ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রানা প্লাজা ধস

চার্জ গঠনের ২ বছরেও বিচারে অগ্রগতি নেই

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চার্জ গঠনের ২ বছরেও বিচারে অগ্রগতি নেই

মামুন খান : ঢাকার অদূরে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মামলার বিচারে তেমন অগ্রগতি নেই। অনেকটা থমকে আছে মামলার বিচারকাজ। আইনী জটিলতার কারণে দুই মামলায় চার্জগঠনের দুই বছরে এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।

২০১৩ সালের এই দিনে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় ২ হাজার।

বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়া ওই ঘটনায় তিনটি মামলা হয়। ত্রুটিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলা করে পুলিশ। সরাসরি হত্যার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলী আক্তার। আর বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করার অভিযোগে ইমারত আইনে অপর একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

তিনটি মামলার মধ্যে পুলিশের এবং নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীরে স্ত্রী শিউলী আক্তারের করা মামলা দুটি একসঙ্গে এবং অপরটির আলাদা তদন্ত হয়। ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে আদালতে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।

পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবনের মালিক সোহেল রানা ও তার মা-বাবাসহ ৪১ জনকে এবং ইমারত নির্মান আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।

দুই মামলার চার্জশিটে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুই মামলারই আসামি। এছাড়া রানা প্লাজা নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

তিনটি মামলার মধ্যে হত্যাসহ দুই মামলার বিচার চার্জগঠনের পর উচ্চ আদালতে নির্দেশ প্রায় দুই বছর ধরে নি¤œ আদালতে বিচারকাজ স্থগিত রয়েছে। ওই কারণে গত দুই বছরে নি¤œ আদালত কোন  সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেনি।
 


অন্যদিকে রানা প্লাজার ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অপর মামলায় গত বছরের ২১ মে অভিযোগ গঠন করে রানাসহ ১২ জনের বিচার শুরু করেন আদালত। মামলাটিতে বাদীর সাক্ষ্য চলছে।

হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের ১ জুন রানা, তার বাবা-মাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডির সহকারি পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। এরপর প্রায় এক বছর ধরে মামলার পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলে। এরপর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তা পাঠানো হয়।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

মামলার ৪১ আসামির মধ্যে মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে আসামি সোহেল রানাকে পালাতে সহযোগিতার জন্য দন্ডবিধির ২১২ ধারায় এবং অপর ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে চার্জগঠন করা হয়। একই সঙ্গে ওই বছর ১৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু হত্যার ধারায় চার্জগঠন করা ৩৮ আসামির মধ্যে সাতজন চার্জগঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করায় হাইকোর্ট মামলার নি¤œ আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করে। ফলে ওই কারণে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেনি আদালত।

সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও একই কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে আগামী ১৬ মে পরবর্তী দিন ধার্য করেন বিচারক।

এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, একজন আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ এখনো ১২ মে পর্যন্ত রয়েছে। এর মধ্যে যদি বৃদ্ধির কোনো আদেশ না আসে তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করব।

তিনি বলেন, এর মধ্যে জামিনে থাকা আবু বকর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন নামে দুই জন আসামি মারা গেছেন। যার প্রতিবেদনও আমরা পেয়েছি।

২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ১৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

ওই মামলায়ও হত্যা মামলার সঙ্গে ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক একটি চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির ওই কর্মকর্তা। চার্জশিটে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলার ১৮ আসামির মধ্যে ১৭ জনই হত্যা মামলার আসামি।
 


২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। একই সঙ্গে ওই বছরের ২৩ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।

চার্জ গঠনের পর আসামিদের মধ্যে তিনজন চার্জ গঠনের আদেশ বাতিলের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পৃথক তিনটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। ওই রিভিশন মামলার তিনজনের মধ্যে দুইজনের আবেদন খারিজ হয়েছে। পোষাক মালিক আনিসুর রহমানের পক্ষে দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে আগামী ৭ মে রিভিশন মামলাটি শুনানির জন্য তারিখ ধার্য রয়েছে। আর আগামী ৬ মে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছে।

এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, আমরা সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা বিচারাধীন থাকায় আদালত সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। আসামিপক্ষ বিচারকাজ বিলম্বিত করার জন্য রিভিশনের নামে সময় ক্ষেপন করছেন। দুই বছর ধরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিভিশন মামলার শুনানি করতে কালক্ষেপন করছেন।

যে আদালতে রিভিশন মামলা শুনানির অপেক্ষায় আছে ওই আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরদের রিভিশন শুনানিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহবান জানান তিনি। আর রিভিশন মামলার নিষ্পত্তি হলেই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে বলে জানান তিনি।

রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর পরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। রানা প্লাজা ভবনে ৬ তলা নির্মাণের অনুমোদন থাকার পরও ৯ তলা ভবন নির্মাণ করে দুর্নীতি করায় ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন মামলা করে দুদক।

মামলায় রানা ছাড়া অপর ১৭ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু তদন্তে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রানার প্রভাব খাটানোর বিষয়ে বেরিয়ে আসায় তাকেসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ পরিচালক মফিদুল ইসলাম।

চার্জশিট দাখিল হওয়ার পর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসলে চার্জ শুনানির পর্যায়ে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। ফলে ২০১৬ সালের ৬ মার্চ মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন ওই আদালত। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ পরিচালক মফিদুল ইসলাম। পরবর্তীতে মামলাটিতে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ এম আতোয়ার রহমান ২০১৭ সালের ২১ মে  ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন।

এ মামলা প্রসঙ্গে দুদকের প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। যা চলমান। আশা করি অপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে দ্রুত মামলাটির বিচার শেষ করতে পারব।
 


মামলা তিনটিতে এখনো সাত আসামি পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন- সাভার পৌরসভার প্রাক্তন সহকারি প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, একই পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাক্টর, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রেজাউল করিম, নয়ন মিয়া ও সফিকুল ইসলাম।

অন্যদিকে কারাগারে রয়েছেন ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন নামে দুইজন মারা গেছেন।

তিন মামলা মিলে মোট আসামি ছিল ৪২ জন। সে হিসেবে ২৯ জন আসামি জামিনে আছেন। এরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগম (অন্য মামলায় দ-প্রাপ্ত হয়ে কারাগারে), সাভার পৌর মেয়র আলহাজ রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারি প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিেিটডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইতার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কমকর্তা উত্তম কুমার রায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. ইউসুফ আলী,  পরিদর্শক প্রকৌশল মো. মহিদুল ইসলাম, ইথার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. ইউসুফ আলী ও মাহবুল আলম।

আসামি রানার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজার হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় চার্জগঠন হয়েছে। কিন্তু আমরা চার্জগঠনের সময় বার বার বলেছিলাম মামলা দুটিতে চার্জগঠনের কোন উপাদান নেই। হত্যার কোন উপাদান নেই। কিন্তু তারপরও বিজ্ঞ আদালত চার্জ গঠন করেছেন। এর বিরুদ্ধে আমাদের কিছু আসামি হাইকোর্টে গেছে। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। উনাদের বিচার তো চলবে না। আর কয়েক আসামি রিভিশন মামলা দায়ের করেছেন। এটা নিষ্পত্তি না হলে সাক্ষ্যগ্রহণ করা যাবে না।

তিনি বলেন, আমি মনে করি মামলার বিচার শুরু হলো ভালো কথা। বিচারটা শেষ হয়ে যাবে। আমি দোষী না নির্দোষ তা বিচারেই প্রমাণিত হবে। আমরা চাই বিচারটা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যাক। সেখানে  আমাদের আসামি দোষী হলে সাজা হবে। আর নির্দোষ হলে খালাস পাবে। আর আমার আসামি রানা তো কারাগারে রয়েছে। সে তো জামিন পাচ্ছে না। বিনা বিচারে আটক আছে। একই আদালতে বিচারাধীন মামলার সব আসামি জামিনে সুবিধা ভোগ করতেছে, কিন্তু নামের কারণে রানা জামিন পাচ্ছে না। এজন্য আমরা চাই মামলার বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। ধ্বংসস্তুপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১ হাজার পাঁচশ ২৪ জন আহত হন। তদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ৭৮ জন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৮/মামুন খান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়