ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যোগাযোগ খাতে ইতিহাস সৃষ্টির পথে বাংলাদেশ

নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যোগাযোগ খাতে ইতিহাস সৃষ্টির পথে বাংলাদেশ

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন : দ্রুতগতিতে নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলা স্বপ্নের পদ্মাসেতু, এক নগরীতে দুই শহর গড়তে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল, যানজট ও পরিকল্পিত বাসযোগ্য রাজধানী গড়তে স্বপ্নের মেট্টোরেল ও বিআরটি লেন হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য উড়াল সড়ক, ওভারব্রিজ, কালভার্ট।

 

একইসঙ্গে কাজ চলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের সড়কসহ অনেক মেগা প্রকল্পের। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যোগাযোগ খাতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

 

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ও অর্জনের বছর ২০১৬ সাল। বছরজুড়ে এই খাত ছিল আলোচনায়। যোগাযোগ খাতে বিপ্লব ঘটাতে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কারণেই বছর শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

স্বপ্নের পদ্মাসেতু : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনার পর পদ্মাসেতুর রেললাইন প্রকল্প ও মেট্টোরেল প্রকল্পকাজ থমকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পুরোদমে চলে পদ্মাসেতু ও মেট্টোরেল এর নির্মাণকাজ। ইতিমধ্যে ৩৭টি পিলার বসানোসহ ৪০শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চীন থেকে নিয়ে আসা হয়েছে স্প্যান। এসব স্প্যান পিলারের উপর বসিয়ে দিলেই সেতুর রূপলাভ করবে।

 

২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পদ্মাসেতুর সর্বশেষ অগ্রগতি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে পদ্মাসেতুর কাজ। পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামো (সুপার স্ট্রাকচার) নির্মাণের প্রথম স্প্যান একদিন আগেই মাওয়ার পদ্মাসেতুর নির্মাণস্থলে এসে পৌঁছে। বাকীগুলো দ্রুত এসে পৌঁছাবে। স্প্যানগুলো চীনের কারখানায় তৈরি করা হয়েছে। ল্যাব টেস্টসহ অন্যান্য টেস্ট সম্পন্ন করার পর জানুয়ারিতে পিলারের উপর এসব স্প্যান স্থাপনের কাজ শুরু হবে।

 

মূল সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সুপার স্ট্রাকচারে মোট ৪১টি স্প্যান থাকবে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং আনুমানিক ওজন ২ হাজার ৯০০ টন।

 

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় মূল সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। মূল পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পদ্মাসেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

 

স্বপ্নের মেট্টোরেল : যোগাযোগ খাতের আরেকটি মেগাপ্রকল্প রাজধানীতে স্বপ্নের মেট্টোরেল। যানজটমুক্ত রাজধানী গড়তেই এই মেগাপ্রকল্প। এই প্রকল্প ঢাকার চিত্র পাল্টে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের ২৬ জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে ডিপো উন্নয়ণ এবং বিভিন্ন সেবা সংস্থার অবকাঠামো সরানোর কাজ চলছে। ২০১৯ সালে কাজ শেষ করে রাজধানীতে মেট্রোরেল চলাচল করবে। জাপান বাংলাদেশের যৌথ সহায়তায় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।

 

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথ মাত্র ৩৮ মিনিটে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন পুরণ করবে মেট্রোরেল। শুধু তাই নয়, যাত্রীদের যানজটের ভোগান্তি থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজটিও করবে।

 

স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল : বাংলাদেশে এই প্রথম নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণ হচ্ছে। চট্টগ্রামের এক নগরীতে দুই শহর গড়তে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।

 

২০১৬ সালে ১৫ অক্টোবর  ছিল উল্লেখযোগ্য দিন। এদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গণভবনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সব ঠিকঠাক থাকলে ২০১৯ সালের মধ্যে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়েই সড়কপথে যাতায়াত করা যাবে। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।

 

বিআরটি প্রকল্প : অধিক যাত্রী দ্রুত পারাপার, সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব ও আরামদায়ক সেবা নিশ্চিত করে রাজধানী ঢাকাকে যানজট মুক্ত করতে সরকারের মেগা প্রকল্প হচ্ছে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। এটির আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ২৬জুন।

 

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালে বিআরটি-৩ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ, এডিপি, ফ্রান্সের যৌথ সহায়তায় ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতায় বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পটি রাজধানীর উত্তরের গাজীপুর থেকে দক্ষিণের কদমতলী চত্বর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এর দৈর্ঘ্য হবে ৪২ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং যাত্রী সাধারণের উঠা নামার জন্য ৪১টি স্টেশন থাকবে। এসব স্টেশন থেকে প্রতি তিন মিনিট পরপর নির্ধারিত লেনে অধিক যাত্রী বহনে সক্ষম দ্রুত গতির বাস ছেড়ে যাবে।

 

দুই ভাগে বিভক্ত এ প্রকল্পটির লাইন-৩ এর দক্ষিণাংশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কেইস প্রকল্পের অধিনে বাস্তবায়ন করবে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ ডিটিসিএ। এটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের নিচ দিয়ে ও বনানী রেল ওভারপাসের ওপর দিয়ে মহাখালী, সাতরাস্তা, মগবাজার, কাকরাইল, পল্টন, গুলিস্তান, নয়াবাজার ও বাবুবাজার দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এর দৈর্ঘ্য হবে ২২ কিলোমিটার এবং যাত্রী সাধারণের উঠা নামার জন্য ১৬টি স্টেশন, দু’টি বাস ডিপো এবং মহাখালী ও কাকরাইলে দু’টি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।

 

প্রকল্পের উত্তরের অংশ গাজীপুর টার্মিনাল থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। জিডিএসইউটিপি প্রকল্পের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এ অংশ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ২ কিলোমিটার। স্টেশন থাকবে ২৫টি। বাস স্টপেজে প্রবেশ-বাহির ও পথচারীদের পারাপারের জন্য ৩০টি আন্ডারপাস তৈরি করা হবে। ১৮ মিটার দীর্ঘ ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস চলাচল করবে এ পথে।

 

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সংরক্ষিত আলাদা লেনের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবে। স্টেশন থেকে প্রতি তিন মিনিট পর পর ছেড়ে যাবে অধিক গতিসম্পন্ন অত্যাধুনিক বাস। রাজধানীর যানজট নিরসন ও গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে গৃহীত প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। উন্নত বিশ্বে এ ব্যবস্থাটি পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এই প্রথম।

 

২০১৬ সাল যোগাযোগ খাতের ‍উন্নয়ণ ও অর্জনের বছর। এ বছরই ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক উন্নয়ন কাজ, সারা দেশেই ছোট বড় অনেক সেতু, উড়াল সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর খুলে দেওয়া হয়েছে।

 

আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকারের হাতে নেওয়া এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এর মধ্য দিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, পুরো বিশ্বের সামনে উন্নয়নের ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জানুয়ারি ২০১৭/নঈমুদ্দীন/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়