ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঝরনা থেকে মাত্র একজনকেই উদ্ধার করা সম্ভব হলো

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ৮ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঝরনা থেকে মাত্র একজনকেই উদ্ধার করা সম্ভব হলো

(ভিয়েতনামের পথে : ২৫তম পর্ব)
ফেরদৌস জামান :
আমরা এখন ছুটে চলছি মোরা পাং ঝরনার দিকে। ওদিকে মনের মধ্যে ভর করে বসে আছে চাইনিজ বসতি। নতুন করে আর কোনো ঝরনা দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরব কি না সে নিয়ে ভাবনায় আছি। তাহলে কি মোরা পাংক টপকে চলে যাব সোজা চাইনিজ বসতির দিকে! আবার এটাও বুঝতে পারছি যে, খাতা-কলমের উপর জোর খাটানোটা অনুচিৎ কাজ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তো এ যাবৎ কত কিছুই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, সেখান থেকে মোরা পাংকে বাদ দেয়া সমীচীন হবে না।

অভিজ্ঞতা এমন একটি বস্তু, যদি একই গন্তব্যে একাধিকবারও ভ্রমণ করা হয় প্রতিবারের অভিজ্ঞতার মধ্যে কোন না কোন প্রভেদ খুঁজে পাওয়া যায়। সুতরাং, মোরা পাংকে নিয়ে দু’চার কথার পর না হয় চাইনিজ বসতির দিকে পাড়ি দেয়া যাবে! গাড়ি গিয়ে নামিয়ে দিল তার শেষ গন্তব্যে। অর্থাৎ, রাস্তার শেষে। পাশ দিয়ে নেমে গেছে কিছু কাদা যুক্ত সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষ না হতেই দৃশ্যমান হল ঝরনার রূপ। ঝরনার মাথায় আরোহণ করতে অন্য সবার মত আমরাও সামিল হলাম। পঁচিশ-ত্রিশ ফুট উঁচু পাথরটার ঢালু শরীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত। তাতে ভর দিয়ে উপরে ওঠা। পর্যটকের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবুও যারা আছে তাদের উল্লাসের কমতি নেই। জঙ্গলের ভেতর থেকে নেমে আসা পানি জমা হয়েছে পাথরের গায়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এক চৌবাচ্চায়। এখান থেকে উছলে পড়ছে নিচের ঢালু পথে। গোসলরত কেউ কেউ পিচ্ছিল মেরে নেমে যাচ্ছে নিচে আপেক্ষাকৃত বড় চৌবাচ্চায়। সেখান থেকে আর নিচে যাওয়ার উপায় নেই। একবার পরে গেলে হাড্ডি-মাংস এক হওয়ার জোগাড়।



দেখা হলো মে ইয়েন ঝরনায় পরিচিত হওয়া সেই কানাডিয়ান বন্ধুদের সাথে। উপর থেকে নিচের চৌবাচ্চায় পিচ্ছিল দিয়ে নামছে আর উঠছে। আমাদেরকে পেয়ে তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। কিন্তু তাতে সাড়া দিয়ে আমাদের পক্ষে সামিল দেয়া সম্ভব নয়। কয়েকজন তরুণী পানিতে নেমে আর উঠতে পারছে না। পিচ্ছিল পাথর যতই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে ততই নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। ভয়ে একেকজনের মুখ শুকে খটখটে। বাধ্য হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলে মাত্র একজনকেই উদ্ধার করা সম্ভব হলো। বাকিদের উদ্ধার করতে গেলে নির্ঘাৎ নিজেসহ পিছলে পড়তে হবে। পরিস্থিতি দেখে পাশ থেকে দুইজন দর্শনার্থী এগিয়ে এলে তারপর রক্ষা। এরই মধ্যে আনন্দে বেসামাল এক তরুণী এক পায়ে ভর দিয়ে অন্য পায়ে ঝরনার পানির স্পর্শ নেয়ায় চেষ্টারত, যেন পরখ করে দেখছে পানি গরম না ঠান্ডা। অমনি কুপোকাত! সাঁই করে পিছলে গিয়ে পতিত হলো নিচের চৌবাচ্চায়। সেখান থেকে তাকে যখন উদ্ধার করা হলো ততোক্ষণে তার উন্মুক্ত পশ্চাদাংশ  পেকে লাল।

