ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বর্ষবরণে যৌন হয়রানি : এক আসামিতেই বিচারকাজ

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০১, ১৪ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বর্ষবরণে যৌন হয়রানি : এক আসামিতেই বিচারকাজ

মামুন খান : কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পুলিশ সিসি টিভির ফুটেজ দেখে ৮ জন যৌন নির্যাতনকারীকে সনাক্ত করেছিল। তবে তাদের মধ্যে শুধু মো. কামাল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ। এই এক আসামিকে নিয়েই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে।

মামলাটিতে কামালের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ মাস আগে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার। এরপর তিনটি ধার্য তারিখে কোনো সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে মামলার বিচার এখনো শুধু অভিযোগ গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। অথচ ওই ঘটনার প্রায় ৩ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। আামী ৩ জুন মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য তারিখ ধার্য রয়েছে।

এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মাহ্মুদা আক্তার বলেন, ‘এ মামলায় ইতিমধ্যেই আদালত আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছেন। কিন্তু পুলিশ এখন পর্যন্ত একজন সাক্ষীও ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পারেনি। আদালতে সাক্ষী না আসায় তাদের প্রতি সমন জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে পিপি অফিসের মাধ্যমে সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে।’ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বাত্মক গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রক্তন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনায় প্রথমে সরকার নজর দিলেও পরে অপর একটি ঘটনার আড়ালে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। আর এভাবে বিচারিক দীর্ঘসূত্রতায় আসামিরা মামলার প্রমাণাদি নষ্ট করে ফেলে। সব মিলিয়ে যখন অপরাধীদের শাস্তি হয় না, তখন তারা ও অন্যান্য বখাটেরা নারী নির্যাতনে আরও আগ্রহী হয়। যৌন হয়রানির যে দু’চারটা মামলা আসে, তা কোনো সময়ই সঠিকভাবে তদন্ত হয় না। বরং এক্ষেত্রে নির্যাতিতদেরকেই দোষারোপ করা হয়। সরকারের উচিত, এসব ঘটনায় যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান বলেন, ‘এজাহারে কামালের নাম ছিল না। পুন:তদন্তে চার্জশিটে তার নামটা এসেছে। সে একজন ডায়াবেটিস রোগী। লালবাগের খাজী দেওয়ানে সে তরকারী ব্যবসা করে। যেহেতু সে ডায়াবেটিস রোগী, এজন্য ওইদিন সে বের হয়েছিল হাঁটাহাটি করার জন্য। ওই ঘটনা ঘটার পরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়। এরপর কামাল সেখানে হাঁটাহাটি করতে যায়। সেখানে যে কোনো ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কামাল কোন কিছু জানতো না। সে হেঁটে এসেছিলো আর তার ছবি ওই ভিডিও ফুটেজে এসেছে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ভিডিও ফুটেজে এমন কিছু আসেনি যে, সে কাউকে ধরছে, টানছে বা শ্লীলতাহানি করছে। ভিডিও ফুটেজে তার ছবি আসার কারণে তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটি এলাকায় কয়েকজন নারীকে যৌন হয়রানি করা হয়। ওই ঘটনায় ভিকটিমদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা না করায় শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। শাহবাগ থানার পুলিশ মামলাটি কয়েকদিন তদন্তের পরই তদন্তভার ডিবি পুলিশকে দেওয়া হয়।

মামলার একমাস পর ১৭ মে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও থেকে আটজন যৌন হয়রানিকারীকে শনাক্ত ও তাদের ছবি পাওয়ার কথা জানান পুলিশ প্রধান একেএম শহীদুল হক। শনাক্তকৃতদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনও গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল। পরে সনাক্তকৃত আসামিদের মধ্যে মো. কামাল (৩৫) গ্রেপ্তার হলে তাকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়।

২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পিবিআইয়ের পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক একমাত্র আসামি কামালকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৭ সালের ১৯ জুন ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার ওই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন।

চার্জ গঠনের আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন যে, ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে যে কোন সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়স্থ টিএসসি এলাকায় আপনি আসামি মো. কামাল ১লা বৈশাখ ১৪২২ উদযাপন উপলক্ষে হাজার হাজার নারী পুরুষের উপচে পড়া প্রচ- ভীড়ের মধ্যে অজ্ঞাতনামা মেয়েদের শরীরে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানি ঘটান।

মামলাটিতে কামাল জামিনে আছেন। হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পেয়েছেন।

এদিকে মামলাটির চার্জশিটে ৩৪ জনকে সাক্ষী করে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলাটি তদন্তকালে একাধিকবার ঘটনাস্থল গিয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষি, ভিকটিমদের সন্ধান এবং আসামিদের সন্ধান ও গ্রেপ্তারের সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। কামাল ব্যতিত অন্য কোন আসামির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৮ আসামির জন্য এক লক্ষ টাকা পুরষ্কার ঘোষণার প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মিডিয়ায় প্রচার করা সত্ত্বেও আসামিদের নাম-ঠিকানা ও সন্ধান পাওয়া যায়নি। বাকি সাতজনের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হবে।

পুনঃতদন্তের সাক্ষী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দির জবানবন্দিতে ওই দিনের যৌন হয়রানির ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৫টা থেকে তারা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় চত্ত্বরে উপস্থিত ছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যে পৌনে ৬টার দিকে দেখতে পাই ৫ গ্রুপে বখাটেরা নারীদের লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করছে। প্রতিহত করার জন্য আমি ও আমার সঙ্গীরা এগিয়ে যাই। রাজু ভাস্কর্যের পূর্ব পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৩ নং গেটের সামনের রাস্তার উপর একটি মেয়ের শাড়ি বখাটেরা খুলে ফেলে এবং ব্লাউজ ছিড়ে ফেলে। তখন আমরা বখাটেদের কিলঘুষি মেরে তাড়িয়ে দেই। মেয়েটিকে শরীর ঢাকার জন্য আমার পাঞ্জাবি খুলে দেই। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে বখাটেরা মেয়েদের যৌন হয়রানি করে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৮/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়