ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ব্ল্যাক হোলের ভেতর কী আছে?

স্বপ্নীল মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১২, ১৫ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ব্ল্যাক হোলের ভেতর কী আছে?

স্বপ্নীল মাহফুজ : এতদিন আপনি অনলাইনে বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের যেসব ছবি দেখেছেন তা ছিল ইলাস্ট্রেশন বা কল্পনাপ্রসূত আঁকা চিত্র। হ্যাঁ, সেগুলো ছিল বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন হিসাবের আলোকে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে যা ভেবেছে তার কৃত্রিম উপস্থাপন।

ব্ল্যাক হোল হলো সেসব বৈজ্ঞানিক রহস্যের একটি যার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি অবগত নন। একারণে সম্প্রতি এম৮৭ নামক গ্যালাক্সিতে অবস্থিত একটি ব্ল্যাক হোলের প্রকৃত ছবি তৈরি করার ঘটনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তৈরিকৃত এ ছবিটি হলো ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের প্রথম প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণীয় প্রমাণ।

কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের সহযোগী অধ্যাপক ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন মনরিল বলেন, ‘এ বিস্ময়কর বস্তুর প্রকৃত ছবি তৈরি করতে পারাটা বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা, যা পূর্বে আমরা নকশা, মডেল ও সমীকরণের মাধ্যমে দেখতাম।’

ব্ল্যাক হোলের ছবি তো পাওয়া গেল, কিন্তু এর ভেতরে কি আছে?

* ব্ল্যাক হোল কি?
প্রত্যেকেই হয়তো ব্ল্যাক হোল শব্দটি শুনেছে, কিন্তু আমাদের অধিকাংশই (যারা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নয়) জানে না যে ব্ল্যাক হোল আসলেই কি। মনরিল বলেন, ‘ব্ল্যাক হোল হলো এমন একটি বস্তু যা এতই বৃহৎ যে এটির অত্যধিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সবকিছুকে ভেতরের দিকে টানে, এমনকি আলোকেও।’ এখনো দ্বিধায় আছেন? একটি ট্রাম্পোলাইনের ওপর একটি বোলিং বলের কথা চিন্তা করুন: এটি মধ্যখানে একটি বড় ডিপ্রেশন সৃষ্টি করবে, তাই আপনি এটির ওপর কিছু মার্বেল ছুঁড়ে মারলে নিচের দিকে পতিত হবে। একইভাবে ব্ল্যাকহোল তার চারদিকে স্থান ও সময়কে (একত্রে স্পেসটাইম বা স্থানকাল বলে) বাঁকিয়ে রাখে। মনরিল বলেন, ‘এমনকি ব্ল্যাক হোল থেকে আলোর গতিও নিস্তার পায় না। স্থান এত বেশি বেঁকে থাকে যে একমাত্র দিক হলো নিম্নতা। একারণে ব্ল্যাক হোল কালো বা অদৃশ্য। আমরা ব্ল্যাক হোল দেখি না, কারণ ব্ল্যাক হোল থেকে কোনো আলো বের হতে পারে না।’

* ব্ল্যাক হোল কিভাবে সৃষ্টি হয়?
অনুসন্ধিৎসু মন জানতে চায় যে ব্ল্যাক হোল ঠিক কি দিয়ে তৈরি। মনরিল বলেন, ‘যখন কোনো সাধারণ বস্তু সংকুচিত হয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ছোট হয়ে যায়, তখন থেকে ব্ল্যাক হোলের সূচনা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন বড় বড় নক্ষত্রের জ্বালানি শেষ হয়ে যায়, তখন তারা মহাকর্ষের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করে ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি করে। মনরিল বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা গ্যালাক্সি এম৮৭ এর যে ব্ল্যাক হোলের ছবি দেখেছি তা সম্ভবত ধ্বংসপ্রাপ্ত হাইড্রোজেন গ্যাসের বড় বড় মেঘপুঞ্জ থেকে সৃষ্টি হয়েছে।’

