ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত ৩৩ বছর!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০১, ৫ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত ৩৩ বছর!

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : পঁচাশি সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল এ দ্বীপ। বহু মানুষ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে পথে বসেছিলেন। তাদের নতুন করে জীবন শুরু হয়েছিল শূন্য থেকে। পঁচাশির পর একানব্বই; এরপর আরও অনেক ঝড়-ঝাপটা বয়ে যায় এ দ্বীপের ওপর দিয়ে। মাঝে আরেকবার এসেছিল ‘নোনা জোয়ার’। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে জোয়ারের পানি, বেড়েছে লবণাক্ততা, শুকনোয় রেড়েছে তীব্র পানি সংকট। দ্বীপটির নাম উড়িরচর। চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের পশ্চিমে আর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্বে নদীর বুকে জেগে উঠেছিল এই চর। জলবায়ু পরিবর্তন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বীপের বয়সী ব্যক্তিরা পঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন। সেই দিনটির পর প্রায় ৩৩ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রলয়ের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

মো. ইসাহাক। বয়স ৬৬ বছর। উড়িরচরের ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। বিরাশি সালে এখানে ঘর বেঁধে পঁচাশি সালেই ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হন। দুই মেয়ে এক ছেলে আর স্ত্রীকে হারান। বাড়িঘরসহ মানুষজন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঝড়ের সেই তাণ্ডব। স্ত্রী মনোয়ারা বেগম রানু (২১), বড় মেয়ে মাসুদা আক্তার ডলি (৯), ছোট মেয়ে রুমা আক্তার (৭) এবং একমাত্র ছেলে বাহাদুরের (২) মরদেহ পর্যন্ত খুঁজে পাননি তিনি। চট্টগ্রামে চাকরিরত ইসাহাক ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির খবর পান দু’দিন পরে। চারদিন পরে দ্বীপে এসে জনশূন্য বিরান বাড়ি দেখতে পান। স্বজন আর সম্পদ হারিয়ে নিথর হয়ে যান ইসাহাক। এক পর্যায়ে নতুন করে শুরু হয় জীবন।

উড়িরচরের ৭ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কাসেম। বয়স ৬২ বছর। পঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ের একদিন আগে এখানে আসেন। মাত্র বছরখানেক আগে বিয়ে করে দ্বীপে নতুন ঘর বেঁধে সংসার শুরু করেছিলেন। বছর না ঘুরতেই তার নতুন জীবনের স্বপ্ন মাটির সাথে মিলিয়ে যায়। স্ত্রী জোছনা বেগম (২২)সহ পরিবারের ১৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সত্তর বছর বয়সী মা মমতাজ বেগম, নিজের স্ত্রী, তিন ভাইয়ের স্ত্রীসহ আরও অনেককে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন তিনি। জীবনের গতি একেবারেই থেমে যায়। এরপর শূন্য থেকে আবার জীবন শুরু হয়।
 


উড়িরচরে গিয়ে এমন একজন নারীকে খুঁজে পাই, যিনি পাঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গিয়েও বেঁচে ফিরেছেন। নাম আয়শা বেগম। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। একই ঝড়ে তার স্বামী ফজললু হক ভেসে যান। আয়শা বেগমকে কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। একটি ঢেঁকি ধরে তিনি ভাসতে ভাসতে সে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বাঁচার আশা তিনি করেননি। কিন্তু বাঁচলে কী হবে; এ অনেকটা জীবনমৃত অবস্থা। সেই থেকে আয়শা বেগম অনেকটাই বাকরুদ্ধ। ঘূর্ণিঝড়ের সময় গর্ভে থাকা মেয়ে রাহিমা আজ বড় হয়েছে। মেয়ের সঙ্গেই এখন তিনি থাকেন।

ইরুল ইসলাম মাঝি (৬৫), জাফর ইসলাম (৪০), হুমায়ূন কবির (৫০), মো. সেলিম (৫৫), মো. হুমায়ূন (৪৮)সহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল পঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ের কথা। ঘূর্ণিঝড়ের সময় এখানে বারো হাজার পরিবারের হাজার দশের মানুষের বাস ছিল এই দ্বীপে। ২৪ মে ১৯৮৫ শুক্রবার দিবাগত রাতে ঘূর্ণিঝড়টি সরাসরি উড়িরচরে আঘাত হানে। আশপাশের এলাকায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। রমজান মাস থাকায় অধিকাংশ মানুষ ছিলেন ঘুমিয়ে। ফলে  প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যায়। তাছাড়া কোনো ধরণের সতর্কীরণ বার্তাও ছিল না।

উড়িরচরের এক নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা রবিউল আলম জানান, তার বড় ভাই ইদ্রিস আলমের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সকলেই ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে যায়। বহু মানুষের মৃতদেহ সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যায়। রবিউল জানান, তখন এখানকার মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের আভাস বুঝে উঠতে পারেনি। নতুন বসতির ভিটেগুলোও ততটা উঁচু ছিল না। অধিকাংশ এলাকায় ছিল বনজঙ্গল। ঘূর্ণিঝড়ের একদিন পরে এখানে হেলিকপ্টারে সাহায্য আসে।

