ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মাংস আর ডিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ পোল্ট্রির অবদান

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাংস আর ডিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ পোল্ট্রির অবদান

অলংকরণ : গিয়াস উদদীন সিজার

হাসান মাহামুদ: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাংস ও ডিম উৎপাদনের পাশাপাশি পোল্ট্রি রিসাইক্লিংয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এই শিল্প থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ, পোল্ট্রি ফেদার মিল থেকে বায়োডিজেল। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পোল্ট্রি লিটার, টার্কি লিটার। গবেষণা ও পরিকল্পনা চলছে বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরির। বাংলাদেশে পোল্ট্রির ইতিহাস দু’যুগেরও বেশি। অথচ এখনো আমরা পোল্ট্রি বলতে শুধু মুরগির মাংস আর ডিমকেই বুঝি।

কারণ, আমাদের দেশে এখনো পোল্ট্রি নিয়ে বৃহৎ কোনো পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি। ডিম ও মাংস উৎপাদনের বাইরেও যে এ খাত থেকে লাভ করা সম্ভব, রাজস্ব আয়, রপ্তানি আয় সম্ভব- এসব নিয়ে কোনো রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে সম্ভাবনাময় একটি খাতের ‍গুরুত্ব শুধু মাংস-ডিমেই আটকে আছে। এ খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৈরি পোশাকের মতো এই খাতেও বিপ্লব সম্ভব। যদিও পোল্ট্রি শিল্প এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতি ও জিডিপিতে অবদান রাখছে, পরিকল্পিতভাবে পরিচালনায় এই অবদান আরো কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মন্তব্য করছেন তারা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মুরগির বর্জ্য দিয়ে আমাদের দেশেই প্রতিদিন ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন একজন খামারী। কিন্তু বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে নিচ্ছেন না অন্যরা, এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না তেমন। পরিকল্পিতভাবে তৈরি করে এই বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডেও দেওয়া সম্ভব। কিন্তু একটি বৃহৎ সম্ভাবনা অযত্নেই হারিয়ে যেতে বসেছে।

বাংলাদেশের পোল্ট্রি মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আট-নয় বছর আগে থেকেই গাজীপুরের পোল্ট্রি খামারে মুরগির বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে মাসে চার লাখ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে৷ এই কনসেপ্ট বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’ তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়া বায়োগ্যাস জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা সম্ভব৷ আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও বর্জ্য হিসেবে পাওয়া যায় জৈব সার৷’

মাংস-ডিমের বাইরেও সম্ভাবনা অফুরন্ত: বিশ্বের অনেক দেশে পোল্ট্রি শিল্প থেকে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য, গৃহস্থালী পণ্য, শো-পিস তৈরি হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করা হচ্ছে পোল্ট্রি লিটার। পোল্ট্রি থেকে বায়োগ্যাস ও জৈব সার তৈরি করা সম্ভব, যা দেশের জ্বালানির চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে মুরগীর মাংস এবং ডিমই সংগ্রহ করা হয় এই খাত থেকে। ফলে শুধু উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে হাতে থাকা কাঁচামাল থেকে আমরা কোনো সুবিধা নিতে পারছি না।

আমরা অনেকেই জানি না মুরগির পা থেকে মাথা সব কিছুই অর্থকরী। মাংস এবং ডিমের বাকী সব অংশ দেশের বাইরেও রপ্তানি হতে পারে। এতে দেশে আসতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে বড় হোটেলগুলোয় ডমিস্টিক হিসেবে মুরগির এসব উপকরণ অপরিচ্ছন্নভাবে বিক্রি করা হচ্ছে।

এখনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতেই আটকে আছে পোল্ট্রি: পোল্ট্রি দেশের একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ও বিকাশমান শিল্প। কিন্তু এই শিল্পকে ঘিরে খুব বেশি পরিকল্পিত কার্যক্রম গৃহীত হতে দেখা যায়নি। পোল্ট্রির উন্নয়ন বলতে এখনো চলছে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পর্ব। মাংস ও ডিমের বাইরে এই খাত নিয়ে খুব বেশি পরিকল্পনা করতেও দেখা যাচ্ছেনা নীতিনির্ধারকদের। দেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) অবদান রেখে যাওয়া এই শিল্পের উন্নয়নে তাই সমন্বিত উদ্যোগ ও কার্যক্রমের পরামর্শ দিচ্ছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। কারণ, ইতিমধ্যে পোল্ট্রি শিল্প প্রমাণ করেছে এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনমুখী খাত। পোশাক শিল্পের পরেই বিপুল সংখ্যক জনবল এই শিল্পে নিয়োজিত।

