ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এবারের স্বাধীনতা দিবসের উপহার আশুগঞ্জে মিত্রবাহিনী স্মৃতিস্তম্ভ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২১, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এবারের স্বাধীনতা দিবসের উপহার আশুগঞ্জে মিত্রবাহিনী স্মৃতিস্তম্ভ

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি মুহূর্ত

হাসান মাহামুদ : স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই সহযোগিতার স্বীকৃতি বাংলাদেশ সরকার সবসময় দিয়ে আসছে। এবার তাতে যোগ হতে যাচ্ছে আরেকটি স্বীকৃতি। যুদ্ধে নিহত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর স্মৃতি রক্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ চলছে। আগামী বছরের স্বাধীনতা দিবসে মিত্রবাহিনীকে এই স্মৃতিস্তম্ভ উপহার দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকার, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও জনগণের অবদান বিশেষ করে ভারতীয় শহীদ সেনাসদস্যদের স্মরণের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছে সরকার। মিত্রবাহিনীর সব শহীদ সদস্যের নাম স্মৃতিফলকে খচিত থাকবে। আগামী বছরের স্বাধীনতা দিবসে এই স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করার লক্ষ্য নিয়ে চলছে এর নির্মাণকাজ।

প্রসঙ্গত, ভারতীয় মিত্রবাহিনীদের স্মৃতি রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি ছিল স্থানীয়দের। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধের স্থান পরিদর্শন যান। তখনই তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর স্মরণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে’।

এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে এটি প্রথমবারের মতো উদ্যোগ। এ স্মৃতিস্তম্ভে পার্ক, আন্ডারপাস, ফুডকোর্ট ও বিদ্যুতের সাব-স্টেশনসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত থাকবে। মিত্রবাহিনীর সদস্যদের জন্য এর আগে কাগজে-কলমে বা ফরমাল আর কোনো স্মৃতিস্তম্ভ হয়নি। আশা করা হচ্ছে, এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত সরকার, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও জনগণের অবদান ব্যাপক। বিশেষত গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সম্মুখ সমরে শহীদ ভারতীয় সেনাসদস্যদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর তিন শতাধিক সেনা শহীদ হন। এই সেনাদের স্মরণে আজ পর্যন্ত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সবসময় ওই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আশুগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়েছে—এমন তথ্যের ভিত্তিতে মিত্রবাহিনী আশুগঞ্জ দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আশুগঞ্জে তখনো পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তত তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন অবস্থান করছিল। ৯ ডিসেম্বর দুপুরের পর মিত্রবাহিনী আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেয়ালের ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়ে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন মিত্রবাহিনীর ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রসংলগ্ন সোহাগপুর গ্রামে একপেশে হামলার শিকার হয় মিত্রবাহিনী। অল্প সময়ের মধ্যে চার সেনা কর্মকর্তাসহ মিত্রবাহিনীর তিন শতাধিক সেনা শহীদ হন। ধ্বংস হয় মিত্রবাহিনীর তিনটি ট্যাংক। একপর্যায়ে অবশিষ্ট পাঁচটি ট্যাংক নিয়ে পিছু হটে মিত্রবাহিনী।

এ সময় পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীকে ধাওয়া করলে উপজেলার দুর্গাপুর এলাকায় দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গ্রামবাসীও লাঠিসোটা নিয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। ওই দিন সন্ধ্যার মধ্যেই মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়। এই যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সেনাসদস্যরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের সেই ত্যাগ স্মরণে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত এবং উৎসর্গ করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ভেতরে সম্মুখযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ হয়েছেন আশুগঞ্জে। এ কারণে আশুগঞ্জেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশুগঞ্জে শহীদ ভারতীয়দের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির নির্মাণকাজ করছে গণপূর্ত বিভাগ। প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে অমলিন হয়ে থাকবে। আশুগঞ্জের যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় আশুগঞ্জেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রকল্পটির অনুমোদনের আগেই স্মৃতিস্তম্ভের নকশা তৈরি করা হয়। সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলছে। ২০১৮ সালের স্বাধীনতা দিবস বা দিবসের আগেই এই স্মৃতিস্তম্ভের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১ হাজার ৯৮৪ জন ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ হন। এর মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৭৬৯, নৌবাহিনীর ২০৪ ও বিমানবাহিনীর ১১ জন সদস্য রয়েছেন। তবে ভারত সরকারের পাঠানো নামের তালিকা অনুযায়ী ১ হাজার ৭০০ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ২৮৪ জনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

উদ্বোধন হতে পারে বিদ্যুকেন্দ্র এলাকার স্মৃতিফলকও : একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে তিন শতাধিক মিত্রবাহিনীর সৈন্য শহীদ হন। এসব শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে। এতে ব্যয় হয় ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় চার বছরেও এটি উদ্বোধনের মুখ দেখেনি। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এই স্মৃতিফলকটিও উদ্বোধন করা হতে পারে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়