গাবতলীর হাট ও মিরকাদিমের গরু
মোহাম্মদ আসাদ || রাইজিংবিডি.কম
কোরবানি ঈদের অনুষঙ্গ পশু কোরবানি। এ কারণে ঈদের আগে সাধ্য অনুযায়ী ধর্মপ্রাণ মানুষ গরু, ছাগল ইত্যাদি কেনেন। অনেকে মহিষ কোরবানি দেন। আজকাল আরবের দুম্বা, উট এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি গরু কোরবানি হয় ঢাকায়। যে কারণে নগরীতে শতাধিক অস্থায়ী গরুর হাট বসে। হাট থেকে পছন্দমতো পশু কিনে কোরবানি দিয়ে ধর্মীয় বিধান সম্পূর্ণ করা হয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একটু বেশি লাভের আশায় বেপারিরা কোরবানির জন্য গরু নিয়ে হাজির হন ঢাকায়। কেউ আসেন নদী পথে, কেউ সড়ক পথে ট্রাকে। রাজধানীতে অস্থায়ী অনেক পশুর হাট বসলেও, ঐতিহ্যবাহী হাট হচ্ছে গাবতলী গরুর হাট। নিয়মিত গরুর হাট হলেও কোরবানির ঈদের আগে দেশের সবচেয়ে জমজমাট গরুর হাট হয়ে ওঠে এটি।
কৃষিনির্ভর বাংলার চাষাবাদের অন্যতম উপকরণ গরু। তাই বছরের শুরুতে গরু সংগ্রহ একটি বড় কাজ হয়ে দাঁড়াত। আদিতে বৃহত্তর ঢাকার মানুষ গরু সংগ্রহ করত নরসিংদীর পুইট্টা হাট থেকে। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকার গাবতলীতে গরুর হাট বসতে শুরু করে। গাবতলী তখন ছিল ঢাকার অদূরে বিচ্ছিন্ন গ্রাম। ঢাকাবিদ আপেল মাহমুদের লেখা থেকে জানা যায় গাবতলীর পশুর হাট বসানোর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মিরপুরের জমিদার মুন্সীলাল মিয়ার। মুন্সীলাল মিয়া ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গাবতলী পশুর হাট। তখন সপ্তাহে এক দিন শনিবার হাট বসত। তখনকার হাট অবশ্য বর্তমান জায়গায় ছিল না। তখন হাট বসত মিরপুর মাজার রোডের দুই পাশে। শুধু ঢাকা নয়, হাট শুরুর সময় থেকেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন কোরবানির পশু কিনতে গাবতলীতে চলে আসতেন। সাভার, কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, দোহার, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং নরসিংদী এলাকার মানুষ ৫০-৬০ কিলোমিটার পথ হেঁটে গাবতলী থেকে পশু কিনে বাড়ি ফিরতেন। মূলত কম দামে পছন্দসই পশু গাবতলীতে পাওয়া যেত বলেই দূর থেকে ক্রেতা আসত। অতীতে পশুর হাটটি ওয়াক্ফ এস্টেটের অধীনে চললেও পরবর্তী সময়ে সেটি সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
লর্ড কারমাইকেল রোডের বাসিন্দা আব্দুল হক মিয়া জানান, মুন্সিলাল মিয়া এস্টেটের আয়ের বড় একটা উৎস ছিল গাবতলীর গবাদি পশুর হাট। ১৯৭৩ সালে হাটটি সরকার জাতীয়করণ করে। মূলত তখন থেকেই সপ্তাহের পরিবর্তে প্রতিদিন এখানে হাট বসতে শুরু করে। বদলে যায় হাসিল আদায়ের প্রথা। হাটের শুরুর দিকে গরু প্রতি চার আনা হাসিল আদায় করা হতো। ওয়াক্ফ এস্টেটের আওতায় থাকার শেষ দিকে যা এক টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ১৯৮৬ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) উদ্যোগে তুরাগ নদের তীরবর্তী বর্তমান জায়গায় গবাদি পশুর হাটটির কার্যক্রম শুরু হয়।
গাবতলী গরুর হাটে শুরু থেকেই কোরবানির ঈদের সময় বসত জমজমাট পশুর হাট। ঢাকার আদি বাসিন্দারা ১৫-২০ মাইল হেঁটে গিয়ে গরু কিনে বাড়ি ফিরতেন। এখন পর্যন্ত এই হাট দেশের বৃহৎ পশুর হাট হিসেবে পরিচিত। গাবতলী এখন রাজধানী ঢাকার অংশ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ঢাকা বা ঢাকার বাইরের যে কেউ এই হাট থেকে পশু কিনে দ্রুত বাড়ি পৌঁছতে পারেন।
ঢাকার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী গরুর হাটের নাম ‘গনি মিয়ার হাট’। ঢাকার পুরনো হাটের মধ্যে এটি অন্যতম। ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থের লেখক নাজির হোসেনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার নবাব আবদুল গনি এখানে একটি হাট বসিয়েছিলেন। এ কারণে হাটটি ‘গনি মিয়ার হাট’ নামে পরিচিত হয়েছে। হাটটি প্রতিষ্ঠার পর জনসাধারণকে ঢোল বাজিয়ে জানানো হয়। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে বলত: ‘ধার করো, কর্জ করো গনি মিয়ার হাট করো।’ এখন গনি মিয়ার হাট আর নেই। সেখানে প্রতিদিন সকাল বিকাল বাজার বসে।
এ তো গেল হাটে সদাইপাতি বেচাকেনার কথা। তবে গনি মিয়ার হাটে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বসে ভিন্নধর্মী ঐতিহ্যবাহী গরুর হাট। কথিত আছে ঢাকার গরুর হাটের সর্বশ্রেষ্ঠ গরু ওঠে গনি মিয়ার হাটে। মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিমের গরুর জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকার এই হাট। সাধারণত ঈদের দু’একদিন আগে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই হাটে গরু ওঠানো হয়। কারণ ঢাকার আদি বাসিন্দারা কোরবানির জন্য বেশি পছন্দ করেন গাই গরু। আর গনি মিয়ার হাটের ৯০ শতাংশ ক্রেতাই ঢাকাইয়্যা। মিরকাদিমের ধবধবে সাদা গাভী এই হাটের প্রধান আকর্ষণ। ঈদের দুদিন আগে জমে ওঠা এই হাটে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যার মধ্যেই সবগুলো গরু বিক্রি হয়ে যায়।
এছাড়াও গত শতাব্দির আশির দশকে নয়া বাজার গরুর হাট গুরুত্ব পায়। কোরবানির ঈদের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই এই অঞ্চলের রাস্তায় এই হাট বসে। কমলাপুর, মেরাদিয়ার হাটেও জমজমাট কোরবানির পশুর হাট বসে। এক অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাট বসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। তবে সেগুলোর কোনোটাই গাবতলী বা গনি মিয়ার হাটের মতো ঐতিহ্য বহন করে না।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৮/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন