ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘শিক্ষা হোক বিনিয়োগক্ষেত্র’

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০০, ১৭ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘শিক্ষা হোক বিনিয়োগক্ষেত্র’

আবু বকর ইয়ামিন : শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী অসুস্থতা অনুভব করার পর তার পক্ষে বাজেট উপস্থাপনকালে এ প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী।

বিষয়টি নিয়ে রাইজিংবিডিরি সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

তারা বলছেন, আমাদের ভালো শিক্ষক নেই। প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরির পরিকল্পনাও নেই। সেটি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাকে একটি বিনিয়োগক্ষেত্র হিসেবে দেখতে হবে।

অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার প্রক্রিয়া আগে থেকেই আছে। তবে সেটি খুবই দুর্বল প্রক্রিয়া। এটিকে গতিশীল করতে হবে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের দেশের শিক্ষকদের কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত করে তোলা যায় সেদিকে।

তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে প্রশিক্ষণের জন্য যে সুযোগ আসে কিংবা দেশের বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার যে সুযোগ আসে সেগুলোতে কিছু সমস্যা রয়েছে। ওগুলো আগে শনাক্ত করতে হবে। এসব জায়গায় যাতে শুধু আমাদের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতে পারেন সেটি শতভাগ নিশ্চিত করতে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে আামাদের সন্তানদেরকে। তারা যাতে শিক্ষকতাকে প্রধান পেশা ও নেশা হিসেবে নিতে পারে সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে।

তাদের এ পেশায় না আসার অনেক কারণ রয়েছে, উল্লেখ করে ড. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একজন শিক্ষক যেসব সুযোগ-সুবিধা পান তার চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন অন্য সেক্টরের আরেকজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী। তাই সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে সবদিক থেকে যাতে শিক্ষকতা প্রাধান্য পায় সেটি নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের মেধাবী সন্তানদের দিয়েই আমরা আগামী সুন্দর কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত তৈরি করতে পারব।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাই। তবে এর মাধ্যমে এটাও একটা স্বীকৃত যে. আমাদের শিক্ষক তৈরি নেই। আমাদের উচিত হবে দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষক তৈরি করা।

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর কাছে বিসিএসটা একটা সোনার হরিণ। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল গবেষণা এবং শিক্ষকতা। আমরা যেভাবেই হোক প্রশাসনকে এমন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছি যে, আমাদের চিন্তাভাবনা হচ্ছে ভালো একটি সরকারি চাকরি পেলে আমি ভালো একটি গাড়ি কিনতে পারছি, সারাজীবনের আখের গুছিয়ে নিতে পারছি। যিনি সৎ তার পক্ষেও সম্ভব আর যিনি অসৎ তার পক্ষে রাজা বনে যাওয়াও সম্ভব।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের যদি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারি তাহলে আমরা মেধাবী শিক্ষক ও জাতি কোথা থেকে পাব। ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো মেধাবী শিক্ষার্থী বা জাতি তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, এটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হতে হয় না। এখানে আমাদের বড় একটি সমস্যা রয়ে গেছে। এটাকে জোড়াতালি দিয়ে বা বিদেশ থেকে শিক্ষক এনে এসব সমস্যা নিরসন করা যাবে না।’

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা আমাদের সমস্যাগুলো দেখছি না। আমাদের দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে, আমাদের শিক্ষার একটি কৌশলপত্র আছে। আমরা সেটিকে মানছি না। পিএসি ও জেএসসিতে সমাপনীর কথা আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে নেই। কিন্তু এটা আমরা রেখে দিয়েছি। ওই যে, কোচিং বাণিজ্য পরিচালকদের হাতে শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে সঁপে দিয়েছি। মুখস্তনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছি।’

‘আমরা যে বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসবো তার আগে আমরা যে বিদেশ থেকে ব্যবস্থাপক নিয়ে রাখছি সেটা তো আমাদের জানতে হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ সুপার ম্যানেজার ভারতীয়, না হয় কোরিয়ান, চীনা কিংবা শ্রীলঙ্কান। সেখানে আমাদের সন্তানদের ঢোকাতে পারলে বিশাল একটা অর্থ বাঁচত। কিন্তু আমাদের সন্তানদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত দক্ষতার প্রয়োজন আছে। তারা ডিগ্রি অর্জন করে কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তেমন দক্ষতা নেই। এখন দেখা গেল, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী আসছে, তার সাথে যোগাযোগ মেইনটেইন করার জন্য একজন দক্ষ লোক দরকার। আমাদের সে জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে,’ বলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা এত দুর্বল যে, বাইরের সুপার ম্যানেজারদের পেছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। এ জায়গাটায় আমরা কেন পারছি না? স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও আমরা কেন একটি প্রশিক্ষিত দক্ষ বাহিনী তৈরি করতে পারছি না। তার অন্যতম কারণ প্রতিবছর আমাদের বাজেট নিয়ে কানাকড়ি হিসাব। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে যায়। যখন প্রশাসনের হাতে সব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এপ্রিল-জুন মাসে বাইরে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। দেখা যায়, যেখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বাইরে যাওয়া দরকার সেখানে দেখা গেল মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এসব জায়গার পিয়ন চলে যাচ্ছে। কোনো সচিব চলে যাচ্ছে। এসব জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি শিক্ষক আনলে সেটার জন্য একটা স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। দেখা গেল, বিদেশি শিক্ষকের বিষয়টিকে একটি প্রকল্পের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো। সেখানে নানান ঝামেলা। আনা হবে ৩০ জন। দেখানো হবে ৪০। এখানে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার প্রয়োজন আছে।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কিউবার মতো দেশ এখন জিডিপির ১২ শতাংশ বরাদ্দ দিচ্ছে শিক্ষায়, ভারত দিচ্ছে সাড়ে ৩ এর বেশি, নেপাল দিচ্ছে ৩ এর বেশি। আমর ২ এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। ভারতে যেটা দেওয়া হচ্ছে সেখানে প্রত্যেকটা পাই পাই পয়সা হিসাব রাখছে। আমাদের এখানে যে বরাদ্দ হচ্ছে সেখানে স্বচ্ছ কোনো হিসাব দেখা যাচ্ছে না।’

‘আমাদের শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে। কিন্তু মান বাড়ছে না। প্রাইমারি থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তাদের বেতন ভাতার স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে। তাদেরকে প্রশাসন থেকে সম্পন্ন বিচ্ছিন্ন করতে হবে।’

বিশিষ্ট এ কথাসাহিত্যিক বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় হবে কৃষি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। সেখানে বিসিএস দিয়ে ইসলামিক স্টাডিজে পড়ে সচিব হয়ে বসে গেল। সেখান থেকে বদলি হয়ে মৎস বিভাগে গেল। এটা কেমন কথা। পুরো সিস্টেমটাকে বদলাতে হবে।’

বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলেন, যতদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক আধিপত্য থাকবে, যতদিন স্থানীয় রাজনীতিবিদদের আধিপত্য থাকবে, যতদিন পর্যন্ত শিক্ষা একটি আকর্ষণীয় পেশা না হবে, যতদিন শিক্ষায় বিনিয়োগ না হবে, যতদিন না শিক্ষার মান নিয়ে আমরা গভীরভাবে চিন্তা করব, ততদিন আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব না।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৯/ইয়ামিন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়