ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

দৃষ্টি এখন গণভবনের দিকে

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৭, ১ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দৃষ্টি এখন গণভবনের দিকে

এসকে রেজা পারভেজ : নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বেশকিছু ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে সংলাপ নিয়ে পুরো জাতির দৃষ্টি এখন গণভবনের দিকে। প্রায় পাঁচ বছর দুটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এই সংলাপের আগে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য আসলেও দেশের মানুষ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে এই সংলাপ।

গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশে আসেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপে বসাতে। দুটি দলকে সংলাপ বসাতে পারলেও কার্যত কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি তিনি।

বিএনপি বারবার সংলাপরের আহ্বান জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করে আসা আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্যন্টের সঙ্গে সংলাপে রাজি হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সব জায়গায় আলোচনার ‘হট টপিক’ এখন সংলাপ।

বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সত্বেও সংলাপকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন নতুন এই জোট নেতারা। যদিও বিএনপি এই সংলাপের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দলটি নেতারা বলছেন, একদিনে খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি ও আরেকদিকে সংলাপের আহ্বান ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’।

জনগণের ঐক্যের ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, জানিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘সংলাপে আমি বিশ্বাস করি। আশা করি, সংলাপ ভালো কিছু বয়ে আনবে। এই সংলাপের সফলতা ঐক্যবদ্ধভাবে ধরে রাখতে হবে। যাতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে সংলাপের সফলতা জিম্মি না হতে পারে।’

দলীয় নয়, জাতীয় স্বার্থ নিয়ে গণভবনে সংলাপ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা সবসময় মনে করি, জনগণ ক্ষমতার মালিক। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করবে দেশের স্বার্থ নিয়ে, দলীয় স্বার্থে না।’

‘আমরা চাই, জাতীয় স্বার্থ নিয়ে সংলাপ হোক। জাতীয় লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে, সংবিধানের মূল্যবোধকে সামনে রেখে সেই আলাপ অবশ্যই হোক- এটা আমরা সবসময় সমর্থন করেছি,’ বলেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি এবং সরকারের সংলাপের আমন্ত্রণকে দ্বিমুখী আচরণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তার মতে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে কোনো সংলাপ বা নির্বাচন ফলপ্রসূ হবে না। এতে সংলাপের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলেও মনে করেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে এটা থেকেই প্রমাণিত হয়, একদিকে সরকার সংলাপের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে, অন্যদিকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি করা- এই দুটো সাংঘর্ষিক। এটা কখনোই গণতান্ত্রিক কোনো আচরণের প্রতিফলন ঘটায় না। এতে সংলাপের যে আন্তরিকতা, সে আন্তরিকতা প্রমাণ করে না।’

সাত দফা দাবির ‍ভিত্তিতেই সংলাপ হবে, জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের সাত দফা দাবি পুরোটাই মেনে নিতে হবে। সবার আগে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ বাতিল করতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করে অবাধ নির্বাচন দিতে হবে। জনগণের চাহিদা পূরণ করতে হবে। ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। সর্বপ্রথম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। তার মুক্তি না হলে কোনো নির্বাচন অর্থবহ হবে না।’

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপের বিষয়ে যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সেখানে ‘সংবিধানসম্মত বিষয়ে’ আলোচনার কথা বলেছেন। অর্থাৎ সংবিধানের ভেতর থেকেই সমাধান খুঁজতে চাইছে ক্ষমতাসীন দল। দলটির নেতাদের বক্তব্যেও সে ধরনের ইঙ্গিত এসেছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ সংবিধানের আলোকেই হবে, জানিয়ে আওয়ামী লীগে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘সংলাপ হবে। সব দলের সঙ্গেই সংবিধানের আলোকে সংলাপ করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দ্বার উন্মুক্ত। একটা কথা মনে রাখতে হবে, নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনে। সুতরাং সংলাপে গিয়ে সংবিধানের বাইরে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই।’

এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, সংলাপে আলোচনা হবে সব বিষয়ে, তবে সংবিধানের আলোকে সিদ্ধান্ত হবে। সংলাপ ফলপ্রসূ না হলেও সুনির্দিষ্ট সময়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান নির্বাচন কমিশন অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আমাদের সবারই লক্ষ্য অবাধ নির্বাচন।

তবে যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘আলোচনা থেকে অনেক কিছুই জানা যাবে। আলোচনার কিছু নির্দিষ্ট করা নেই, যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রিকন্ডিশন দেননি।’

খালেদা জিয়ার রায় ও সংলাপের বিষয়ে বিএনপির বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রায় প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ দেয়নি, রায় দিয়েছেন আদালত। লিগ্যাল ম্যাটারের সাথে ডায়লগের কী সম্পর্ক? ডায়লগ ডায়লগের মতো চলবে। যেহেতু কোনো প্রিকন্ডিশন এখানে নেই, তারা আলোচনা করতে পারে, কিন্তু এ বিষয় তো একেবারে আদালতের বিষয়।’

সংলাপ নিয়ে পরস্পরবিরোধী ও নেতিবাচক বক্তব্য আসলেও এর ফলাফল নিয়ে আশাবাদী যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তিনি বলেছেন, ‘আমি আশাবাদী’।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্শা বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশ কোন পথে যাবে তা এ দেশের জনগণের ওপরই নির্ভর করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের অধিকার রয়েছে নিজের পছন্দ অনুযায়ী নেতৃত্ব নির্বাচনের দাবি সরকারের কাছে তোলার।

জাতীয় ঐক্যফ্র‌ন্টের স‌ঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলা‌পে নেতৃত্ব দে‌বেন দল‌টির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিনি‌ধিদ‌লে তি‌নি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের ২১ জন প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নেবেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, মো. আবদুর রাজ্জাক, কাজী জাফর উল্যাহ, রমেশ চন্দ্র সেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, দীপু মনি, আবদুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ, আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও জাসদের একাংশের সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল সংলাপে বসবেন।

এদিকে, জাতীয় ঐক্যফ্যন্টের ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলে থাকছেন- গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গণফোরামের সভাপতি মোস্তফা মহসীন মন্টু, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমেদ, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির সহ-সভাপতি তানিয়া রব, নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা এস এম আকরাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন।

সংলাপ চেয়ে ড. কামাল হোসেনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকালে চিঠি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বৃহস্পতিবার গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার দিন সন্ধ্যা ৭টায় আলোচনায় বসবে দুই পক্ষ।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের পর ধারবাহিকভাবে বিকল্পধারা ও জাতীয় পার্টির সঙ্গেও বসবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ নভেম্বর ২০১৮/রেজা/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়