ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণে জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণে জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতা

ঢাকার বাইরে একজন মুক্তিযোদ্ধার কবর অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে

হাসান মাহামুদ : দেশের স্বাধীনতার জন্য যে সব বীর সন্তান বুকের তাজা রক্ত দিয়েছেন কিংবা পরবর্তী সময়ে মারা গেছেন, তাদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, আরেকটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিত করতে জটিলতা ও সময়ক্ষেপন এবং নতুন প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সরকারের এই ইতিবাচক উদ্যোগ সফল হওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে হাতে নেওয়া হয় ‘শহীদদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি। প্রকল্প শেষ করার সময় (মেয়াদ) ধরা হয় ২০১৪ সালের জুনে। ব্যয় ধরা হয় ২৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এতে ৫৭১টি কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে দুজন বীরশ্রেষ্ঠর কবরও থাকার কথা। সাত বীরশ্রেষ্ঠর মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও মুন্সী আব্দুর রউফের কবর সংরক্ষিত ছিল না।

কিন্তু মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য আসাতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়, পাশাপাশি অনেক চাহিদাপত্র নিয়ে প্রশ্নও উঠে। এ জন্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। পরে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবুও প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। এমনকি খোদ ঢাকার মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে থাকা বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কবরটাও সংরক্ষণ করা হয়নি ওই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত থাকার পরও।

প্রসঙ্গত, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর যুদ্ধে শহীদ হন। ওই সময় এই বীর সৈনিকের লাশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা গ্রামে এক মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর তার দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।  

এদিকে স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও তালিকা হয়নি একাত্তরের শহীদদের। তাদের আলাদাভাবে সম্মানিত করার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে কবরসহ অনেকের স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে গেছে সময় পরিক্রমায়। এমনই প্রেক্ষাপটে চলমান প্রকল্পটি অব্যাহত রেখেই নতুনভাবে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।

সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, একই ডিজাইনে সব কবর সংরক্ষণ করার। কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতার  কারণে এই প্রকল্প নিয়েও নেতিবাচক কিছু ভাবছেন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা। কারণ, এই সিংহভাগ শহীদের সমাধিস্থল এখনো চিহ্নিত করা যায়নি।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত দুই হাজার ৯৩৮ জনের নামে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই তালিকার বিশুদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাই ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার কবর সনাক্ত করাই আপাতত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তালিকার পরই তো শুরু হবে সংরক্ষণের কাজ।

মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নিরপেক্ষ ও সর্বজনগৃহীত তালিকাই এখনো আমাদের হাতে নেই, সেখানে কবর কোনো তালিকা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হবে, সেটি চূড়ান্ত নয়। ফলে এক্ষেত্রে সুযোগ অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আবার দেখা যাবে, তালিকার বাইরে স্থানীয় লোকজন বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগ্রহের প্রেক্ষিতে কোনো কবর সংরক্ষণ করা হলো। পরে যদি দেখা যায়, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তখন সেই সংরক্ষিত কবর ভাঙাও যাবে না। ভাঙা গেলেও এ নিয়ে মামলা হতে পারে। আবার তাকে নতুন করে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা খুব কমই হতে পারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ, তাদের কবর সংরক্ষণের বিষয়। এক্ষেত্রে ন্যূনতম ভুল সিদ্ধান্তও জাতি মেনে নেবে না। কারণ, এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় আবেগ, চেতনা জড়িত।’

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মেজর (অব.) এ এস এম সামছুল আরেফিন বলেন, ‘কাজটি কঠিন হলেও এই সম্মান জানানো আমাদের জাতিগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ কতভাবে শহীদ হয়েছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়তো সম্ভব নয় কিন্তু কতজন সশস্ত্র যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন সেই তালিকা না থাকাটা দুঃখজনক।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি সরকারের অধীনে, একটি কাঠামোর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তালিকা তৈরি তাই কঠিন হওয়ার কথা নয়।’

