ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিল্প রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজন ইতিবাচক প্রচার

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৫, ২৯ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিল্প রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজন ইতিবাচক প্রচার

অলংকরণ : গিয়াস উদদীন সিজার

হাসান মাহামুদ : গত কয়েক বছরে কৃষি খাতে অভাবনীয় সাফল্যের কারণে দেশ এখন অনেকটাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য নিরাপত্তার সফলতার পর পুষ্টি নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। গরু ও খাসির মাংসের দাম যখন তরতর করে বাড়ছে তখন সাশ্রয়ী দামে মিলছে পোল্ট্রি মুরগি ও ডিম। কিন্তু কিছু নেতিবাচক প্রচারের কারণে পোল্ট্রির এত অর্জন অনেকটাই ম্লান হয়ে আছে।

বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের শুরুটা মোটেও আশাব্যঞ্জক ছিল না। সাধারণ মানুষ পোল্ট্রির ডিম কিংবা ব্রয়লার মুরগির মাংস খেতেই চাইত না। পোল্ট্রির মাংস যে কতটা সুস্বাদু, নরম এবং স্বাস্থ্যসম্মত তা বোঝাতে শুরুর দিকের উদ্যোক্তাদের অতিথি ডেকে এনে রান্না করা মাংস পরিবেশনও করতে হয়েছে। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এক সময়ের আমদানিনির্ভর খাতটি রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পোল্ট্রি উদ্যোক্তা, খামারিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই এ অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়েছে।

তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন সময় এসেছে এ খাতের উন্নয়নে প্রচারে জোর দেওয়ার। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তারা।

বিশ্বজুড়েই বাড়ছে মাংস ও ডিমের ব্যবহার:
দেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদার সিংহভাগ জোগান দিচ্ছে পোল্ট্রি খাত। সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে এ খাতের অবদান এখন অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বাস্থ্যগত কারণে সারা বিশ্বে বর্তমানে রেড মিট (গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও উটের মাংস) খাওয়ার পরিবর্তে হোয়াইট মিট (মুরগির মাংস) খাওয়ার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উন্নত বিশ্বের মানুষ বছরে মুরগির মাংস খায় ৪০ থেকে ৪৫ কেজি। বাংলাদেশের মানুষ মুরগির মাংস খায় বছরে ৪ দশমিক ২ কেজি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও এফএওর যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষকে বছরে অন্তত ৪৩ দশমিক ৮০ কেজি প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করছে ১৫ দশমিক ২৩ কেজি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে- দেশে দৈনিক মুরগির মাংসের ঘাটতি জনপ্রতি ২৬ গ্রাম ও ডিমের ঘাটতি ২৩ গ্রাম। এ কারণে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ খর্বাকৃতির, ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ কম ওজনের এবং ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ শীর্ণকায়।

প্রাণিজ আমিষের এ চাহিদা তথা পুষ্টির চাহিদা মোকাবিলায় সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক অন্তত সাড়ে ৪ কোটি ডিম এবং দৈনিক সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদন করতে হবে। মোট প্রাণিজ আমিষের ৪৫ শতাংশ যোগান দেয় পোল্ট্রি শিল্প। এ শিল্প বাড়াতে বিনিয়োগ দরকার ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

কৃষির পরই পোল্ট্রি শিল্পকে বাড়ানো হলে আগামীর পুষ্টির চাহিদা ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, এমনটিই মনে করেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞগণ। একই সঙ্গে এ খাতটি দিন দিন রপ্তানির সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রতি মুরগির মাংস খাওয়ার হার ৫০ দশমিক ১ কেজি। কানাডায় এ হার ৩৬ দশমিক ৫ কেজি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডিম খায় জাপানের মানুষ- জনপ্রতি বছরে ৬০০টি। উন্নত দেশে এ হার জনপ্রতি বছরে ২২০টি।

সময় এসেছে পোল্ট্রি নিয়ে ধারনা পরিবর্তনের:
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের জন্য দৈনিক ৬০-৭০ গ্রাম ও নারীদের জন্য দৈনিক ৫০-৬০ গ্রাম প্রাণিজ আমিষ প্রয়োজন। কিন্তু উন্নত দেশে যেখানে মোট আমিষের দৈনিক চাহিদার ৭০ শতাংশ আসে প্রাণিজ আমিষ থেকে, সেখানে আমাদের দেশে মোট আমিষের মাত্র ১০-১৫ ভাগ আসে প্রাণিজ আমিষ থেকে। প্রাণিজ আমিষ কম গ্রহণের কারণে আমরা জাতীয় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছি। এজন্য মাংস ও ডিম খাওয়া বাড়ানোর পরামর্শ দেন পৃষ্টিবিদরা।

এক সময় মানুষ মনে করতো, পোল্ট্রি মানেই অপরিষ্কার পরিবেশ। কিন্তু সেই ধারণা ভাঙতে মানুষের বেশিদিন লাগেনি। তবে এখনো অনেকেই ডিমের বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করেন। তা হলো- ডিমে চর্বি বেশি। বিষয়টি পুরোপুরি সত্য নয় বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আশরাফ আলী। তিনি বলেন, একটা কুসংস্কার আছে, দেশি মুরগির মাংস ও ডিমে ফার্মের মুরগি ও ডিমের চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে। কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয়। দুটোরই পুষ্টিমান সমান।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ আকারে কিছুটা খাটো হয়। এটি পুরোপুরি আবহাওয়া বা ভৌগোলিক কারণে নয়। আমাদের খাদ্যাভ্যাসও দায়ী। এটি দূর করতে প্রোটিন দরকার। আর প্রোটিনের জন্য সহজলভ্য খাদ্য হলো মুরগির মাংস ও ডিম।