* ব্ল্যাক হোলের ভেতর কি আছে?
যদিও ব্ল্যাক হোলকে দেখা যায় না, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এটা সম্পর্কে জানতে পারার কারণ হলো- এটির চারপাশে অন্যান্য বস্তুর ক্রিয়াশীলতা। নিরাপদ বলয়ে থাকা এসব বস্তুকে ব্ল্যাক হোল ভেতরের দিকে টানতে পারে না, কিন্তুর এটির বল দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়। অন্যদিকে যেসব বস্তু ব্ল্যাক হোলের যে সীমারেখার মধ্যে গেলে আর ফিরে আসতে পারে না তাকে ইভেন্ট হরাইজোন বা ঘটনা দিগন্ত বলে। ব্ল্যাক হোল যেন এক অতলস্পর্শী গহ্বর, যা কোনোকিছু গ্রাস করলে আর ফিরে আসতে পারে না।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো উদঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছেন যে, কোনো বস্তু ব্ল্যাক হোলের ভেতর যাওয়ার পর কি ঘটে। মনরিল বলেন, ‘যদি একবার হাইড্রোজেন (ধ্বংসপ্রাপ্ত নক্ষত্র থেকে) ভেতরে যায়, তাহলে মহাকর্ষ তত্ত্ব আমাদেরকে বলছে যে এটি কেন্দ্রে সংকুচিত হয়ে সিঙ্গুলারিটি বা এককত্ব অর্জন করে এবং কেউ জানে না যে এটি সেখানে দেখতে কেমন। যদিও এটা নিশ্চিত যে, সেটি তখন আর হাইড্রোজেন থাকে না।’ তাই ব্ল্যাক হোলের ভেতরটা আপনি মুভিতে যেরকম দেখেন বাস্তবে তেমন নাও হতে পারে। মনরিল আরো বলেন, ‘ইভেন্ট হরাইজোন ও সিঙ্গুলারিটির মধ্যে শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছুই নেই এবং সেখানকার মহাকর্ষ বল এতটাই শক্তিশালী যে ব্ল্যাক হোলে পতিত কোনোকিছুই আর ফিরে আসতে পারে না।’ ব্ল্যাক হোলের ভেতরে চলে যাওয়া বস্তুর ভাগ্যে কি ঘটে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের তত্ত্ব হলো- যেহেতু ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়, তাই এটির ভেতর থেকে কিছু না কিছু বের হয়ে আসতে পারে। কিন্তু প্রচলিত মহাকর্ষ তত্ত্বের সঙ্গে তার এ ধারণা সাংঘর্ষিক। হকিং এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে আমৃত্যু গবেষণা করে গেছেন। এ বিষয়ে তার চূড়ান্ত গবেষণাপত্রটি তার সহকর্মীদের দ্বারা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়।

* নতুন ছবিটি ব্ল্যাক হোলের ভেতর কি আছে তা সম্পর্কে যা বলতে পারে
এম৮৭ গ্যালাক্সিতে অবস্থিত ব্ল্যাক হোলের নতুন ছবিটি প্রকৃতপক্ষে কোনো ফটোগ্রাফ নয়, এটি হলো বিশ্বের ৮টি টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের সংকলন, যাকে সমষ্টিগতভাবে ইভেন্ট হরাইজোন টেলিস্কোপ বলে। এটি হলো প্রথম প্রমাণ যা ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে পূর্বের তত্ত্বকে সমর্থন অথবা প্রত্যাখ্যান করবে। মনরিল বলেন, ‘যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করেন তারা ব্ল্যাক হোলের ঘনত্ব ও ঘূর্ণন হার সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব। এ সম্পর্কে জানতে তারা এতদিন অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ব্ল্যাক হোলের নতুন ছবিটি তাদের এ সংক্রান্ত গবেষণাকে আরো স্পষ্ট করে তুলবে।’ যেসব পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে আরো ভালোভাবে যাচাই করতে চান অথবা যারা তার এ তত্ত্বকে খন্ডাতে চান, তারা এ ছবিটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত পৌঁছতে পারেন। ছবিটির উজ্জ্বল আংটিগুলো হলো অ্যাক্রিশন ডিস্ক বা পরিবৃদ্ধি চাকতি (ইভেন্ট হরাইজোনের ঠিক আগে গ্যাসের কক্ষপথীয় ঘনত্ব)। মধ্যখানের কালো স্থানটি হলো ব্ল্যাক হোলের ছায়া (এটা মনে রাখতে হবে যে সেখানে কোনো আলো নেই, তাই আমরা ব্ল্যাক হোলের ভেতরটা দেখতে পাই না)। এ ছবিটির প্রত্যেকটি দিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা হয়তো মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলোর তালিকা থেকে ব্ল্যাক হোল ওরফে কৃষ্ণগহ্বরকে বাতিল করতে সক্ষম হবেন।

পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়