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধক্ষেত্র বা রণাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২২ মে পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রাথমিক অনুমোদন লাভ করে। সে অনুসারে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে গেজেটভুক্ত দুই হাজার ৯৩৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই ও কবর চিহ্নিত করার জন্য সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের গেজেটের কপিসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হয়। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে জেলা প্রশাসকরা যে তালিকা পাঠিয়েছেন তাতে এক হাজার ৪০০-এর মতো মুক্তিযোদ্ধা কবর চিহ্নিত করা হয়। পরে আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধা কবরের বিষয়ে আবেদন এসেছে চিহ্নিত করার জন্য। তবে এগুলো এখনো যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অর্ধেকের বেশি মুক্তিযোদ্ধার কবর চিহ্নিত করা যায়নি। উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব অপরূপ চৌধুরী জানান, প্রাথমিকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সবার কবর এখন আর চিহ্নিত করা নেই তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সব মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণ করা হবে। এ জন্য ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ডিপিপি’র উপর পিইসি’র (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘প্রকল্প ব্যয় প্রাথমিকভাবে ধরা হয়েছে ৩৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অনুমোদন পেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর।’

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে সকল সমাধিস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো দ্রুততম সময়ে সংরক্ষণ করা হবে। অন্য সমাধিস্থলগুলো চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি তালিকা তৈরি করে সংরক্ষিত হবে।’

জানা গেছে, সরকারের নতুন উদ্যোগে একই নকশায় সব মুক্তিযোদ্ধার কবর পাকাকরণ করে সংরক্ষণ করা হবে। নকশা দেখেই যে কেউ চিনতে পারবে সেটি বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর। প্রতিটি কবরের এপিটাফে মুক্তিযোদ্ধার নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া থাকবে। একেকটি কবর সংরক্ষণে ব্যয় হবে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে নির্বাচনী ইশতেহারে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ, শহীদদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। তখন পাঁচ বছর আগে হাতে নেওয়া ‘শহীদদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক আগের প্রকল্পের পটভূমিতে বলা হয়, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংরক্ষিত কবরে নামফলকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় এবং যে যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছেন তাঁর বর্ণনা থাকবে।’

ওই প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে জানা যায়, সারা দেশে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো কোনো কবরে দুই থেকে আটজন মুক্তিযোদ্ধার লাশ রয়েছে। কোনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর এই তালিকায় বাদ পড়েছে কী না, জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে নতুন করে আবেদনও গ্রহণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে বেশি ৯৫টি কবর চিহ্নিত করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ভারতের সীমান্তবর্তী কয়েকটি স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি কবরও সেখানে আনা হবে। এ জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার কুল্লাপাথর এলাকায় তিন একর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী কসবার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক গত সপ্তাহে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কসবার সাগরতলা, কুল্লাপাথর, মাদলা, কইখোলা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্ত এলাকা ছিল। আশপাশের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে কেউ শহীদ হলে এখানে কবর দেওয়া হতো। জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত যুদ্ধে প্রচুর লোক শহীদ হন। বিশেষ করে কসবার যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তখন আবদুল মান্নান ওরফে বিনু ফকির নামের এক ব্যক্তি তার বাড়ির পাশের একটি জায়গা মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের জন্য দান করেন। সেখানেই ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪৯ জনের পরিচয় জানা গেছে।

আগের প্রকল্পে এই স্থানটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গোপালগঞ্জে ৭০, কুষ্টিয়ায় ৪৭, ঝিনাইদহে ৪০, ফেনীতে ৩৫, কুমিল্লায় ৩৩, নোয়াখালীতে ২৭, জামালপুরে ২৩, ঝালকাঠিতে ১৮, কুড়িগ্রামে ১৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪, সিরাজগঞ্জে ১৩, যশোর ও বগুড়ায় ১২টি করে, মেহেরপুরে ১১, নড়াইল ও কিশোরগঞ্জে ১০টি করে, দিনাজপুরে আট, হবিগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে ছয়টি করে, গাইবান্ধা, কক্সবাজার ও নরসিংদীতে সাত, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা ও রাজবাড়ীতে পাঁচটি করে, ঠাকুরগাঁও ও মৌলভীবাজারে চারটি করে, নেত্রকোনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও শরীয়তপুরে তিনটি করে, বান্দরবান ও মাদারীপুরে দুটি করে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বরগুনা ও রাজশাহীতে একটি করে কবর সংরক্ষণ করা হবে।

এ বিষয়ে জনসাধারণকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে জনগণ সরকারকে সাহায্য করলে এবং কবর নিয়ে জালিয়াতি করার চিন্তা পরিহার করলে উদ্যোগে সফলতা আসবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়