ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

দুদকে পদোন্নতি নিয়ে বিতর্ক ও ক্ষোভ

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুদকে পদোন্নতি নিয়ে বিতর্ক ও ক্ষোভ

এম এ রহমান মাসুম : কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির পদ্ধতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) নানা বিতর্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। 

দুদকে প্রথমবারের মতো পরীক্ষার মাধ‌্যমে পদোন্নতির যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা আইন ও বিধিসম্মত হয়নি, এ অভিযোগ করে দুদকের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, যে বিধিতে কমিশন থেকে পরীক্ষা, মানবণ্টন ও পরীক্ষা পদ্ধতি অনুমোদিত হয়ে আদেশ জারি করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।

শুধু তাই নয়, প্রশ্ন উঠেছে পদোন্নতি না দিয়ে একতরফাভাবে প্রেষণের মাধ‌্যমে জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে কর্মকর্তা এনে কমিশনের উচ্চপদগুলো পূরণ করার বিষয়েও। কারণ, এর ফলে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক ও মহাপরিচালক পদে দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে।

গত ১৮ এপ্রিল দুদকের সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিনের সই করা আদেশে দুদক কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ৬ (৩) অনুযায়ী পরীক্ষা পদ্ধতি ও সিলেবাসের বিষয়ে বলা হয়েছে। যদিও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এর পাশাপাশি বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ও জ্যেষ্ঠতার বিষয়টিও আমলে নেওয়া হবে। যা অনুকরণীয় উদ্যোগ বলে মনে করছে কমিশন।

চাকরি বিধিমালার ৬ এর উপধারা-৩ অনুসারে, যদি কোনো ব্যক্তির চাকরির বৃত্তান্ত (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন বা বিশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদন) সন্তোষজনক না হয়, তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক সময় সময় আয়োজিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হন এবং চাকরিতে স্থায়ী না হন তাহা হলে তিনি কোনো পদে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগের জন্য যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হবেন না।

অর্থাৎ, বিধিতে কোথাও পদোন্নতির জন্য পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়নি। বরং সেখানে পদোন্নতি না পাওয়ার অযোগ‌্যতার কথা বলা হয়েছে। পদোন্নতির যোগ‌্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, তারা সবাই বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও চাকরির শুরুতেই স্থায়ী হয়েছেন। এ অবস্থায় চাকরির বৃত্তান্ত সন্তোষজনক না হওয়ার বিষয়টি অপ্রসাঙ্গিক। তাছাড়া দুদকের সব স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির বৃত্তান্ত একসঙ্গে অসন্তোষজনক হওয়াটা অযৌক্তিক।

ওই অফিস আদেশের (২) ও (৩) এ বর্ণিত শর্তসমূহের বিষয়ে পদোন্নতিপ্রত‌্যাশীদের দাবি চাকরি বিধিমালায় জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতির বিধিসহ অন্যান্য বিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা চাকরি বিধির ১৬ ধারা অনুযায়ী কমিশন কর্তৃক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর পদোন্নতির উদ্দেশ্যে গৃহীত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিবার নতুন মেধাতালিকার ভিত্তিতে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত তাদের পারষ্পরিক জ্যেষ্ঠতা ক্ষুণ্ন করে পুরো পদোন্নতি প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে পারে। তাছাড়া পদোন্নতির জন্য এরকম পরীক্ষা গ্রহণ এবং জ্যেষ্ঠতার বাইরে পরীক্ষার ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে পদোন্নতি দেওয়ার নজির দেশের অন্য কোনো সার্ভিসে নেই বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

পরীক্ষা বাতিলে ইতোমধ‌্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশনের কাছে আবেদন করার উদ‌্যোগ নিয়েছেন বলে দুদকের অন‌্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। আবেদনে বেশকিছু যুক্তি উপস্থাপন করা হতে পারে।

তাদের দাবি, চাকরি বিধিমালায় ‘সময় সময় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া’ বলতে কমিশন বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যেসব প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করে থাকে সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। উক্ত বিধিমালার ৬ বিধির কোথাও পদোন্নতির পূর্বশর্ত হিসেবে বাধ্যতামূলক কোনো পরীক্ষার বিষয় উল্লেখ নেই। অর্থাৎসময় সময় আয়োজিত পরীক্ষার বিষয়টিকে ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে যে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে তা বিধির অন্যান্য বিধিমালার সাথে সাংঘর্ষিক।

