ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

পালকি || শিহাব শাহরিয়ার

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ১১ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পালকি || শিহাব শাহরিয়ার

পালকি প্রায় হারিয়েই গেছে। এক সময় পালকি ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন। পালকি দিয়ে মানুষ বহন করা হতো। এখনো হয়, তবে খুবই কম। অন্যভাবে বলা যায়, হয়-ই না। পালকিতে একজন অথবা দুইজন যাত্রী থাকে। আর এটি বহন করে কখনো দুইজন, কখনো চারজন, কখনো বা আটজন। বহনকারীদের বলা হয় বেহারা বা কাহার।

আগে পালকিতে মূলত রাজা-বাদশা ও তাদের পরিবারের সদস্য এবং নব বর-বধূরা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেত। গবেষকদের মতে, পালকি শব্দটি সংস্কৃত ‘পল্যঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকে উদ্ভূত। পালি ভাষায় এই যানের নাম ‘পালাঙ্কো’। হিন্দি ও বাংলায় এটি পালকি নামে পরিচিত। অনেক জায়গায় এই যানকে ডুলি, শিবিকা প্রভৃতি বলা হয়। পর্তুগিজরা এর নাম দেয় পালাঙ্কুয়িন। রামায়ণে পালকির উল্লেখ রয়েছে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চতুর্দশ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। এ ছাড়া অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসালয়ে নেওয়ার জন্যও পালকি ব্যবহৃত হতো।

পালকি বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট ও সাধারণ পালকি বা ডুলি দুজনে বহন করে। সবচেয়ে বড় পালকি বহন করে চার থেকে আটজন পালকি বাহক বা বেহারা। বেহারারা মূলত হাড়ি, মাল, দুলে, বাগদি, বাউড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক হয়। এরা দিনমজুরের কাজ এবং মাছের ব্যবসাও করে। বেহারারা পালকি বহন করার সময় নির্দিষ্ট ছন্দে পা ফেলে চলে। এই রীতি তারা ওস্তাদের কাছ থেকে শেখে। পালকি বহনের সময় তারা বিশেষ ছন্দে গানও গায়। তাদের চলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের তাল-লয় পরিবর্তিত হয়। পালকি তৈরি করেন ছুতারেরা আর তৈরি হয় সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ প্রভৃতি কাঠ দিয়ে। বটগাছের বড় ঝুরি দিয়ে তৈরি হয় পালকির বাঁট বা বহন করার দণ্ড।

পালকি সচরাচর তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি আয়তাকার। চারদিক কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছাদ ঢালু। এর দুদিকে দুটি দরজা থাকে। কোনো কোনোটিতে জানালাও থাকে। পালকির বাইরের দিকে আলপনা আঁকা থাকে। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকে। ভিতরে চেয়ারের মতো দুটি আসন ও একটি টেবিল থাকে। ময়ূরপঙ্খি পালকির আয়তন সবচেয়ে বড়। এই পালকি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়, ভিতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল ও তাক থাকে। এ পালকির বাঁটটি বাঁকানো এবং এর বাইরের দিকে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল ও লতাপাতার নকশা থাকে।

বাংলায় সতেরো ও আঠারো শতকে ইউরোপীয় বণিকরা হাটে-বাজারে যাতায়াত এবং তাদের মালপত্র বহনের জন্য পালকি ব্যবহার করত। তারা পালকি ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে, কোম্পানির একজন স্বল্প বেতনের সাধারণ কর্মচারিও এদেশে যাতায়াতের জন্য একটি পালকি রাখত ও তার ব্যয়ভার বহন করত। কিন্তু পালকির ব্যয় বহন করতে গিয়ে কর্মচারিরা অবৈধ আয়ের নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করতে থাকে। ফলে কোর্ট অব ডিরেক্টরস ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ কর্মচারিদের পালকি ক্রয় ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

বস্তুত, সেই যুগের পালকি ছিল এ যুগের মোটরগাড়ির অনুরূপ। স্টিমার ও রেলগাড়ির আবির্ভাবের পূর্বে ভারতের গভর্নর জেনারেলও পালকিতে চড়ে যাতায়াত করতেন। উনিশ শতকের প্রথমদিকে ডাক ও যাত্রী বহনের জন্য ডাকবিভাগ ‘স্টেজ পালকি’ চালু করে। এই প্রথা উনিশ শতকের শেষ নাগাদ প্রচলিত ছিল। দূরের যাত্রীরা ডাকঘর থেকে স্টেজ পালকির টিকেট ক্রয় করত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংরেজরা পালকিতে চড়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। তবে উনিশ শতকের শেষাবধি স্থানীয় বাবু এবং অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ যাতায়াতের জন্য পালকিই ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ অবস্থানকালে তার জমিদারি কাচারি পরিদর্শনের সময় যে পালকি ব্যবহার করতেন, তা এখনও কুঠিবাড়িতে সংরক্ষিত রয়েছে। সেই যুগে সচ্ছল পরিবারের নিজস্ব পালকি থাকত এবং তাদের ভৃত্যরাই তা বহন করত। সাধারণ মানুষ পালকি ভাড়া করত।

উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে দাসপ্রথা বিলোপের পর উপমহাদেশের বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে পালকি বাহকরা বাংলায় আসতে থাকে। বহু সাঁওতাল পালকি বাহকের কাজ নেয়। শুষ্ক মৌসুমে তারা নিজেদের এলাকা থেকে এদেশে আসত এবং বর্ষা মৌসুমে আবার চলে যেত। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শেষে তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় যেত এবং কোথাও কোথাও অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়ে সাময়িক আবাসের ব্যবস্থা করে নিত।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। ক্রমশ সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি এবং পশুচালিত যান চালু হলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৩০-এর দশকে শহরাঞ্চলে রিকশার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার উঠে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যানের চলাচল এবং প্যাডেল চালিত রিকশা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

দক্ষিণ এশিয়া ও চীনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পালকির প্রচলন ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আধুনিক সভ্যতার কালে এবং তথ্য-প্রযুক্তির অনন্য অগ্রগতির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশেও পালকি দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে। বলা যায়, পালকি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে এখন পরিচিত।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ এপ্রিল ২০১৬/শিহাব/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়