ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ইতিহাসে, প্রচারে, প্রকাশনায় নারীযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা অবহেলিত

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইতিহাসে, প্রচারে, প্রকাশনায় নারীযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা অবহেলিত

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের একটি দুর্লভ স্থিরচিত্র

হাসান মাহামুদ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বস্তরের জনগণের যুদ্ধ। নারীরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন সাহসের সঙ্গে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন, যোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেন গোপন খবর। কাজ করেন চিকিৎসক হিসেবে, সেবিকা হিসেবে। কিন্তু স্বাধীনতার নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাসে, প্রচারে কিংবা প্রকাশনায় সবসময় থেকে গেছে অবহেলিত।

ফলে এখনো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে নারীদের উপস্থাপন মানেই পাকিস্তানী সেনাদের হাতে নিগ্রহের ভিডিও, পুস্তক-ইতিহাস কিংবা বক্তব্যে এখনো নারী মানেই ‘মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা’ এ জাতীয় কথা। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের উজ্জ্বল স্বীকৃতি নেই। অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধার কথা ইতিহাসে আসলেও মাত্র দুজন পেয়েছেন উপাধি। এখনো সরকারিভাবে নির্দিষ্ট করে প্রকাশ করা যায়নি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীদের সংখ্যা। এমনকি সরাসরি যুদ্ধের বাইরে নারীরা করেছে যুদ্ধের আনুষাঙ্গিক যেসব কাজ, অবদান রেখেছে, সে সবের স্বীকৃতি মিলেছে খুব কম।

মুক্তিযুদ্ধ কথাটি ভাবলেই অস্ত্র হাতে পুরুষদেরই ভাবা হয়। নারীরা যে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তা বলা হয় না। নারীদের অবদানের কথা প্রমাণ করে দেখাতে হয়। ১৫ খণ্ড মুক্তিযুদ্ধের দলিল পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানেও নারীদের অবদান খুব বেশি আসেনি। যারা সীমান্তের ওপারে সাহায্য করেছেন তাদের নাম রয়েছে এতে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীদের নাম খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।

স্বাধীনতার এতো বছর পরও নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি সম্মান দেখানোর কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দেশের জন্য যাদের এতোবড় ত্যাগ তারা বরাবরই রয়ে গেছেন উপেক্ষা আর অবহেলার কাতারে। এদের নেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ, তৈরি হয়নি নামের তালিকাও। সামাজিক মনস্তত্ত্বের কারণে এদের বিবেচনা করা হয়েছে শুধু ধর্ষিতা বলে।

মু্ক্তিযুদ্ধের কিছু ইতিহাসগ্রন্থ পর্যালোচনা, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব নারীর ওপর সহিংসতা হয়েছে, যারা ধর্ষিতা বা নির্যাতিতা হয়েছেন তাদের বিভিন্ন দেশে বিশেষ মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো উদ্যোগই কখনো নেওয়া হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধে নারী ছিল সাহসী সৈনিক হিসেবে: মুক্তিযুদ্ধের দলিলে ও বিভিন্ন পুরুষ গ্রন্থাকারের রচনায় নারী স্বীকৃতি না পেলেও এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের নারীরা অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রামের একজন সাধারণ নারীও দেশের জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখেই যুদ্ধে নেমেছেন। শুধু সামনা সামনি যুদ্ধ করা নয়, নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের জন্য ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে রান্না করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সঙ্গে নিজের ঘর সামলেছেন।

ইতিহাস বলে, যুদ্ধের সময় একজন নারী যতগুলো ভূমিকায় আসতে পারে, একজন পুরুষ তা পারে না। নারীর অবস্থানকে চারভাবে দেখা যায়। সরাসরি যুদ্ধ করা, যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহায়তা করা, সংসার টিকিয়ে রাখা এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া। এসব বিষয় অনেকের অজানা বলেই ইতিহাসে নারীদের অবদানের মত এতবড় একটা ক্ষেত্রও থেকে যায় উপেক্ষিত।

মাত্র দুজন পেয়েছেন উপাধি: ১৯৭৩ সালে ৬৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার মধ্যে নারী ছিলেন মাত্র দুজন। তাদের বীরত্বপূর্ণ ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তারা হলেন, তারামন বিবি এবং মেডিক্যাল কোরের চিকিৎসক সেতারা বেগম।

হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘদিন তারামন বিবি শুধু সরকারি গেজেটেই বীর প্রতীক ছিলেন। তিনি জানতেন না এবং এ বিষয়ে কোনো প্রচারণাও ছিল না। স্বাধীনতার ২৪ বছর পর তারামন বিবি জানতে পারেন তিনি বীর প্রতীক পদক পেয়েছেন।

