ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সুবীরদা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন || তিমির নন্দী

তিমির নন্দী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ৯ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুবীরদা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন || তিমির নন্দী

সুবীরদা’র সঙ্গে প্রথম একত্রিত হয়েছিলাম ঢাকায় ১৯৬৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান মিউজিক অ্যান্ড ডান্স কম্পিটিশনে। তিনি ছিলেন সিনিয়র গ্রুপে, আমি জুনিয়র গ্রুপে। যদিও সেই সময়ের কোনো স্মৃতি তাঁর সঙ্গে আমার ছিল না। অথবা বলা যায় যে, তাঁর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক তখনও তৈরি হয়নি। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূত্রপাত হয় ১৯৭৭ সালে। আমি তখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমানে রাশিয়া) সঙ্গীত বিষয়ে লেখাপড়া করছিলাম। ওখানে সুবীরদা’র ছোট ভাই, সুবিনয় নন্দীও পড়াশোনা করতো। ওর কণ্ঠে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখা, সুরে এবং গাওয়া ‘বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে’ গানটি শুনে অভিভূত হই! সেই সূত্রে সুবিনয়ের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সুবিনয়ের কাছে সুবীরদা’র কথা জানতে পারি। তার কিছুদিন পর আমার একটি কোর্স শেষ হওয়ায় বাংলাদেশে আসি। আমার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে নারায়ণগঞ্জ আদমজী জুট মিলে একটি অনুষ্ঠানে একই গাড়িতে আমি এবং সুবীরদা রওনা হই। মূলত সেই থেকে সুবীরদা’র সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূত্রপাত। এবং এই সম্পর্ক পারিবারিকভাবেও ছিল। আমাদের দুই পরিবারে পরবর্তী সময়ে যাতায়াতও হয়েছে। যাই হোক, স্বভাবতই আমি সেদিন তাঁর ছোটভাই সুবিনয়ের কথা বলি। সুবীরদা শুনে খুশী হন। পথে যেতে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমার গানের খাতার মধ্যে শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘পদ্মা নদীর পারে আমার ছোট্ট সবুজ গ্রাম’ গানটি লেখা আছে কি না? আমি ছোটবেলা থেকেই শ্যামল মিত্রের ভক্ত। গানটি আমার কাছে ছিল জেনে সুবীরদা আরো খুশী হয়ে বললেন যে, অনুষ্ঠানে তিনি এই গানটি গাইতে চান এবং আমি যেন আমার খাতাটি সে সময় তাঁকে দেই। পরে তিনি আমার খাতা দেখেই অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের গানটি গেয়ে শোনান।

এরপর আমি আবারও রাশিয়া চলে যাই এবং ফিরে আসি ১৯৮৩ সালে। সে সময় পরিচয় হয় প্রখ্যাত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ-এর সাথে। তিনি এবং তাঁর পরিবার ভীষণ সঙ্গীতপিপাসু। বুলবুল ভাই প্রায় সন্ধ্যায় ফোন করে আমাকে এবং সুবীরদাকে তাঁর বাসায় গান গাইতে ডাকতেন। আমরা বুলবুল ভাই এবং ভাবীর অনুরোধের গানও গাইতাম। কখনও কখনও ডিনার করে ফিরতাম। ন্যাশনাল ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট কাদের ভাইয়ের সঙ্গে বুলবুল ভাইয়ের ভালো সম্পর্ক ছিল। আবার কাদের ভাইয়ের সঙ্গে শাহীন আপা (শাহীন সামাদ)-রও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সুবীরদা, শাহীন আপা এবং আমি প্রায় রাতেই গুলশান এবং বনানীতে সারা রাত গানের জলসায় গান গাইতাম। পরে কণ্ঠশিল্পী শুভ্র দেবও যোগ দিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। বুলবুল ভাই ভোর বেলা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে আসতেন।

ঢাকার বাইরেও অনেক অনুষ্ঠান আমরা একসঙ্গে করেছি। অনেক স্মৃতি যেগুলো লিখে শেষ করা যাবে না।

সুবীরদা’র গানের কথা তো দেশবাসীর জানা। তাঁর গান নিয়ে অনেক বিস্তারিত লেখা যেতে পারে। তবে সে সব থাক। শুধু এটুকু বলতে চাই যে, এমন একজন গুণী শিল্পীর জন্ম এই বাংলাদেশে আর হবে কিনা জানি না। যেমন ছিল তাঁর গায়কী, তেমনিই ছিল তাঁর অমায়িক ব্যবহার। অনেক শিল্পীদের মতো তাঁর ভেতরে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। ছিল না অহঙ্কার। আর তিনি গান গাইতেন অনায়াসে। কণ্ঠকে তিনি অনায়াসে যেদিকে খুশী সেদিকেই নিয়ে যেতে পারতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী হওয়ায় তিনি যে কোনো গানকে অবলীলায় ইমপ্রোভাইজ করতে পারতেন।  অনেকে সুবীরদা’র গানে মান্না দে’কে খুঁজে পেয়েছেন, সত্যি। তবে তাঁর গানে আমি সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কেও খুঁজে পেয়েছি। সুবীরদা আমারই উপস্থাপনায় বিটিভি’তে ‘হৃদিকল্লোলে’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। আমাদের দু’জনের মধ্যে কেমন সম্পর্ক সেই অনুষ্ঠানে তিনি খুব সুন্দর করে বলেছিলেন। আগ্রহী পাঠক চাইলে ইউটিউব থেকে শুনতে পারেন। লিঙ্কটি সে কারণেই দেয়া:-

বন্ধু, খোকন সিরাজুল ইসলাম-এর কথায় এবং আমার সুরে সুবীরদা একটি দেশের গান করেছেন- ‘এ লগণ আজ বিভোর হয়েছে দীপ্ত আলিঙ্গনে।’ তবে গানটি আমরা দ্বৈতভাবে গেয়েছি। গানটি বিশেষত ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবিদের উদ্দেশ্যে করা। খুব ইচ্ছে ছিল গানটি আমরা কোনো চ্যানেলে শুটিং করে দেখানোর ব্যবস্থা করবো। কিন্তু তা আর হলো না।

ঢাকা সিএমএইচের সেনা চিকিৎসকেরা যেমন সুবীরদাকে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা দিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে তড়িৎ ব্যবস্থা নিয়ে শিল্পীকে বিদেশে ভালো চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেছেন, আবার সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা সুবীরদাকে বাঁচিয়ে তোলার যেভাবে চেষ্টা করেছেন, তা অতুলনীয় এবং তাঁর জন্য আমার অন্তর থেকে সবাইকেই আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ, সুবীরদাকে বাঁচানোর সকল প্রচেষ্টা তাঁরা স্ব স্ব জায়গা থেকে করেছেন।

আজ সুবীরদা সবকিছুর ঊর্দ্ধে চলে গেছেন। তিনি যেখানে আছেন যেন শান্তিতে থাকেন। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। সেইসাথে তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। সবশেষে বলতে চাই যে, শিল্পীরা কখনও মারা যান না। তাঁরা চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন তাঁদের ভক্তকুলে, ভক্তদের মনে। তাই সুবীরদা আজ স্বশরীরে না থাকলেও তিনি তাঁর সৃষ্টি এবং গান নিয়েই আজীবন বেঁচে থাকবেন বাঙালি ভক্তদের মনে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়