ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনো দুষ্প্রাপ্য

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনো দুষ্প্রাপ্য

হাসান মাহামুদ : আমাদের স্বাধীনতার বয়স এখন ৪৭। কিন্তু এখনো স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি দেশে। এমনকি এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য খুব বেশি প্রকাশনাও হয়নি সরকারের এ সংক্রান্ত সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। ফলে স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কোথাও পাওয়া যায় না।

মহান এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে হাজারো বই, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস। হয়েছে কিছু গবেষণাও। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ- অনেকেই লিখেছেন যুদ্ধদিনের কথা। কিন্তু এসব কখনোই পূর্ণাঙ্গ নয় বলে মনে করেন গবেষকরা।

তারা বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি বই। মুক্তিযুদ্ধে সত্যি সত্যি কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল, তার ফলাফলই বা কী, কার কী অবদান ছিল, তার সঠিক চিত্র ফুটে ওঠেনি এসব বইয়ে। তৈরি হয়নি কোনো নির্মোহ ইতিহাস। আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবদানের চিত্র নেই বললেই চলে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব লেখা পাওয়া যায় তার অধিকাংশই যুদ্ধসংক্রান্ত। শরণার্থী জীবন ও সমস্যা নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি। ভারত সরকারের ভূমিকা, যুব শিবির, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা, প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা, স্বদেশে আটকেপড়া বাঙালিদের ওপর বর্বরতা, দালালি ইত্যাকার বিষয়গুলোর নিয়ে কোনো কাজ হয়নি।

গবেষকরা আরো বলছেন, এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যাই বের করা যায়নি। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিভ্রান্তি। তাদের দাবি, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হওয়ার পরও এখন পর্যন্ত রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও তৈরি হয়নি দেশে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিস্তারিত ঘটনা নিয়েও বই তেমন একটা নেই। গবেষণার সুযোগ থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের অভাবে কাজ হচ্ছে না।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পরপরই ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করা যায়নি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায়। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সরকারিভাবে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা হোঁচট খেয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসও বিকৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মহামূল্যবান দলিল জাদুঘরে পড়ে আছে বস্তাবন্দি অবস্থায়। সেগুলো প্রকাশ করারও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে তথ্য মন্ত্রণালয় হাতে নেয় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ১৫ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’। কিন্তু অব্যবহৃত অনেক মূল্যবান দলিল ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমানে সেগুলো এখনো জাতীয় জাদুঘরে বস্তাবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ১৯৯৭ সালের দিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পৃক্ত ইনস্টিটিউট গড়ার কাজটি শুরু করেছিলেন। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেয় সব কাজ। বাংলা একাডেমি জেলাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পটিও বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীকালে তথ্য সংগ্রাহকরা প্রকাশকদের মাধ্যমে বইগুলো প্রকাশ করেছেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের অংশগ্রহণের ইতিহাস এখনো লিপিবদ্ধ হয়নি। এখনো প্রশ্ন ওঠার অবকাশ রয়েছে, এটি জনযুদ্ধ নাকি সামরিক যুদ্ধ ছিল। এটি কখনোই কাম্য নয়। তারা বলছেন, এখন সময় এসেছে সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার। কারণ, ৪৬ বছর কম সময় নয়।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেল এখনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাইনি। সরকার বদলে ইতিহাস বদলে যায়। এটা ক্ষমাহীন অপরাধ। ইতিহাস রচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই শঙ্কিত। সরকারের একটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে, এ ব্যাপারে তারা উদ্যোগ নিতে পারে।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন রাইজিংবিডিকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যখন বর্ণিত হয়, তখন সম্মুখ যুদ্ধগুলোর ওপরই গুরুত্বারোপ করা হয়। গেরিলা যুদ্ধের প্রতি ততটা নয়। ১১টি সেক্টরে যে যুদ্ধ হয়েছিল অন্তিমে সেটিই হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কাঠামো। যে ইতিহাস লেখা হয় তাতে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা থাকে অস্পষ্ট।

তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা ইতিহাসবিদ এবং ইতিহাস রচনা-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও বটে। এই ইতিহাস রচনার পদ্ধতি কী হবে সে ব্যাপারেও কোনো প্রখ্যাত পণ্ডিত এখন পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য দিকনির্দেশনা দেননি। এই ইতিহাস যথাযথভাবে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে লিখতে হলে এবং এর অনন্য স্রষ্টা কৃষক সন্তান ও ব্রাত্যজনের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে হলে ফিল্ডওয়ার্ক পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। ইতিহাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষকরা এ ধরনের কাজ অদ্যাবধি করেননি। প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাবে তা করা যাচ্ছে না। অনেক দলিলপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের স্মারকও। মুজিবনগর সরকারের অনেক দলিলপত্র যুদ্ধ শেষে দেশে আনা হয়নি। সামরিক বাহিনীর কোনো দলিলও বেসামরিক হাতে দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সংরক্ষণে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানেও কিছু উদ্যোগ চলমান রয়েছে। আগামীতেও এ বিষয়ে আরো পদক্ষেপ নেবে সরকার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়