নির্যাতিত নারীর সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক: ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনসভায় বলেছিলেন, ‘দুই থেকে আড়াই লাখ নারী যুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন’। পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যাটিকেই সরকারি পরিসংখ্যান হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত গণহত্যা বিষয়ক একটি বিশেষ সংখ্যা থেকে জানা যায়, দুই থেকে আড়াই লাখের পরিসংখ্যানটি সে সময়ের সরকারি কর্মকর্তারা অনুমানের ভিত্তিতে তৈরি করেছিলেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশের ৪৮০টি থানার ২৭০টিই পাকিস্তানি সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে ২ জন করে নিখোঁজ মহিলার হিসাব অনুযায়ী লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ।

১৯৭২ সালে ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি সামগ্রিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, স্পট ধর্ষণ, স্পট গণধর্ষণ ও বন্দি নির্যাতিতার সম্মিলিত সংখ্যা চার লাখ ৬৮ হাজার (স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার তিন লাখ ৭ হাজার ৬শ’ এবং বিভিন্নভাবে পাকিস্তানিদের নিকট বন্দি নির্যাতিত নারী এক লাখ ৪১ হাজার ৪শ’ নারী)। এদের মধ্যে চিহ্নিত স্থানে নির্যাতিতা, নিহত ও অপহৃতসহ স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন তিন লাখ ৬০ হাজার নারী। শুধু স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন প্রায় তিন লাখ ২৭ হাজার, যার মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন প্রায় এক লাখ ৮ হাজার নারী। সরকারের কর্মচারী হয়েও মুক্তি মেলেনি, এমন নারীর সংখ্যাও ছিল অনেক।

এছাড়া যুদ্ধের সময়ে শুধু যৌন নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকবাহিনী। ৭৫৫ জন নারীকে ‘কমফোর্ট গার্ল’ হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া এসব নারী করাচি ও কোয়েটার বন্দি শিবিরগুলোতে অমানুষিক দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। সরকারি তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধের সময়ে ফোর্সড প্র্যাগনেন্সির শিকার হন কমপক্ষে ২৫ হাজার নারী।

তবে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির সভাপতি ডা. এম এ হাসান দাবি করেন, এ ধরনের নারীর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৮৮ হাজার ২শ’।

মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এই পতাকার জন্য যারা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছেন, তাদের প্রতি সরকারেরই শুধু নয় সকল বাঙালির শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাশাপাশি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটি প্রকাশ করে নতুন জরিপের তথ্য: এই কমিটি নতুন করে দেশের ৪২ জেলার ৮৫টি থানায় জরিপ এবং ২৬৭ জনের সাক্ষাৎকার নেয়। জরিপের ফলাফলে দেখানো হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মা-বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওই সময়ের হত্যা ও ধর্ষণের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ছিল না।

জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশ বিংশ শতাব্দীতে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পথে মা-বোনের সম্ভ্রমহানিসহ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে দেখেছে। ইতিহাসে মানবতাবিরোধী এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এতে আরো বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫৬.৬০ ভাগ মুসলিম, ৪১.৪৪ ভাগ হিন্দু ও ২.০৬ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন। যারা যুদ্ধের সময় তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, তাদের সংখ্যা প্রায় ৬৬.০৫ ভাগ। জরিপে দেখানো হয়েছে, সন্ত্রাসের শিকার এসব মহিলার মধ্যে ৯০ ভাগ হয়রানি বা তাদের পরিবারের সদস্য থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। আর ৯ ভাগ মহিলা স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’এর মাধ্যমে নিরপরাধ বাঙালি নারীদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ’৭১ সালের মার্চে ১৮ হাজার ৫২৭ জন, এপ্রিলে ৩৫ হাজার, মে-তে ৩২ হাজার, জুনে ২৫ হাজার, জুলাইয়ে ২১ হাজার, আগস্টে ১২ হাজার, সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার, অক্টোবরে ১৯ হাজার, নভেম্বরে ১৪ হাজার এবং ডিসেম্বরে ১১ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হন।

জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী যশোর, ঝিনাইদহ, বরিশাল, খুলনা, খুলনা বন্দর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, সিলেট, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, ভোলা ও বাগেরহাট এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালে নারীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বেসরকারি সংগঠন ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি এ অঞ্চলে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা, বিভীষিকাজনক অপরাধের ওপর গবেষণা পরিচালনা চালিয়ে থাকে।