উল্লাস চলমান কিন্তু আমাদের দলের কাউকে তো দেখি না। একটু পর অস্ট্রেলিয়ান সদস্য আবিষ্কৃত হলেন অন্য এক পাথরের পাদদেশে। তার নির্লিপ্ত বসে থাকা দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে, চুলের ভেতর আঙুল দিয়ে ছোট ছোট বেনি বাঁধছেন নয়তো গভীর মনোযোগে উকুন তোলায় ব্যাস্ত। এসব ঝরনা-টরনায় তেমন আগ্রহ নেই। অতি কষ্টে শুধু এতটুকুই বললেন, যাওয়ার সময় সম্ভব হলে তাকে যেন ডেকে নিতে না ভুলি। বাড়তি আরও কিছু পাবার আশায় আমরা নিচে নেমে এগিয়ে চললাম স্রোতের সাথে তার অনুকূলে। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সামন্য পথের পরেই ঝরনার আর একটি ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ আবিষ্কারের কৃতিত্বে মনের মধ্যে সামান্য একটু গর্বও হলো। পরোক্ষণেই তা মলিন হলো যখন দেখি এরও নিচে দুইজন পর্যটকের নেমে যাওয়া সারা। ফেরার সময় হয়েছে। সকলেই জড়ো হয়েছি এক জায়গায়। অথচ, ইসরাইলি পিতা-পুত্রের ঝরনা দর্শন এখনও চলমান। উদাম শরীরে পিতা মনের সুখে গোসল করছেন। ছোট্ট এক হাফপ্যান্টের উপরে তিন দিকে ছড়ানো সুবিশাল পেট, অবশেষে ঘারের শীর্ষে কেশহীন একটি চকচকে খাসা মাথা। পুত্রটি কর্মা বেশ, মনের মাধুরি দিয়ে পিতার ছবি তোলায় ব্যাস্ত। কৌশলে এমন মূল্যবান দৃশ্য ধারণ করতে চারদিকের ক্যামেরাগুলো যেন মুহূর্তেই সজাগ হয়ে উঠল।



সূর্য মাথার উপর থেকে সরে গিয়ে অনেকটাই পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। গাড়ির চালক বলেছে চাইনিজ বসতির ওদিকটায় নামিয়ে দেবেন কিন্তু এতটা কাছাকাছি তা ভাবতে পারিনি। একদম বসতির প্রবেশদ্বারের নিচে। আমাদের সুবিধার্থে তাকে অবশ্য অনেকটা পথই ঘুরে আসতে হয়েছে। কি বলে যে তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ তা নিয়ে আমরা দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। অমনি গাড়ি ছেড়ে দেয়ার গিয়ার চেপে দিয়েছেন। অন্যদের কাছ থেকে কোনমতে বিদায় নিতে পারলাম কিন্তু একটা ছবি তোলার ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল! সারাটা দিন একসাথে ঘুরলাম অথচ, স্মৃতিস্বরূপ একটা ছবি রাখতে পারলাম না! এই মানুষগুলোর সাথে কি আর কোনো দিন দেখা হবে? হবে না ! স্মৃতি যা থাকার তা শুধু মনের মধ্যেই রয়ে গেল।

সুদৃশ্য তোরণ পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে রাস্তা এগিয়ে গেছে নীরব এক এলাকার মধ্যে দিয়ে, যেন কত কালের নীরবতা জমাট বেঁধে নেমে এসেছে এইখানটায়। মানুষজন নেই। শুধু কিছু স্থাপনা। হাতের বাম পাশ থেকে হঠাৎ কোন আহ্বানের আকর্ষণ অনুভূত হলো। অথচ, কেউ শব্দ করে ডাকেনি। তাকিয়ে লক্ষ করি দোকানে দাঁড়ানো লোকটির মুখে আমাদেরই উদ্দেশ্যে মিষ্টি হাসি। সেই হাসি শুধুই হাসি নয়, আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। সমস্ত মুখোচ্ছবিজুড়ে হাসি। হাসির অকৃত্রিম ভাঁজগুলো কপাল থেকে দুই চোখের কোটর হয়ে নেমে এসেছে ঠোঁটের কোণ পর্যন্ত। কারও উদ্দেশ্যে এমন একটি হাসি ছুরে দিলে তাকে আকর্ষণের জন্য কোন রূপ শব্দ নিষ্প্রয়োজন। লোকটির সম্মুখে একটি টেবিল পাতা। তাতে ছোট ছোট পেয়ালা ও কেতলি সাজানো। চিন দেশে উৎপাদিত নানান স্বাদ ও মানের চায়ের প্রদর্শণী ও বিক্রয় কেন্দ্র। একটু খানি পান করে দেখার প্রস্তাব করায় আমরা তা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করলাম। চা প্রস্তুত প্রণালীর মত অতি সামান্য ব্যাপারও যে এতটা চমৎকার হতে পারে তা স্বচোক্ষে না দেখলে অজ্ঞই থেকে যেতাম। কৌটা থেকে সামান্য পরিমান চা নিয়ে কেতলিতে পুরে দিলেন। চা বলতে যা বুঝানো হয় ঠিক সেরকম নয়। শেকড়ের ন্যায় সরু ও লম্বা করে কাটা। এরপর ফ্লাস্ক থেকে গরম পানি ঢালতেই বাষ্পের সাথে বেরিয়ে এল সুবাস! নলের মত লম্বা পাত্রে ঢেলে তার মুখে চেপে দিলেন হাতল বিহীন আর একটি ছোট্ট পেয়ালা। এবার উপুর করে হাতের তালুতে ধরে আস্তে করে পার করে দিলেন আমার হাতে। পেয়ালার মধ্যে লম্বা পাত্রটি উপুর করানোই আছে। ওর মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে পেয়ালায় জমা হচ্ছে সুবাসে ভরা কোমল পানি- চা। ডান হাতে তাকে বিশেষ কায়দায় উপুর করে ধরে রেখে নিচের পেয়ালায় চুমুক দিতে হয়। চুমুকেই এক দারুণ স্বতেজতা! সম্পূর্ণ নতুন এই অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে শুরু হল আমাদের চাইনিজ বসতি ভ্রমণ।