বিভিন্ন নীতিমালা, সরকারের বিভিন্ন সময়ে নেওয়া কিছু পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতিমালা ও পরিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অন্যান্য শিল্পের মতো বাংলাদেশে পোল্ট্রি খুব একটি গুরুত্ব পায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে এ খাতের উন্নয়নে কথা বলা হয়, কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় কিন্তু প্রকৃত উন্নয়নে এসব খুব বেশি প্রভাব ফেলছে না।

খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ এবং বিভিন্ন তথ্য-পর্যালোচনার মাধ্যমে মোটাদাগে পোল্ট্রি শিল্পের যে সব সমস্যা চিহ্নিত করা যায়- মূলধন সমস্যা; ব্যবসা পরিচালনায় আর্থিক সহযোগিতার অভাব; পোল্ট্রির জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয় না, নেই বীমা সুবিধা; শিল্পের প্রসারে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই; সুস্থ-সবল রোগমুক্ত বাচ্চার অভাব; সুষম খাদ্য সমস্যা ও পোল্ট্রি খাদ্যের উচ্চমূল্য; পোল্ট্রি খাতে চিকিৎসার অভাব, ওষুধপত্র ও প্রতিরোধক টিকার উচ্চমূল্য; সরকারি মনিটরিংয়ের অভাব; নিবন্ধনে অনাগ্রহ, বাজারজাতকরণ সমস্যা; সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব; শ্রমিক সংকট প্রভৃতি।

এসব সমস্যার জন্য অনেকে হাঁস-মুরগির খামার বাড়াতে বা নতুন খামার সৃষ্টিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আবার, সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটেই চলে যায় মুনাফার বিশাল একটি অংশ। এর পরের মুনাফাটা পায় খুচরা বিক্রেতারা। কিন্তু যারা অর্থ লগ্নি করে ফার্ম দাঁড় করিয়েছেন, লাভের অংশটা তাদের পকেটে যায় কালেভদ্রে।

শিল্প বিকাশে প্রয়োজন আন্তরিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা: খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবার আগে প্রয়োজন পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সমন্বয়ে সরকার কর্তৃক একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন। ব্যাংক ঋণ, রপ্তানি প্রক্রিয়া, শিল্প বিকাশে সরকারি প্রকল্প গ্রহণ প্রভৃতি সহজ হওয়ার মাধ্যমে তখন নীতিমালার আলোকে এই শিল্পের বিকাশ এবং প্রসার হতে পারে।

পোল্ট্রি শিল্পে মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও প্রথমেই ধাক্কা সামলাতে হয় বাচ্চা-মুরগী নিয়ে। কারণ, দেশে লেয়ার-ব্রয়লার চাহিদামাফিক পাওয়া গেলেও সুস্থ-সবল রোগমুক্ত বাচ্চার খুব অভাব। খামার করতে আগ্রহীদের অবশ্যই ১ দিনের মুরগির বা হাঁসের বাচ্চা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় সকল হ্যাচারিতে প্যারেন্ট ঝাঁকের মাধ্যমে বাচ্চাতে রোগ ছড়ায় এবং এ বাচ্চা খামারিদের কাছে যখন সরবরাহ করা হয় তখন কিংবা পরে পালনের সময় বাচ্চার মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া লেয়ার বাচ্চার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম বিধায় খামারিদের পোল্ট্রি ঘর ফাঁকা রেখে অনেকদিন পর্যন্ত বাচ্চার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