তিন নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুল বাতেন (৫০) বলেন, ওইদিন রাত ৪টার দিকে পানি ওঠে। আমরা সবাই ঘরের চালার উপরে উঠে যাই। ৬ জনের মধ্যে আমরা চারজন বেঁচে ছিলাম। দু’জন মারা যায়। আমরা চালা ধরে ভাসছিলাম। এক পর্যায়ে একটি গাছের সঙ্গে আটকে যাই। অন্য দু’জন চালা ধরে রাখতে না পেরে হারিয়ে যায়।
 


পাশেই বসে ছিলেন মো. ইব্রাহিম (৫৩)। তিনি বলেন, আমরাও একই সঙ্গে পঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গিয়েছিলাম। ঝড় চলে যাওয়ার পর এই দ্বীপে যেন এক মরুভূমি দেখতে পাই। মানুষ আর গরু-ভেড়ার মৃতদেহ একাকার হয়ে গিয়েছিল। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্যপট। পরের দিন এরশাদ সাহেব আসেন, অন্যান্য রাষ্ট্র প্রধানেরা আসেন, রিলিফ আসে। অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেলেও সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা কঠিন ছিল।

ঘূর্ণিঝড়ে উড়িরচরের ধ্বংসযজ্ঞের কথা শুধু দেশে নয়, বর্হিবিশ্বেও ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল। এ ঘটনার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্থানীয় বন বিভাগের রেস্ট হাউসে একরাত অবস্থান করেছিলেন। মানুষের সার্বিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। সে সময় উড়িরচরের এক হাজার পরিবারকে খাসজমি বরাদ্দ দেন তিনি। অনেকে সাহায্য হিসাবে পান রেশন কার্ড। আকস্মিকভাবে আসা ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ে উড়িরচরে কেন এতটা ক্ষতি হয়েছিল- এমন প্রশ্ন করেছিলাম এখানকার বয়সী ব্যক্তিদের কাছে। তারা জানালেন, দ্বীপটি তখন অনেক নিচু ছিল। আর আয়তনেও ছিল অনেক ছোট। মানুষের মাঝে ঘূর্ণিঝড়-প্রস্তুতি বিষয়ে ততটা সচেতনতাও ছিল না। ঘূর্ণিঝড়ের প্রচারণাও ছিল না। মোবাইল যোগাযোগও ছিল না। দ্বীপে খুব বেশি গাছপালাও ছিল না। বন বিভাগ তখন কেবল গাছ লাগানো শুরু করে; চারাগুলো খুবই ছোট ছিল। এসব কারণে ক্ষতির মাত্রা ছিল অনেক বেশি। বাসিন্দারা জানান, পঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে মানুষজন সচেতন হতে থাকে। এখন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি আবার নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। কিছু মাটির কিল্লা নির্মিত হয়েছে। সচেতনতার কারণে মানুষজন ভিটে উঁচু করেছে। বাড়িগুলো এখন ৭ থেকে ১০ ফুট উঁচু। এই প্রস্তুতির ফল পাওয়া গেছে ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে। এসময় ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম।

পঁচাশির ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ের পর একানব্বই সালের ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন সময়ে এখানে নানান দুর্যোগ আঘাত হনেছে। সাতাশি সালে এখানে ভিন্ন রকমের দুর্যোগ এসেছিল। এলাকাবাসী স্থানীয় ভাষায় একে বলছে ‘নোনা জোয়ার’। ওই বছরের বাংলা কার্তিক মাসে জোয়ার আসে। ক্ষেতে তখন ছিল আমন ধান। কেউ কেউ অন্যান্য ফসলও বুনেছিল। হঠাৎ ৬ নাম্বার বিপদ সংকেত দেয়া হয়। স্বাভাবিক জোয়ারের মত এক জোয়ার এসে ফসলি মাঠ ডুবে যায়। স্বাভাবিক জোয়ার হলেও পানির উচ্চতা একটু বেশি ছিল। কিন্তু সেই পানিতে ছিল অস্বাভাবিক লবণ। দ্বীপের বাসিন্দা মো. তালুক মিয়া (৫২) এ প্রসঙ্গে বলেন, নোনা জেয়ারে দ্বীপের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের প্রায় ৮০ একর জমিতে আমন ধান ছিল। নোনা জোয়ারে সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মহিষ, গরু ও ভেড়ারও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই বছর এলাকার মানুষ কোনো ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে। শুধু উড়িরচর নয়, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, নোয়াখালীর অনেক অঞ্চলেও সে বছর নোনা জোয়ারে ক্ষয়ক্ষতি হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়