ক্রেতা-দর্শনার্থীদেরকে তারা এভাবেই পরম যত্নে চা পান করিয়ে স্বাগতম জানায়। চাইলে অন্যান্য স্বাদেরটা পান করতেও বাঁধা নেই। সেটা বরং তাদের জন্য খুশির ব্যাপার। অন্য একটি স্বাদের চা পান করার আগেই তিনি বুঝে নিয়েছেন কেনার চেয়ে বরং এই সমস্ত ছোট ছোট অভিজ্ঞতা আর্জনেই আমাদের আনন্দ। তারপরও লোকটির মুখে হাসিখানা পূর্বের ন্যায় অটুট। চীন দেশ থেকে আসা এই জনগোষ্ঠী এখানে কত দিন বসবাস করছে তার সঠিক হিসাব না জানাতে পারলেও এক বিক্রেতা জানালেন তাদের পিতামহ বা তারও পূর্ব পুরুষ থেকে বসবাস করে আসছে। পাহাড়ের উপর এই সমতল জায়গায় বেশ বড় অংশে তাদের বসতি। বসতিকে পেছনে রেখে গড়ে তোলা হয়েছে চাইনিজ খাদ্য-পণ্য বিশেষ করে চা ও শুকনো ফলের স্থায়ী বাজার এবং বিনোদোন কেন্দ্র। পা বাড়ালাম সামনের দিকে। খোলা জানালা সর্বস্ব লাল মাটি লেপে দেয়া মাটির দেয়াল। উপরে কালচে শন বা কাশের পুরু ছাউনি বা চালা। ভেতর টেবিল-চেয়ার পাতা। দর্শনার্থীরা চাইলে চাইনিজ ঐতিহ্যের রসনাবিলাসটা এখানে মিটিয়ে নিতে পারে। আমরা আপাতত সেদিকে মনোনিবেশ করলাম না। চলে এলাম বাজার ও বিনোদোন কেন্দ্রের মূল ফটকে।



এখানে ফুল গাছ ঘেরা পাথরের বেদীতে স্থাপিত একটি মূর্তি। তাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি বিক্রয় ও প্রদর্শণী কেন্দ্র। ফটক পেরিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল সুবিশাল সবুজ চত্তর ঘিরে বেশ কিছু বিক্রয় ও প্রদর্শণী কেন্দ্র। প্রতিটির আদল ও গঠন এক রকম- মাটির দেয়ালে লাল মাটি লেপে দেয়া। বিনোদোন উপকরণের সংখ্যা হাতে গোনা: তীর-ধনুক চর্চা কেন্দ্র, নাগোরদোলা আর কি কি যেন, এর অধিক নয়। এমন চমৎকার একটি জায়গায় বিনোদোনের উপকরণ তেমন প্রয়োজনীয় নয়। বিক্রয় বা প্রদর্শণী কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখার চেয়ে উন্নত ও স্বার্থক বিনোদোন অন্য কিই বা হতে পারে? এত বড় বাজার অথচ, দর্শনার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা। আমরা ছাড়া মাত্র তিন কি চারটি দল চোখে পড়ল। চা পান করলাম আরও এক কি দুইটি দোকানে। দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিটি দোকানেই সাজিয়ে রাখা আছে বিভিন্ন প্রকার শুকনো ফল। চাইলেই দু’একটি করে খেয়ে দেখা যায়। প্রক্রিয়াজাতকৃত এই সমস্ত ফলের স্বাদ অসাধারণ! ঘুরতে ঘুরতে উঠে এলাম একমাত্র দালানটার ছাদে। চতুর্দিকে ছরানো পাহাড়গুলো ধরা দিল দৃষ্টির খুব কাছাকাছি। মূল বসতির মাথার উপর দিয়ে পশ্চিম আকাশে যুক্ত হয়েছে সিদুর রঙের আভা। পাহাড়ের সবুজ গাছে চড়েছে গোধূলীর মিষ্টি আলো। প্রকৃতি নিজ থেকেই জানান দিল এখন আমাদের যাওয়া উচিৎ। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়