জালিয়াতি বন্ধে এবার ডিজিটাল কোডের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট
বর্তমান ম্যানুয়াল মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট। সঙ্গে ‘নমুনা’ ডিজিটাল আইডি কার্ডের চিপের ডিজাইন।
হাসান মাহামুদ : মুক্তিযোদ্ধা সনদ জাল করে অনেক অসাধু ব্যক্তি সুবিধা গ্রহণের অপচেষ্টা করেন। এ ধরনের অপচেষ্টা এবং সুবিধাগ্রহণ বন্ধে, এ সংক্রান্ত সব ধরনের জালিয়াতি ঠেকাতে এবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল কোড সম্বলিত মেশিন রিডেবল ডিজিটাল সার্টিফিকেট দেবে সরকার।
জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান নিশ্চিত করতে সম্মানী ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। এসব সুবিধা গ্রহণ করার জন্য তাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারও অভাব নেই। এমনকি এদের দৌরাত্মও অনেক বেশি। তাই মেশিন রিডেবল ডিজিটাল সার্টিফিকেটের পাশাপাশি ডিজিটাল আইডি কার্ডও দেওয়া হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের জন্য এতোদিন উদ্যোগটি ধীরগতিতে ছিল। বিজয়ের মাসেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এবার ডিজিটাল সার্টিফিকেট এবং আইডি কার্ড প্রস্তুত ও বিতরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ডিজিটাল সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। একবছর কার্যক্রম চালু থকার পর ২০১৪ সালের জুন মাসে দুয়েকটি জেলায় ‘ডিজিটাল স্বাক্ষর সার্টিফিকেট’ বিতরণ করা হয়। কিন্তু তখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এবং মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় সেই উদ্যোগ ও কার্যক্রম। তখন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার গঠিত হওয়ার পর আবারো সেই উদ্যোগের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু এবারো দেশব্যাপী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রম চলায়, বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সময় নেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক মাসে এই কার্যক্রম বন্ধ ছিল না। ডিজিটাল সার্টিফিকেট এবং আইডি কার্ড-এর ডিজাইন ও বৈশিষ্ট্য চূড়ান্তকরণে মিটিং হয়েছে, প্রাথমিকভাবে কয়েকটি ডিজাইন নিয়ে কাজ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আট ধরনের ডিজিটাল কোড সম্বলিত সার্টিফিকেটের নমুনা প্রস্তুত করে চূড়ান্ত মতামত ও চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাননি, তাই ডিজাইনের বিষয়টি ছাড়া অন্যসব কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটা তৈরি করা হচ্ছে। টাকা জাল করা সম্ভব হলেও এ সনদ জাল করা সম্ভব হবে না। ডিজিটাল কোড সম্বলিত মেশিন রিডেবল ডিজিটাল সার্টিফিকেট এবং আইডি কার্ড প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ বসানো কোন ভাবেই সহ্য করা হবে না। এজন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কোন জেলায় কতজন : জেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাস সরকারিভাবে সংরক্ষিত না থাকায়, নিজ জেলায় কতজন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, সেটাই অনেকে জানেন না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ঢাকায় ৫ হাজার ১৭৪ জন, নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ৪৫৪ জন, গাজীপুরে ৩ হাজার ৮১ জন, মুন্সীগঞ্জে ২ হাজার ৩০৪ জন, মানিকগঞ্জে ১ হাজার ৮৬৬ জন, নরসিংদীতে ৪ হাজার ৭৮৩ জন, টাঙ্গাইলে ৮ হাজার ৩৯৩ জন, ফরিদপুরে ৩ হাজার ৯শ’ জন, মাদারীপুরে ২ হাজার ৫৭৩ জন, শরীয়তপুরে ২ হাজার ১২১ জন, রাজবাড়ীতে ১ হাজার ২২৪ জন, গোপালগঞ্জে ৫ হাজার ৮২৮ জন।
ময়মনসিংহে ৫ হাজার ৬৩৫ জন, কিশোরগঞ্জে ৩ হাজার ৬০২ জন, নেত্রকোনায় ৩ হাজার ৫৮ জন, জামালপুরে ২ হাজার ৪১৩ জন, শেরপুরে ১ হাজার ৩৩৫ জন।
বরিশালে ৬ হাজার ৫৮১ জন, পিরোজপুরে ২ হাজার ৮৩৪ জন, ঝালকাঠিতে ১ হাজার ৯৭৬ জন, ভোলায় ১ হাজার ৪৭৪ জন, পটুয়াখালীতে ১ হাজার ২০২ জন, বরগুনায় ১ হাজার ১৯৫ জন।
চট্টগ্রামে ৮ হাজার ১৬ জন, কক্সবাজারে ৩৪০ জন, নোয়াখালীতে ৪ হাজার ৯৬৩ জন, ফেনীতে ২ হাজার ৯০৮ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৭৮৮ জন, কুমিল্লায় ৬ হাজার ২৫৮ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬ হাজার ৭৯৯ জন, চাঁদপুরে ৩ হাজার ৫৬৯ জন, রাঙ্গামাটিতে ১৫১ জন, বান্দরবানে ১৪৯ জন, খাগড়াছড়িতে ৫৫৬ জন।
সিলেটে ৪ হাজার ২৫৭ জন, মৌলভীবাজারে ১ হাজার ৫৮৯ জন, সুনামগঞ্জে ৪ হাজার ২১ জন, হবিগঞ্জে ২ হাজার ৯৬ জন।