বিচার সম্ভব জেনেভা সনদ অনুসারে, নুরেমবার্গ আদালতের মতো: জেনেভা সনদের ২৭ এবং ১৪৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সুনির্দিষ্টভাবে নারীদের ধর্ষণের হাত থেকে সুরক্ষা করতে হবে’। সেক্ষেত্রে এ জাতীয় নির্যাতন অমানবিক অপরাধ। সনদে বলা হয়েছে, ‘এর মাধ্যমে একজন নারীর সম্মান ও ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত আসে’।  এই সনদের আওতায় এ জাতীয় অমানবিক অপরাধের জন্য পাকিস্তানী সেনাদের বিচার হতে পারে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় নুরেমবার্গ আদালতে নারীদের বিচারে এবং দূরপ্রাচ্যের টোকিও ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের দিকে যুগোস্লাভিয়ায়, ১৯৯৩ সালে রুয়ান্ডায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ পৃথক আদালতও গঠন করেছে। এসবের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও পাকিস্তানী সেনা এবং এ দেশীয় দোসরদের যুদ্ধাপরাধের আওতায় এনে বিচার করা সম্ভব। 

নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী শিরিন আখতার বলেন, ‘১৯৭১ সালে গণহত্যা ও গণধর্ষণের জন্য কোনো পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের বিচার হচ্ছে না। প্রতিবারই ডিসেম্বর এবং মার্চ মাসে এই দাবি নিছক আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। যুদ্ধে নির্যাতিতদের এখন ঘৃণ্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। এখনই এদের বিচার নিশ্চিত করার যথাযথ সময়।

‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটি সামাজিকভাবে হয়ে গেছে নেতিবাচক: বিজয়ের কিছুদিন পরেই ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ধর্ষিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন। যার অর্থ হচ্ছে – সাহসী নারী বা যুদ্ধের নায়িকা। এই উপাধি দেওয়া হয়েছিল এই নারীদের আত্মত্যাগের জন্য তাদের সম্মান জ্ঞাপনে।

কিন্তু এই উপাধি তাঁর প্রতিজ্ঞা ধরে রাখেনি। এইসব নারীরা সম্মানের বদলে পেয়েছেন কটূক্তি, বঞ্চনা ও গঞ্জনা। এই উপাধি যেন লজ্জার। আমাদের ইতিহাসে কিংবা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সিনেমাগুলোতে ‘বীরাঙ্গনা’ বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে এর অর্থ দাঁড়িয়ে যায়, শুধু ধর্ষিতা।

ফলে পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছিলেন বীরাঙ্গনা নারীরা। সমাজের কাছে কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না তাদের। নিয়তির কাছে সপে দিয়েছিলেন নিজেদের। যে দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের একাত্তরে তার যাতনা ভুলে থাকা রীতিমত অসাধ্য ছিল তাদের জন্য। কিন্তু নিজের সমাজও তাদেরকে গ্রহণ করেনি সহজভাবে। বীরাঙ্গনা নামের উপাধি তাদের সম্মানের চেয়ে অসম্মান হয়ে এসেছিল বেশি।

বীরাঙ্গনারা বীরমাতা: মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজগঞ্জ জেলার ৩০ জন বীরাঙ্গনাকে সাথে নিয়ে একই মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাদের ‘মা’ ডেকেছিলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশ্বাসও দিয়েছিলেন ভাষণে। সেদিনের সেই সুখস্মৃতি ছাড়া বীরাঙ্গনাদের ঝুলিতে আনন্দের-সুখের-সম্মানের আর কোনো স্মৃতি নেই।

অনেক জেলার বীরাঙ্গনাদের সেই স্মৃতিও নেই। এদের ভাগ্যে কোনো পদক জোটেনি। জোটেনি একটু আশ্রয়। এমনকি সংসার হারানো, স্বামী তাড়ানো, সমাজের অবহেলিত নিগৃহীত এই যে নারীরা প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে চলেছেন, অনেকের ন্যূনতম ভাতাও জোটেনি। সুবিচার পাননি তারা সমাজের কাছে, পরিজনের কাছে। দেশের কাছেও না।

এ ব্যাপারে প্রাক্তণ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.) রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরাঙ্গনাগণ যে নির্যাতন ভোগ করেছেন তা এদেশের জনগণ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।’

তিনি বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং তাদেরকে ‘বীর মাতা’ উপাধিতে ভূষিত করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘সরকার বীরাঙ্গনাদের তালিকা তৈরি করবে এবং তাদের কল্যাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সবকিছু করবে। বর্তমান সরকারের গত আমল থেকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগ চলমান রয়েছে।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়