এছাড়া ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল পরীক্ষার গ্রহণের মাধ্যমে পদোন্নতি প্রদান সম্পর্কে গঠিত কমিটি বর্তমানে বলবৎচাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এ পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি প্রদানের বিধান নেই মর্মে মতামত প্রদান করেছিল। তাই বিধিমালা অনুসরণ করে যে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে তা যথাযথ নয় এবং ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা ও বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি মনে করেন, সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়ায় প্রতিটি সৎ, দক্ষ এবং মেধাবী কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদান করা সমীচীন।

দুদক সূত্রে জানা যায়, দুদকের অফিস আদেশে কর্মচারী বিধিমালার বিধি ৬ (৩) অনুযায়ী পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী সিস্টেম এনালিস্ট, সহকারী পরিচালক, উপসহকারী পরিচালক, কোর্ট পরিদর্শক, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর, উচ্চমান সহকারী, সাঁটমূদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, কোর্ট সহকারীসহ ১৭ পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরীক্ষার সিলেবাস ও মানবণ্টন বিষয়ে বলা হয়েছে। সিলেবাসে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪; দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা, ২০০৭; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন; সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; দণ্ডবিধি, ১৮৬০সহ বিভিন্ন আইন ও বিধি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ৪০, বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ৩০ এবং জ্যেষ্ঠতায় ৩০ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ করা হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ৩ বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও উত্তীর্ণ হতে না পারলে তিনি আর পরীক্ষার জন্য যোগ্য হবেন না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, কমিশন থেকে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে বলছি, তারা যে কর্মচারী বিধিতে পরীক্ষার নিওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা যথাযথ হয়নি। কারণ, চাকরি বিধি ৬ (৩) পদোন্নতি না পাওয়ার অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। ওই ধারায় চাকরির বৃত্তান্ত সন্তোষজনক না হওয়া, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া এবং চাকরিতে স্থায়ী না হওয়ার বিষয়টি বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোথাও পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়নি।

তিনি বলেন, এখানে যাদের পদোন্নতির জন্য পরীক্ষার কথা কমিশন বলছে তারা সবাই বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেক আগেই স্থায়ী হয়েছেন। আর চাকরির বৃত্তান্ত সন্তোষজনক না হওয়ার বিষয়টি অপ্রসাঙ্গিক। কারণ দুদকের সকল স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির বৃত্তান্ত একসঙ্গে অসন্তোষজনক হওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? অন্যদিকে দুদকে প্রেষণে যারা আসেন তারা আমাদের অনেক জুনিয়র হয়েও বস হয়ে যান। এমনকি অনেকে এখানে উপপরিচালক হিসেবে যোগদান করে পরিচালক হয়ে আমাদের বস হয়ে গেছেন। তাদের তো পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পেতে হয়নি। তাদের মাদার প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক নিয়মে পদোন্নতি পেলেই কমিশন থেকে পদোন্নতি পেয়ে যান। তবে আমাদের জন্য ভিন্ন নিয়ম কেন? তাছাড়া প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দুদকের মতো একটি বিশেষায়িত অনুসন্ধান ও তদন্তনির্ভর প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মতো দক্ষতা সবার থাকে না।

বর্তমানে দুদকের মহাপরিচালক পদের সবগুলোতে (৬টি পদ), ১৯টি পরিচালক পদের মধ‌্যে ১০টিতে, ৮১টি উপপরিচালক পদে মধ‌্যে ১৯ এর বেশি পদে জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।

এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ দপ্তর থেকে রাইজিংবিডিকে লিখিত বক্তব‌্যে জানানো হয়, দেশের প্রতিটি পদোন্নতি নিয়ে যখন নানা বিতর্ক চলছে, ঠিক তখনই দুর্নীতি দমন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, জ্যেষ্ঠতা, সততা ও দক্ষতাকে প্রাধান্য দিয়ে আংশিক পরীক্ষা প্রথা প্রবর্তন করেছে। পূর্ববর্তী কমিশন ২০১৫ সালে পরিচালক, উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়। এই পদোন্নতি নিয়ে তখন মিডিয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। এ বাস্তবতায় বর্তমান কমিশন পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। দীর্ঘ আলোচনা শেষে চাকরি বিধিমালা অনুসরণ করে পদোন্নতির লক্ষ্যে পরীক্ষা গ্রহণের সিলেবাস, মানবণ্টন ও পরীক্ষা পদ্ধতি অনুমোদন সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি করা হয়।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ মে ২০১৮/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়