একটা সময় এ দেশের মানুষ ফার্মের ব্রয়লার মুরগি খেত না। বর্তমানে পুষ্টির প্রয়োজনে এ সাদা মুরগির মাংস খাওয়া শুরু হয়েছে। এছাড়াও চিকেন নাগেট, সসেজ মিটবল বার্গার, ড্রাম স্টিকসহ অনেক মজাদার ও সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে মুরগির মাংস দিয়ে। গ্রামের মানুষ ও বর্তমান প্রজন্ম মুরগি থেকে কম দামে প্রাণিজ আমিষ পাচ্ছে।

রয়েছে নেতিবাচক প্রচারণা:
অনেক সময় বলা হয়, পোল্ট্রি মুরগিতে হরমোন ইনজেক্ট করা হয়। বাংলাদেশের পোল্ট্রি মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, এটি ভুল ধারণা। মুরগির জন্য কোনো হরমোন নেই। মানুষের শরীরে যেমন হরমোন স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি হয় ঠিক তেমনই জীবজন্তুর শরীরেও হরমোন তৈরি হয়। অনেকের মনে হতে পারে যে, ফিড অ্যাডেটিভ হিসেবে হয়ত গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার থাকতে পারে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগেই অ্যাডেটিভ হরমোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, হরমোন দিয়ে যদি মুরগি বড় করতে হয় তবে প্রতি ৯০ মিনিট পর পর ইনজেকশন দিতে হবে। প্রথমত, এত ঘন ঘন ইনজেক্ট করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি এটি করাও হয় তাহলে মুরগির মাংসের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে। এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে উন্নত ব্রিড নির্বাচন এবং ফিডের কোয়ালিটি। এখনকার ফিড এত সায়েন্টিফিকভাবে তৈরি করা হয় যেন তা খুব সহজেই হজম হয় এবং খাদ্যের উপাদানগুলো সঠিকভাবে দেহের বৃদ্ধিতে কাজে লাগে। সে কারণেই পোল্ট্রিতে সবচেয়ে বেশি খরচ করা হয় ফিডে।

অনেকে অ্যান্টিবায়োটিকের কথা বলে থাকেন। আমাদের দেশে পোল্ট্রি ফিডে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সরকারিভাবেই নিষিদ্ধ। পোল্ট্রি বার্ডের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। আর রোগের সংক্রমণ হলে যদি অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় তবে সেক্ষেত্রে ভ্যাটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শে তা ব্যবহার করা হয়। ব্যবহারের নির্দিষ্ট মেয়াদ অতিক্রম হওয়ার পরই সাধারণত মুরগি বিক্রি করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ৫-৭ দিন পর মুরগির মাংস খেলে সাধারণত কোনো রেসিডিউ থাকে না।

ডিম খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে- এমন ধারণা অমূলক। ডিমে যে কোলেস্টেরল রয়েছে তা ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী। আধুনিক গবেষণা বলছে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট করোনারি হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক কিংবা করোনারি ভাসকুলার ডিজিজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাষ্য মতে, একজন সুস্থ-সবল মানুষ প্রতিদিন একটি করে ডিম খেতে পারে। সঙ্গে আরো জানিয়েছে ডিম হৃৎপিণ্ডে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না, ফলে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম থাকে।

গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ:
সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম সবসময়ই একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শিক্ষিত সমাজেও পোল্ট্রি খাত নিয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। গণমাধ্যম ইতিবাচক বিষয়গুলো ‍তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। পুষ্টি নিরাপত্তায় পোলট্রির অবদান অনেক- এ ধরনের বিষয়গুলোও নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তুলে ধরা প্রয়োজন।

এই খাতের আরো উন্নয়নের পথে বেশকিছু বাধা রয়েই গেছে। আগে এই খাত আয়করমুক্ত ছিল। কিন্তু এখন কর যুক্ত করা হয়েছে। অগ্রিম করও রয়েছে। এগুলো তুলে দেওয়া দরকার। পোল্ট্রির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে টিকা আমদানি করা দরকার। এই খাতের জন্য করা আইন ও নীতিমালা যুগোপযোগী করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়গুলো স্থান পেতে পারে গণমাধ্যমে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোল্ট্রি বিষয়ে শুধুমাত্র মুরগির মাংস ও ডিম নিয়ে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এর মধ্যে হাঁস, কবুতর ও টার্কি নিয়েও আলোচনা আনতে হবে। পোল্ট্রি যেহেতু একটি সায়েন্টিফিক এবং স্পর্শকাতর শিল্প, তাই এ বিষয়ে রিপোর্ট করার আগে প্রয়োজনীয় তথ্য পরিপূর্ণভাবে জেনে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন কোনো ধরনের ভুল তথ্য না যায়।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ অক্টোবর ২০১৮/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়