ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জঙ্গি কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক

আশরাফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জঙ্গি কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক

আশরাফুল ইসলাম : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলাকারী জঙ্গিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ।

 

ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যমের নামিদামি স্কুল স্কলাসটিকা কিংবা মালয়েশিয়ায় মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে তাদের লেখাপড়া। তাদের একজন নিবরাস ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। তিনি অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেসের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ধনী পরিবারের সন্তান নিবরাস ইসলাম পড়েছেন ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে, যেখানে খরচের কারণে সব শ্রেণির মানুষের পড়ার সুযোগ হয় না। মোনাশে ভালো না লাগায় দেশে ফিরে নিবরাস ভর্তি হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মীর সামেহ মুবাশ্বের ‘এ লেভেল’ এর শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০ বছর বয়সি রোহান স্কলাসটিকায় পড়া শেষ করে পড়ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে।

 

এদের পরিচয় প্রকাশের পর অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। সরকারও নড়েচড়ে বসেছে। এরপর থেকে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত সন্দেহে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সজাগ দৃষ্টি রাখে সরকার এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।

 

জঙ্গিবাদে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাম আসার প্রেক্ষাপটে গত ১৪ জুলাই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে সরেজমিন তদন্তে যায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগমের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত দল প্রতিষ্ঠানটিতে তদন্ত করে। এর আগে ১২ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর নর্থ সাউথের বিষয়ে তদন্তের ঘোষণা দেন ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান।

 

গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনায় নিহত হন নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জঙ্গি নিবরাস ইসলাম। তিনি কয়েক মাস নিখোঁজ ছিলেন। হলি আর্টিজান থেকে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ছিলেন নর্থ-সাউথের প্রাক্তন শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজা করিম। এছাড়া ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদের আগত মুসল্লিদের ওপর হামলা চালানোর সময় পুলিশের গুলিতে নিহত আবীর রহমানও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ ছাড়া ওই সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রকাশ করা ১০ জন যুবকের মধ্যেও নর্থ-সাউথের দু’জন শিক্ষার্থী ছিলেন।

 

এরপর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ ছাত্রের তথ্য চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এই ৪০ ছাত্র ক্লাসে প্রায়ই অনিয়মিত থাকেন ও দুই বছর ধরে কমবেশি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত। ইউজিসি থেকে একটি তালিকা পাঠিয়ে এই শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশদ তথ্য চায় সরকার। একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই অফিসিয়ালি ওই ৪০ ছাত্রের তথ্য চাওয়া হয়।

 

ইউজিসি সূত্র জানায়, যে ৪০ ছাত্রের তথ্য চাওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষার্থীই ১১ জন। এ ছাড়া বিবিএ, ফিন্যান্স ও প্রকৌশল বিষয়ের আরও কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এর মধ্যে রয়েছেন।

 

বিভিন্ন সময় গ্রেফতার জঙ্গিদের মধ্যে স্কলাসটিকা স্কুলের ১৪তম ব্যাচের এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ও ইইই বিভাগের ছাত্র বেশি। যে কারণে এই দুই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যাচের সব ছাত্রের বিষয়ে খোঁজ নিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব ব্যাচের ও বিভাগের আর কে কোথায় কী করছে, কে মিসিং আছে সে সব তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়।

 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গত সেপ্টেম্বরে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে প্রতিবেদন পাঠায়। এ প্রতিবেদনে জঙ্গী কর্মকাণ্ডে জড়িত হিসেবে ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ওঠে আসে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের ওপর নজরদারি বৃদ্ধিসহ কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়।

 

এরপর এই প্রতিবেদন অনুসারে কার্যক্রম চালানোর পদক্ষেপ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায়। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা তুলে ধরা হয়। এ সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (কমার্স ফ্যাকাল্টি), আগা খান স্কুল (উত্তরা), স্কলাসটিকা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, লেকহেড গ্রামার স্কুল (ধানমন্ডি, বনানী ও মোহাম্মদপুর), তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা (মীর হাজিরবাগ, যাত্রাবাড়ী), দারুল উলুম রহমানিয়া মাদ্রাসা (নিউমার্কেট), জামিয়া নুরিয়া মাদ্রাসা (ডেমরা), লালবাগ জামিয়া কোরানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা, কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসা, জামেয়া মোহাম্মাদিয়া মাদ্রাসা (সাড়ে এগারো, মিরপুর)।

 

ওই প্রতিবেদনে পাঁচ দফা সুপারিশও করা হয়। বলা হয়, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অংশগ্রহণে জঙ্গিবিরোধী আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলকে সচেতন করার কথা বলা হয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র-ছাত্রী যৌক্তিক কারণ ছাড়া ১৫ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রিপোর্ট করার কথা বলা হয়।

 

এরপর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় সরকার। কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে সরকারকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার আচার-আচরণ, চলাফেরার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আহ্বানে গত ১ আগস্ট দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসায় জঙ্গিবিরোধী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গিবিরোধী সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

 

গত ১৭ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় জঙ্গিবাদ নিরসনে পুলিশের পক্ষ থেকে ১২টি প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি গঠন। সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব স্থানে জঙ্গিবাদ নিয়ে বৈঠক হতে পারে সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়ানো। শিক্ষার্থীরা অনিয়মিত হলে অবশ্যই অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। লাইব্রেরিতে জঙ্গিবাদের কোনো বই-পুস্তক থাকলে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে হবে। একাডেমিক কার্যক্রমেও জঙ্গিবাদবিরোধী বিষয় থাকতে হবে। নিয়মিতভাবে বাঙালি সাংস্কৃতিক চর্চা থাকতে হবে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে পুলিশকে জানাতে হবে। অপরাধে জড়িত বলে সন্দেহ হলেই কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসবাদবিরোধী গবেষণা হতে হবে।

 

গত ১৭ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মালিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সরকারের এক মতবিনিময় সভায় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরব রাজনীতির দাবি তোলেন। এর প্রেক্ষিতে গত ২৭ জুলাই রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকায় অবস্থিত সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি দেয় ছাত্রলীগ।

 

সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের ফলে জঙ্গিবাদ নিরসনে কিছুটা সাফল্য এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারপরও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি সম্পৃক্ততার ঘটনা রয়েছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ডিসেম্বর ২০১৬/আশরাফুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়