এই সমস্যার সমাধানে বাচ্চা উৎপন্নকারী খামারের জন্য সরকারের ঋণ সুবিধা রাখা খুব প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এমনিতেই এই খাতের জন্য ঋণ সুবিধা নেই, তার উপর বাচ্চা উৎপন্ন করা খামারগুলোতে লাভ বেশি থাকলেও চ্যালেঞ্জ এবং নিজেদের খরচও বেশি। চাপমুক্ত থেকে উৎপাদনে হাত দিতে না পারলে তা উৎপন্ন বাচ্চায় প্রভাব পড়তে পারে, যা প্রকৃতপক্ষে প্রভাব পড়বে অন্য খামার তথা পোল্ট্রির ওপর। পাশাপাশি হ্যাচারিগুলো যাতে নিম্নমানের বাচ্চা উৎপাদন করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারি মনিটরিং থাকা জরুরী।

সুষম খাদ্য সমস্যা ও পোল্ট্রি খাদ্যের অধিক মূল্য এ শিল্পের আরেকটি বড় বাঁধা। শুধু মুরগী কেন, যে কোনো প্রাণীর জন্য সুষম খাদ্য কতটা প্রয়োজন তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে নিন্মমানের ও ভেজাল পোল্ট্রি খাদ্যের ছড়াছড়ি বাজারে। এমনকি ট্যানারির বর্জ্য দিয়েও পোল্ট্রি খাদ্য বানাচ্ছে অনেকে। মাত্র দুদিন আগেই ২১ অক্টোবর সাভারের হেমায়েতপুরের যাদুরচড় এলাকায় ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে মুরগি ও মাছের ভেজাল খাদ্য তৈরির একটি কারখানা সিলগালা করে দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। খুব কম সংখ্যায় এ ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়, তবে নিয়মিত পরিচালিত হলে এ ধরনের অপচেষ্টা অনেকটাই কমতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রসঙ্গত, ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে মুরগি ও মাছের জন্য তৈরি করা খাদ্যে মানবদেহে ক্যান্সারসহ নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।

বেশির ভাগ রোগ বিশেষ করে ভাইরাসজনিত রোগের কোন ফলপ্রসু চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই দেশে। রোগের জন্য ওষুধ প্রয়োগের বেশি খরচ পড়ে, ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। প্রতিরোধ ব্যবস্থা উত্তম হলেও বিদেশ থেকে আমদানি করা টিকা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় না। ওসব টিকার মূল্যও বেশি।

বাংলাদেশে বাজারজাতকরণ সমস্যা শুধু পোল্ট্রি নয়, দেশের অন্যতম প্রধান খাত কৃষির জন্যও সমস্যা। এখনো দেশের কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পায় না। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিষয়টি থাকলেও বাস্তবচিত্র স্বাধীনতার এতো বছরেও বদলায়নি। একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পের লোকজন। ডিম, ব্রয়লার মুরগি এবং ছাঁটাই করা হাঁস-মুরগী বিক্রয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বাজার ব্যবস্থা দেশে এখনো গড়ে উঠেনি। তাই সর্বক্ষেত্রে প্রকৃত খামারিরা প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। লাভের সিংহভাগ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। সুনির্দিষ্ট বাজার ব্যবস্থা না থাকায় প্রকৃত খামারিরা লোকসানেও বিক্রি করতে বাধ্য হন অনেক সময়।

আমাদের দেশে পোল্ট্রি বীমা নেই অথচ উন্নত দেশে এমনকি ভারতেও প্রতিটি পোল্ট্রি খামার বীমাকৃত। ফলে রোগে আক্রান্ত হয়ে বা অন্য কোন সমস্যায় খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বীমাকৃত অর্থ পায়। আমাদের দেশে এই ‍সুবিধা না থাকায় অনেক সময় ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নেন কম।

২০১২ সালের দিকে মুরগীতে বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ দেখা দেয়। ২০১৪ সালে জানানো হয়, বাংলাদেশসহ এশিয়ার পাঁচটি দেশ বার্ড ফ্লু’র নতুন ভাইরাস এইচ৭এন৯-এর ঝুঁকির মুখে রয়েছে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে পোল্ট্রি শিল্পের জন্য বীমা চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু চার বছরেও বিষয়টির বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ব্যাংকাররা পোল্ট্রি শিল্পে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। শুধু সোনালী ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) বিভিন্ন শর্তে মাঝারি খামারিদের ঋণ দিয়ে থাকে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ অক্টোবর ২০১৮/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়