রাজশাহীতে ২ হাজার ৪৭৪ জন, নওগাঁয় ৩ হাজার ৬৭ জন, নাটোরে ১ হাজার ৪৭১ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ হাজার ১২৯ জন, পাবনায় ২ হাজার ৭২৫ জন, সিরাজগঞ্জে ৩ হাজার ২৫৫ জন, বগুড়ায় ৩ হাজার ৮৯ জন, জয়পুরহাটে ৭৭৯ জন।
রংপুরে ১ হাজার ৩১৭ জন, গাইবান্ধায় ২ হাজার ৮৭ জন, কুড়িগ্রামে ৪ হাজার ২১২ জন, নীলফামারীতে ৯৪৩ জন, লালমনিটরহাটে ১ হাজার ৯৪২ জন, দিনাজপুরে ৩ হাজার ৭০৬ জন, ঠাকুগাঁওয়ে ১ হাজার ৫১১ জন, পঞ্চগড়ে ১ হাজার ৯৫৮ জন।
খুলনায় ১ হাজার ৮২০ জন, বাগেরহাটে ৪ হাজার ৬শ’ জন, সাতক্ষীরায় ২ হাজার ২৮৩ জন, যশোরে ২ হাজার ৮৭৮ জন, মাগুরায় ১ হাজার ৬৮৩ জন, ঝিনাইদহে ২ হাজার ১০৭ জন, নড়াইলে ২ হাজার ৩৫৬ জন, কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার ৯৫ জন, চুয়াডাঙ্গায় ১ হাজার ৪৭৮ জন, মেহেরপুরে ৯৬৮ জনসহ মোট ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৪ জন তালিকাভুক্ত। এই মুক্তিযোদ্ধারাই শ্রেনী অনুযায়ী ভাতা পাচ্ছেন।
এর বাইরে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর গেজেটের মাধ্যমে সাতজনকে বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জনকে বীর উত্তম, ১৭৫ জনকে বীর বিক্রম এবং ৪২৬ জনকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। ২০১১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বিভিন্ন বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হয়। এই সুবিধা পাচ্ছিলেন সেনাবাহিনীর ২৫১ জন, নৌবাহিনীর ২১ জন, বিমানবাহিনীর ২৩ জন, বিজিবির ১১৮ জন এবং আনসারের একজন সদস্য। কিন্তু খেতাবপ্রাপ্ত বেসামরিক ২১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আগের হারে ভাতা পাচ্ছিলেন। এটি সমন্বয় করতে ২০১৩ সালের ২২ জুলাই খেতাবপ্রাপ্ত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হয়।
তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে যেসব সুবিধা পান: প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত মাসিক সম্মানী ভাতা পান, রেশন পান। রেশনে চার সদস্য বিশিষ্ট যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ৩৫ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, ৫ কেজি চিনি, ৮ লিটার ভোজ্য তেল, ৮ কেজি ডাল দেওয়া হয়।
প্রত্যেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা মাসে ১০ হাজার টাকা করে পান। এই হিসেবে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতি মাসে সম্মানী ভাতা বাবদ মোট ১৮৪ কোটি ৩৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এর বাইরে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা মাসিক ৩০ হাজার টাকা, বীর উত্তমদের ভাতা ২৫ হাজার টাকা, বীর বিক্রমদের ভাতা ২০ হাজার টাকা এবং বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের ভাতা ১৫ হাজার টাকা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের ভাতা ৩৫ হাজার টাকা।
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবার মিলিয়ে মোট ৮ হাজার ৫১৪ জনকে ভাতা দেওয়া হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া শুরু হয় ২০১৩ সাল থেকে।
এছাড়া তাদের সন্তানদের শিক্ষা ভাতা, বিবাহ ভাতা, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা খরচ, প্রীতিভোজ, উৎসব ভাতা, সরকারি যানবাহনে ফ্রি যাতায়াত, বছরে একবার বিনোদন ভ্রমণের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের মেধাবী সন্তান ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের লেখাপড়ায় সহায়তা ও উৎসাহ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরতদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৮শ’ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি প্রদান করেছে। এ প্রক্রিয়ায় অংশ হিসেবে প্রতিবছর ৬শ’ জন করে সর্বমোট ৩ হাজার জনকে এ বৃত্তি প্রদানের সংস্থান করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ওপর দেশের অভ্যন্তরে ‘পিএইচডি’ করার জন্য দুই জনকে পূর্ণ বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধাহত ও মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে (অনধিক ২ কন্যা) প্রতি কন্যার জন্য এককালীন ১৯ হাজার ২শ’ টাকা হারে আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। ভাতাভোগী যুদ্ধাহত ও মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে দুটি ঈদে মূল ভাতার সমপরিমাণ ঈদ বোনাস প্রদান করা হয়ে থাকে।’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন