ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

এক কলসি পানির জন্য ১০ কিমি পথ পাড়ি!

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০২, ২৬ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক কলসি পানির জন্য ১০ কিমি পথ পাড়ি!

অধিকাংশ টিউবওয়েল পরিত্যক্ত, অনেক চেষ্টার পরও উঠছে না পানি

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের পানযোগ্য এক কলসি পানির জন্য ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তারপরই মিলছে কাঙ্ক্ষিত পানি। আর যারা ক্লান্ত শরীরে দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে পারছেন না তাদের নগদ টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাবার পানি। এভাবেই গ্রীষ্মে পানি সংগ্রহে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের।

গরমের প্রচণ্ড তাপদাহ এবং কৃষিকাজের জন্য অতিমাত্রায় সেচপাম্প দিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। ফলে পানির স্তর (লেয়ার) নিচে নেমে গেছে। এ কারণে গ্রামের অধিকাংশ ডিপ-টিউবওয়েলেই (নলকূপ) পানি উঠছে না, পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। লবণাক্ততায় পুকুরের পানিও পানের অযোগ্য। ফলে সুপেয় পানির অভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে।

খুলনা জেলা সদর থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে ডুমুরিয়া উপজেলার ৭ নং শোভনা ইউনিয়নের অবস্থান। ইউনিয়নটির পূর্বে রয়েছে ডুমুরিয়া থানা, পশ্চিমে আটলিয়া, উত্তর ৪ নং খর্ণিয়া ও দক্ষিণে মাগুরখালি। ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে উঠেছে ইউনিয়নটি। ৪০ হাজার জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ এ ইউনিয়নে মোট ভোটার রয়েছে ১৮ হাজার। কিন্তু চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচণ্ড খরা ও কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য অতিমাত্রায় সেচপাম্প স্থাপনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বেশিরভাগ নলকূপে পানি উঠেছে না। গৃহস্থলির কাজে পুকুর, নদী ও খালের লবণাক্ত পানি ব্যবহৃত হলেও বাদুরগাছা ও বাগাছড়াসহ প্রতিটি গ্রামেই সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য এলাকা থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের।

শোভনা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য দেবব্রত সরদার বলেন, তার ওয়ার্ডে ৫০টির অধিক গভীর নলকূপ রয়েছে। এসব নলকূপের গভীরতা অন্তত ৫৩০ ফুট। কিন্তু বর্তমানে মাত্র একটি নলকূপে পানি উঠছে। বাকিগুলোতে পানি উঠছে না। ফলে ১০ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালতলা বাজার থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে, অথবা সেচপাম্প থেকে ৫০ লিটার পানি ২০ টাকা দরে কিনে আনতে হচ্ছে। ফলে জনসাধারণের ভোগান্তির শেষ নেই। পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।



তিনি বলেন, শোভনা ৯ নং ওয়ার্ডের বাদুরগাছা ও বাগাআঁচড়া গ্রামের ১৫টি ডিপ টিউবওয়েলের একটিতেও পানি উঠছে না। জনদুর্ভোগ এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেক দূর থেকে নারীদের খাওয়ার পানি আনতে হচ্ছে। এটা খুবই কষ্টসাধ্য। ধানক্ষেতে পানি দেওয়ার শ্যালোমেশিনগুলোতেও পানি উঠছে না। শিগগিরই বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। সংকট উত্তরণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

বাদুরগাছা গ্রামের গৃহবধূ স্বপ্না মন্ডল বলেন, ‘উত্তর পাড়ায় ডিপ-টিউবওয়েলে (নলকূপ) পানি উঠছে না। তাই দুই গ্রাম ডিঙ্গিয়ে দক্ষিণপাড়ায় পানি নিতে এসেছি। কিন্তু এখানেও টিউবওয়েলে ভালো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এক কলস পানি ভর্তি করতে সময় লেগে যাচ্ছে আধা ঘণ্টা। চাপতে চাপতে ক্লান্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে। এত কষ্ট আর সহ্য হয় না।’

পার্শ্ববর্তী বাগাছড়া গ্রামের গৃহবধূ আরতি মন্ডল বলেন, ‘খাবারের অভাব নেই, কিন্তু খাবার পানি নেই। অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। এলাকা যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। দুইবার বিশ্রাম নিয়েও এক কলসি পানি ভরা যাচ্ছে না।’

স্থানীয় পল্লীশ্রী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের টিউবওয়েলে গ্লাস আর প্লাটিকের বোতল নিয়ে পানি নিতে দেখা যায় ওই বিদ্যালয়ের ৫-৬ জন শিক্ষার্থীকে। তারা জানান, ‘কল চাপতে চাপতে হাঁফিয়ে উঠছি। কিন্তু পাত্রে পানি ভর্তি করা যাচ্ছে না।’



স্থানীয় বাসিন্দা স্বর্ণা রায় বলেন, ‘পানির কষ্টে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আগে দুই থেকে তিন মিনিটে একটি কলস ভর্তি করা যেত। কিন্তু এখন আধা ঘণ্টায়ও কলস ভরা সম্ভব হচ্ছে না।’

ঢাকায় অবস্থানরত স্থানীয় বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী আলী বাদশা বলেন, সম্প্রতি তিনি সপরিবারে গ্রামে বেড়াতে যান। কিন্তু সুপেয় পানি সংকটের কারণে তার শিশুকন্যা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে একদিন থেকেই ফিরে যান তিনি। তিনি বলেন, ‘সত্যিই এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে শোভনায়। জিয়ালতলা ও শোভনার বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে মিষ্টি পানি উত্তোলন করায় ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এসব গভীর নলকূপ বন্ধের পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে খাবার পানি পাওয়া দুষ্কর হবে। তিনি মাছ চাষে অতিমাত্রায় মিষ্টি পানির ব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানান।

স্থানীয় শোভনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত বৈদ্য বলেন, ৪০ হাজার জনসংখ্যার জন্য তার ইউনিয়নে ৫ শতাধিক নলকূপ রয়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড খরা ও কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য অতিমাত্রায় সেচপাম্প স্থাপনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপ এখন পানিবিহীন হয়ে পড়েছে। ফলে সুপেয় পানির অভাবে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নদী ও খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছেন। শোভনা ইউনিয়নেও এ কার্যক্রম চলছে। এখন থেকে কৃষিকাজে খাল ও নদীর পানি ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে। ফলে আগামীতে সমস্যার উত্তরণ ঘটবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক হাসান বলেন, শোভনা ইউনিয়নে পানি সংকটের খবর তিনি জানেন না। তবে পানির এ সমস্যা সাময়িক। বৃষ্টি হলেই সমাধান মিলবে। এছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।



রাইজিংবিডি/খুলনা/২৬ মার্চ ২০১৮/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়