনগুলো ঠিকভাবে চলতে পারছে না। এতে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের তাজউদ্দীন আহমদ সরণী মোড় থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিংয়ের চিত্র এটি। অথচ সপ্তাহখানেক আগেও এই সড়কের চিত্র ছিল ভিন্ন। এখানে যানজট ছিল না। এই পথ ব্যবহারকারীরা স্বাচ্ছন্দে যাতায়াত করতেন। এখানে ছিল না ভারী যানবাহনের পার্কিং।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মেয়র আনিসুল হকের সাহসী ভূমিকায় পাল্টে যায় তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের দৃশ্য। কিন্তু তার মৃত্যুর পর আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে দখলদাররা। বৃহস্পতি ও শুক্রবার সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব চিত্র দেখা যায়।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তেজগাঁওয়ের তাজউদ্দীন আহমদ সরণী, রেলক্রসিং, ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর সামনের রাস্তা, সিএসডি গুদামের ২ নম্বর গেট, বিজি প্রেস স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সব সড়ক ট্রাকের দখলে। মূল রাস্তায় সন্ধ্যার পর থেকে একে একে ট্রাক-কার্ভার্ড ভ্যান এনে রাখা হচ্ছে। কোথাও এক সারি আবার কোথাও দুই বা তিন সারিতে গাড়ি রাখা হচ্ছে। রাতের গভীরতা যত বাড়তে থাকে ওই এলাকায় ভারী যানবাহনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সড়ক চলে যায় ট্রাকের দখলে।

গাড়ি রাখার পর সড়কের যে জায়গা ফাঁকা থাকে তাতে একটি ছোট গাড়ি বা রিকশা কোনোমতে চলতে পারে। তবে দুটি বাহন একসঙ্গে গেলে জটলা বেঁধে যায়।

জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তর সামনের রাস্তায় গিয়ে দেখা গেছে, গোটা সড়ক জুড়ে রাখা হয়েছে ছোট বড় আকারের ট্রাক। একটি সড়কদ্বীপের তিন পাশের সড়কের দুপাশেই ট্রাক দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সাতরাস্তা মোড়ের এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির সামনে ও উল্টো পাশে, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনে এবং রেলক্রসিংয়ের আগে সড়কের পাশে এক সারি, কোথাও দুই সারি করে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।

 



তেজগাঁওয়ের সিএসডি ভাঙা গেট থেকে শুরু হয়েছে গাড়ি মেরামতের দোকানের সারি। এছাড়া, মদিনা মসজিদের সামনের সড়কের পুরোটাই দখল করে নিয়েছে মেরামতকারীরা। সড়কে জমে আছে ধুলাবালি। গাড়ির তেল-মবিল সড়কে পড়ে হয়েছে বেহাল দশা। সড়কের অনেক জায়গা ভেঙে গেছে। পায়ে হেঁটে এই সড়কে চলাচল করতে প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন পথচারীরা।

তেজগাঁও এলাকায় রাখা ট্রাক-কার্ভার্ড ভ্যান-পিক্যাপ মালিকদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ গাড়ির মালিক বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির। এছাড়া ব্যক্তিমালিকাধীন ট্রাক কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ রয়েছে। এসব এজেন্সির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মেসার্স নজরুল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি, মে আই কে এন্টারপ্রাইজ, তিতাস ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি।

এখন প্রশ্ন উঠছে- কেন হঠাৎ বদলে গেল এই সড়কের অবস্থা? সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে কেন অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড দখল করা ও সড়কে গাড়ি পার্কিং করা হয়েছে?

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়ক ও আশপাশের সড়কগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ট্রাক রাখাতে তেজগাঁওয়ে রেলওয়ের খালি জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এরপর সাতরাস্তা থেকে রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের উন্নয়ন করে রোড ডিভাইডারে (সড়ক বিভাজক) গাছ লাগানো হয়। কয়েক যুগ ধরে বেদখল হয়ে থাকা সড়কটি দখলমুক্ত হওয়ার পর সুফল পেতে শুরু করে নগরবাসী। এই এলাকা ট্রাকের অবৈধ পার্কিং থেকে মুক্ত করতে তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক লড়েছেন অনেক। ওই এলাকা দখলমুক্ত করতে মেয়র যে অভিযান চালিয়েছিলেন, তাতে তিনি ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়েন। অবরুদ্ধ করে রাখা হয় তাকে। তারপরও তিনি তেজগাঁও এলাকা দখলমুক্ত করতে পেরেছিলেন। যদিও পরে কয়েকবার তেজগাঁওয়ের ট্রাকস্ট্যান্ড দখল নিতে চেয়েছিল ট্রাক মালিক ও শ্রমিকরা। সম্প্রতি মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর পুনরায় ট্রাকের দখলে চলে যাচ্ছে তেজগাঁও এলাকা।

তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে কথা হয় চালক মহসিনের সঙ্গে। তিনি জানান, অন্য কোথাও গাড়ি রাখার জায়গা নেই বলে তারা এখানে গাড়ি রাখছেন। মেয়র বলেছিলেন, গাবতলীতে তাদের জন্য একটি ট্রাক টার্মিনাল করে দেবেন। কিন্তু করে দেননি। এজন্য তারা তেজগাঁও এলাকায় গাড়ি রাখছেন।

মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে কেন তারা তার উদ্ধার করা ট্রাকস্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো উপায় ছিল না। তাই চলে এসেছি। তিনি খুব স্ট্রিক্ট ছিলেন। এখন কেউ কিছু বলছে না। কারো কষ্ট হলে আমাদের কী করার আছে? আমাদেরও তো কোথাও থাকতে হবে।

রাত ৯টার দিকে সাতরাস্তা মোড় হয়ে ফার্মগেটে যাচ্ছিলেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ট্রাকস্ট্যান্ড তুলে দেওয়ার পর এই রাস্তাটা অনেক ভালো ছিল। ভালোভাবে চলাচল করা যেত। এখন আবার ট্রাকস্ট্যান্ড হয়েছে। গোটা রাস্তা তারা দখল করে নিয়েছে।

 



বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জুনাইদ হোসেন এই রাস্তায় চলাচলের ১৫ দিন আগের অবস্থা ও গত ৩ দিনের অবস্থার পার্থক্য তুলে ধরে বলেন, মেয়র নাই, তাই দখল শুরু হইছে। এদের ব্যাপারে অ্যাকশন নেওয়া উচিত।

রাস্তা দখল করে গাড়ি পার্কিংয়ের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও জোনে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের করার কিছু নাই’।

তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে দিনের চিত্র :
বৃহস্পতিবার দিনে তেজগাঁও এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, মূল সড়কে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান পার্ক করে রাখলেও তা সংখ্যায় কম। তবে ট্রাকস্ট্যান্ড ও তেজগাঁওয়ের অলিগলিতে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান রাখা হয়েছে। এতে দিনের বেলা গলিগুলোতে রিকশা পর্যন্ত ঢুকতে বেগ পোহাতে হয়। পথচারীরা ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না।

রিকশাচালক মাহি উদ্দীন অভিযোগ বলেন, তারা বড় গাড়ি চালায়। কিছু বলাও যায় না। বললে ধমক দেয়।

পথচারী আশিকুর রহমান বলেন, গলির ভেতরে তারা ট্রাক রাখছে। ঠিকমতো হাঁটাই যায় না। তার উপর রাস্তায় ধুলাবালি বাড়ছে। অসুখ-বিসুখও বাড়ছে। এর একটা প্রতিকার হওয়া উচিত।

রাতের সাতরাস্তা টু মহাখালী :
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাতরাস্তা থেকে মহাখালী পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, শাহ ফাতেহ আলী, একতা, নিরালা, সোনার বাংলা, মহানগর, বিনিময়, নিরালা সুপার পরিবহনসহ দূরপাল্লার বাসগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে ট্রাক, বিভিন্ন পরিবহন এজেন্সি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাভার্ড ভ্যানও রয়েছে।

বাসের সহকারী জসিম রাইজিংবিডিকে বলেন, টার্মিনালে জায়গা না পাওয়ায় সড়কে বাস দাঁড় করিয়ে রেখেছি। যখন ট্রিপের সময় হবে তখন চলে যাব।

 



ছিনতাইয়ের উৎপাত বাড়ার আশঙ্কা :

সড়কে ভারী যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখায় ছিনতাইয়ের উৎপাত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা বলছেন, যারা রাতে এই পথ দিয়ে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যান, তারা যেকোনো সময় ছিনতাইকারী, টানা পার্টির কবলে পড়তে পারেন।

মামুন হোসেন নামের একজন বলেন, মনে করুন, আপনার সাথে থাকা ব্যাগ টান দিয়ে কেউ দৌড়ে পালিয়ে গেল। তখন আপনি কী করবেন? যদি রাস্তা ফাঁকা থাকত তাহলে তার পেছনে দৌঁড়াতেন। কিন্তু এখানে রাস্তায় যে অবস্থায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, ছিনতাইকারী মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যাবে। কেউ টের পাবে না।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্যানেল মেয়র ওসমান গনি বলেন, খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ডিসেম্বর ২০১৭/নূর/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়