ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মতিঝিলে ফ্লোর ক্রয়ে ৭৬ কোটি টাকা লোপাটেও বাচ্চু জড়িত

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৭, ২৮ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মতিঝিলে ফ্লোর ক্রয়ে ৭৬ কোটি টাকা লোপাটেও বাচ্চু জড়িত

এম এ রহমান মাসুম : বেসিক ব্যাংকের মতিঝিলে একটি ভবনের ছয়টি ফ্লোরে ৫১ হাজার ৫০০ বর্গফুট জায়গা ক্রয়ে ৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে ব্যাংকটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এ দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।

অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে মাধ্যমে মতিঝিলের জামান টাওয়ারে (বর্তমানে জামান-বেসিক টাওয়ার) যে ফ্লোর কেনা হয় তা শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের প্রথম দিকের ঘটনা। যদিও বেসিকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা ৬১টি মামলার কোনোটিতেই ফ্লোর ক্রয়ে অর্থ লোপাটের এ ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি।

অনেক দেরিতে হলেও চলতি বছরের প্রথম দিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের উপ-পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীর নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি দলকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয় দুদক। অনুসন্ধান দলের অপর সদস্য দুদকের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম।

অনুসন্ধান দলের প্রাথমিক পর্যায়ের অনুসন্ধানে বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিলের একটি ভবনের ছয়টি ফ্লোরের ৫১ হাজার ৫০০ বর্গফুট জায়গা ক্রয় প্রক্রিয়ায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করা হয়নি বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দুদক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক ইউনিটে (সিপিটিইউ) পৃথকভাবে পাঠানো চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। গত ২৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সিপিটিইউ মহাপরিচালক বরাবর ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন সূত্র রাইজিংবিডিকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

চিঠির সূত্রে জানা যায়, অভিযোগের অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড ২০১০ সালে  ৮০ কোটি ব্যয়ে মতিঝিলের একটি ভবনের ছয়টি ফ্লোরের ৫১ হাজার ৫০০ বর্গফুট  জায়গা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনুসন্ধানকালে আরো জানা যায়, উক্ত ক্রয় প্রক্রিয়ায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করা হয়নি। এ বিষয়ে ওই দুই আইনের যথাযথ ব্যাখ্যা কী সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক ইউনিটের (সিপিটিইউ) মতামত ও তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে। তবে এখনো মেলেনি কাঙ্ক্ষিত তথ্য-উপাত্ত। এরই মধ্যে দুদক থেকে দুইবার তাগিদপত্রও দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২ জুলাই তাগিদপত্র দেওয়া হয় দুদকের অনুসন্ধান টিম থেকে।

এ বিষয়ে দুদকের সচিব ড. শামসুল আরেফিন রাইজিংবিডিকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের ঘটনায় দুদক থেকে ৫৬টির বেশি মামলার তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। আরো কিছু বিষয় অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। যা নিয়ে মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।

তবে দুদকের ঊর্ধ্বতন অন্য একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে জানায়, মতিঝিলে নির্মাণাধীন ২২ তলা ভবনে ৫১ হাজার ৫০০ বর্গফুট জায়গা বুঝে নেওয়ার আগেই ২০১০ সালে ৭৬ কোটি টাকা পরিশোধ করে আব্দুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। অথচ বিভিন্ন অজুহাতে গত কয়েক বছরেও বাড়ির মালিক তা বুঝিয়ে দেয়নি। তিনি বর্তমানে মালয়শিয়ায় বসবাস করছেন। যতটুকু জানা গেছে, জমির মালিকানা নিশ্চিত না হয়েই অফিস স্পেস কেনা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৩ সালে ফ্লোর হস্তান্তরের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বুঝে পায়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এর ফলে ক্রয় এবং ভাড়া বাবদ অন্তত শত কোটি টাকা আত্মসাৎও লোকসান হয়েছে ব্যাংকের।

অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, বিতর্কিত জমির ওপর নির্মিত ভবনের ফ্লোর ৭৬ কোটি টাকায় কেনেন বেসিক ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। পাকিস্তানের নাগরিক ওয়াহিদুজ্জামানের স্ত্রীর নামে কেনা এ জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় ছিল। জমির মালিকানা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক আকরামুজ্জামান শিংকু (শিংকু জামান) পেলেও সংশোধন হয়নি আরএস মিউটেশন। তারপরও অগ্রিম পরিশোধ করা হয় ফ্লোর ক্রয় বাবদ পুরো অর্থ। বিতর্কিত জমির ওপর নির্মিত ভবনের ফ্লোর যখন আর কেউ কিনতে রাজি হয়নি তখন কেনা হয় উচ্চ মূল্যে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৩ সালে ফ্লোর হস্তান্তরের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বুঝে পায়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, জমির মালিকানা নিশ্চিত না হয়েই বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স বিজনেস রিসোর্সেস লিমিটেডের কাছ থেকে অফিস স্পেস ক্রয় করেন বেসিক ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। প্রধান কার্যালয় স্থাপনের জন্য মতিঝিলের জামান টাওয়ারে (বর্তমানে জামান-বেসিক টাওয়ার) অফিস স্পেস কেনেন। ফ্লোর হস্তান্তরের জন্য বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বেশ কয়েকবার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক আকরামুজ্জামান শিংকুর (শিংকু জামান) সঙ্গে কথা বলেও প্রতিবারই নতুন সময়সীমা দিয়ে আবার তা ভঙ্গ করেছেন।

অন্যদিকে, কমার্শিয়াল অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই পর্ষদের সঙ্গে সমঝোতা হয় দুই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের। ২০১০ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধান কার্যালয়ের জন্য মতিঝিল এবং বনানী শাখার জন্য বনানীতে স্পেস কেনার টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় পত্রিকায়। বিজ্ঞপ্তিতে মতিঝিলে ৩৫ হাজার বর্গফুট স্পেস ক্রয়ের স্পেসিফিকেশন দেওয়া হয়। অথচ মেসার্স বিজনেস রিসোর্স লিমিটেডের সঙ্গে একই বছর ১ এপ্রিল চুক্তি সম্পাদন হয় ৫১ হাজার ৫০০ বর্গফুট ক্রয়ের। গোপন সমঝোতা অনুসারে টেন্ডারে  মতিঝিলে ‘মেসার্স বিজনেস রিসোর্সেস লিমিটেড একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘গ্রহণযোগ্য’ বিবেচিত হয়। দরপত্রের বাইরে অতিরিক্ত ১৬ হাজার বর্গফুট (প্রতি বর্গফুট ১৪ হাজার ৬০০ টাকা দরে) স্পেস কেনে। ফলে শুধু মূল্য নির্ধারণেই আত্মসাৎহয় ২৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। অতিরিক্ত এ আয়তনের স্পেস প্রাক্কলনে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কেননা, ওই ভবনের ৮ তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত স্পেসের মূল্য নির্ধারণ করা হয় একই হারে। অথচ উপরের ফ্লোরগুলোর প্রকৃত মূল্য অনেক কম। ২০১০ সালের ৯ জানুয়ারির কোটেশনে গ্রাউন্ড ফ্লোরের মূল্য উল্লেখ করা হয় ২২ হাজার টাকা প্রতি বর্গফুট। প্রথম তলা থেকে ৮ তলা পর্যন্ত মূল্য উল্লেখ করা হয় ১৪ হাজার ৬০০ টাকা। যা ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর দাখিলকৃত কোটেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেনা ফ্লোরের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে ট্রাই-পার্টি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে। রেজিস্ট্রি না হওয়া পর্যন্ত এগ্রিমেন্টটির আইনগত ভিত্তি নেই। ফলে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে ফ্লোরের শতভাগ মালিকানা প্রাপ্তিতে। মতিঝিলের কোনো ফ্লোরই ব্যাংকের নামে মর্টগেজ করা হয়নি।

মর্টগেজ না থাকায় ফ্লোর পাওয়া নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। শুধু তাই নয় ফ্লোর কেনায় যারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তাদেরকে বিভিন্ন সময় পরবর্তীতে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় চার বছর অনুসন্ধান শেষে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে টানা ৫৬টি মামলা করেন দুদকের অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় এসব মামলায় আসামি করা হয় ১৫৬ জনকে। অনিয়মের মাধ্যমে ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।  এছাড়া, বেসিক ব্যাংক সংক্রান্ত বিষয়ে আরো চারটি মামলা করে দুদক। তবে কোনো মামলায় ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। এ অভিযোগে আব্দুল হাই বাচ্চুকে পঞ্চম দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৮/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়