ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

নববর্ষ দেশে-বিদেশে || হাবিবুর রহমান স্বপন

হাবিবুর রহমান স্বপন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নববর্ষ দেশে-বিদেশে || হাবিবুর রহমান স্বপন

থাইল্যান্ডে নববর্ষে মহাথিঙ্গন উৎসবে তরুণ-তরুণীদের জলকেলি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালিত হয়। আসামে নববর্ষকে বলা হয় ‘রঙ্গোলী বিহু’,  কেরালায় ‘বিষু’, তামিলদের ভাষায় সেটি ‘পুতান্ডু’ উড়িষ্যায় নববর্ষ ‘মহাবিষুব সংক্রান্ত্রি’ নামে পরিচিত। এতে সময়েরও হেরফের আছে। তবে নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঘরানায় সবখানেই নববর্ষ পালিত হয় ঘটা করে। একই দেশের মধ্যে বিভিন্ন জাতি নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অনুসারে নববর্ষের দিন আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।

নববর্ষকে বরণ করতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কায়দায় উৎসব হয়। বাংলাদেশে বর্ষবরণ হয় প্রাতঃসংগীতের সুরে সুরে। মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়। পারস্যে বা ইরানে নববর্ষের দিন বা নওরোজ-এর দিন পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয় কনিষ্ঠরা। তারা বড়দের কাছ থেকে উপহার পায় এবং সবাই মিষ্টিমুখ করে। এই উৎসব ১২ দিন পর্যন্ত চলে। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণ নববর্ষকে বরণ করে নতুন পোষাক পরিধান করে এবং উৎকৃষ্ট খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করে। কেপটাউনে জাঁকজমকপূর্ণ কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হয়।

ইউরোপীয়রা হৈ-হুল্লোর চিৎকার চেঁচামেচি করে দিবসটি বরণ করে। উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে এবং উচ্চস্বরে গান-বাজনা করে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন তারা দল বেঁধে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে। তিব্বতীয়রা সকালে উপাসনালয়ে যায়, মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করে। পরিবারের সকল সদস্য একত্রিত হয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে এবং সকলে মিলে আহার করে। এ ছাড়াও তারা ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। শ্রীলঙ্কানরা দিবসের শুরুতে এক ধরনের বিশেষ হারবাল শরীরে মাখিয়ে স্নান করে পবিত্র হয়। এ দিন তারা ভালো খাবার খায়। আনন্দে নাচ-গানে মেতে ওঠে।

কোরিয়ার অধিবাসীরা নববর্ষের সকালে স্নান করে, নতুন পোশাক পরে বড়দের সালাম করে। বড়রা ছোটদের উপহার দেয়। ফুল ও মিষ্টান্ন বিনিময় হয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে। চীনারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। এ দিন ঘুড়ি উৎসবে মেতে ওঠে ছোটরা। এ ছাড়াও চলে পাড়া-মহল্লায় গান-বাজনা ও নাচ। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি সব দেশে ইংরেজি ক্যালেন্ডার মোতাবেক ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালিত হয়।

৩১ ডিসেম্বর রাত থেকেই বর্ষ বিদায়ের আয়োজন শুরু হয়। পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত নাচ-গান চলতে থাকে। রুশরা আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে পানীয়সহ গ্রহণ করে। সব কিছুই হয় একতাবদ্ধ হয়ে। এ দিন কেউ একা থাকে না। সবাই দল বেঁধে আনন্দে মেতে ওঠে। ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, চিলি, মেক্সিকোর জনগণ নববর্ষের দিন নিজ নিজ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নেচে-গেয়ে নববর্ষকে বরণ করে।‘জানুস’ (ল্যাটিন ভাষায় লানুস) গ্রীকদের দেবতা। এই দেবতার মাথা একটি। তবে এক মাথায় দুদিকে দুটি মুখ। একটি সামনের দিকে অপরটি পেছনের দিকে। দেহ অবিচ্ছিন্ন। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে নববর্ষ উৎসব হতো এই জানুসকে ঘিরে। এখনও জানুস-এর মূর্তি রয়েছে ভ্যাটিকান জাদুঘরে। তার নাম থেকে নেওয়া নববর্ষের শুরুর মাস জানুয়ারি স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে পৃথিবীতে।

ইয়েমেনে নববর্ষ পালিত হয় ৬ এপ্রিল। নেপালে ১৪ এপ্রিল। মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে ১৩ এপ্রিল। নববর্ষের সঙ্গে চলে ‘মহাথিঙ্গন’ উৎসব। চলে জলক্রীড়া। পানিতে একে অপরকে ভিজিয়ে উৎসব চলে। তবে এই পানি হতে হবে বিশুদ্ধ বা পানের উপযোগী। নোংরা পানি এই উৎসবে ব্যবহার করা অপরাধ। থাইল্যান্ডের নববর্ষের মহাথিঙ্গন উৎসবের দিনে আমি এবং আমার সঙ্গি দুই বন্ধু সকালে হোটেলে নাস্তা করতে যাওয়ার পথে পানিতে ভিজেছিলাম। কয়েকজন যুবক-যুবতী একটি খোলা জীপে উঠে পথচারীদের পানিতে ভিজিয়ে আনন্দ করছিল। আমরা জানতাম না যে ওই দিন ছিল তাদের নববর্ষ। আমাদের অদূরে দণ্ডায়মান কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকেও ওরা ভিজিয়ে দিল। একইভাবে পর্যটকদের ভিজিয়ে দিয়ে হৈ হুল্লোর করে চলে গেল। বিদেশি পর্যটকদেরও ওই জলকেলিতে মেতে উঠতে দেখলাম। সকলের হাতে বড় বড় পানির পিচকারি। দেখতে সিরিঞ্জের মতো। থাইরা এই দিন মোরগ যুদ্ধের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।

মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও চীনে নববর্ষ ফেব্রুয়ারিতে। তিব্বতিদের নববর্ষ উদযাপিত হয় ১৮ জানুয়ারি। পাকিস্তান ও মালদ্বীপে নববর্ষ পালিত হয় ১৭ এপ্রিল। তুরস্ক, কুয়েতসহ মুসলমান প্রধান বেশ কয়েকটি দেশে নববর্ষ পালিত হয় গ্রেগারিয়ান বা ইংরেজি ক্যলেন্ডার অনুসারে অর্থাৎ জানুয়ারিতে।

পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় বাংলা নববর্ষের সঙ্গে হিন্দুদের পুজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাস জুড়ে চলে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। প্রতিটি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায় অলিতে-গলিতে নানা সংগঠন প্রভাতফেরি করে। তবে বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপ্তী বিশাল। রমনা বটমূল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরাতন ঢাকাসহ সারাদেশের গ্রামে-শহরে আবালবৃদ্ধবণিতা এই দিন সকাল থেকে মেতে ওঠে নাচ-গান, কবিতা, নাটক ও হালখাতা উৎসবে। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, উরিষ্যা, বিহারের বাঙালি পরিবারগুলোও এই দিন উৎসবে মেতে ওঠে। তারা তাদের শিকড়ের সন্ধান খোঁজে এই দিনটিতে। শ্রীলঙ্কায় নববর্ষ উৎসবকে বলা হয় ‘পুতান্ডু’। ভারতের তামিলরাও ওই দিন নববর্ষ পালন করে। এ দিন মন্দিরে মন্দিরে পঞ্জিকা (পঞ্চঙ্গম) পাঠ করা হয়। তামিলদের পুতান্ডু উৎসবের সময় আমরা চেন্নাইতে বিশাল বর্ণাঢ্য র্যা লি দেখেছিলাম। সমূদ্র সৈকতে নববর্ষ উপলক্ষে হাজারো মানুষ ঘুড়ি উড়ায়। নীলগিরি পর্বত শীর্ষের একটি মন্দিরে গিয়ে দেখলাম পূজারি ঠাকুর পঞ্জিকা পাঠ করছেন। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছে। এরপর সিঁদুর এবং চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার পালা। একটু পর নারিকেলের সন্দেশ বিতরণ করা হলো। আমরা বহিরাগত পর্যটকরাও সন্দেশের স্বাদ গ্রহণ করলাম।

ফেব্রুয়ারিতে চীনের চান্দ্র-নববর্ষ। এই উৎসবকে বলা হয় ‘চুন জি’। ইংরেজিতে ‘স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল’। এ দিন বেইজিংয়ের হোইহাই হ্রদে মেলায় ভিড় জমান উৎসাহীরা। চীনের প্রাচীরের একটি অংশে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পর্যটকদের জন্য থাকে বিশেষ প্যাকেজ। প্রতি বছর চীনের নববর্ষে থাকে বিশেষ থিম। গত বছর ছিল সাপ। এ বছর ড্রাগন। লাল পোশাক, লাল সন্ধ্যাবাতিতে সেজে ওঠে চীন। আগে চীন এবং জাপানে একই দিন নববর্ষ উদযাপন হতো। এখন জাপানিরা ইংরেজি নববর্ষ বা গ্রেগরিয়ান ক্যলেন্ডার অনুসারে নববর্ষ পালন করে ১ জানুয়ারি।

পশ্চিমের দেশগুলো গির্জা ও জাহাজের ঘণ্টা বাজিয়ে নববর্ষকে স্বাগতম জানায়। গির্জায় গির্জায় ঝুলানো হয় প্রভু যিশুর জন্মবৃত্তান্ত। চলে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব। আবালবৃদ্ধবনিতার বিশাল একটি অংশ মেতে ওঠে আতশবাজি নিয়ে। চলে নাচ-গান। জার্মানিতে নববর্ষের প্রধান উৎসব হয় বার্লিন প্রাচীরের মূল ফটক ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হারবারে বর্ণিল আলোকসজ্জা ও নাচ-গান হয়। লন্ডনে বিগ বেন এবং ওয়েস্টমিনিস্টার প্রাসাদের বিগ বেনের সামনে ঘটা করে উৎসব করে জনতা। এই অনুষ্ঠান বিবিসিসহ বিভিন্ন মিডিয়া সরাসরি সম্প্রচার করে।

বাংলাদেশে পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো বছরের নতুন দিনে উৎসব পালন করে। মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমাদের বিজু এবং ত্রিপুরাদের বৈষ্ণব উৎসব। বর্তমানে তিনটি জাতিসত্তা একত্রে এই উৎসব পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম বৈসাবি।  বৈসাবি হয় আমাদের বাংলা নববর্ষের আগের দিন। মিয়ানমার এবং থাইদের সঙ্গে এই উৎসবের যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। ক্ষুদ্র এসব নৃগোষ্ঠীর উৎসবের মধ্যে ভিন্নতা বা নানান দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো মারমাদের জলকেলি উৎসব যার সঙ্গে মিল রয়েছে মিয়ানমার ও থাইদের মহাথিঙ্গন উৎসবের। 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়