ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যে সমস্ত যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ বাহুল্য নয়

আরিফ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে সমস্ত যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ বাহুল্য নয়

|| আরিফ রহমান ||

মুক্তিযুদ্ধে যে তিরিশ লক্ষাধিক মানুষ শহিদ হয়েছে এটা প্রমাণিত সত্য, এই সত্য নিয়ে আমরা চলি। কেউ ভুল বললেই যেমন নিউটনের সূত্র ভুল হয়ে যায় না, ঠিক তেমনি কেউ ‘বিতর্ক আছে’ বললেই তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ ম্লান হয়ে যায় না। ১৯৭১ সালে শহিদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশের সুযোগ নেই কারণ আমাদের হাতে আছে গনহত্যার ভুরি ভুরি প্রমাণ। এক WCFC তাদের গবেষণায় গোটা দেশে পেয়েছে ৯৪২টি বধ্যভূমির খোঁজ। তুরিন আফরোজ কিছুদিন আগে লিখেছেন সারা দেশে বধ্যভূমি আর গণকবরের সংখ্যা তিন হাজারের অধিক।

 

এই নিবন্ধের পরবর্তী অংশে আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় যে তিরিশ লক্ষাধিক মানুষ শহিদ হয়েছে সেটার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করবো।  শহিদের সংখ্যা নিয়ে অনেকের বিভ্রান্তি নিরসন হবে বলে আশা রাখি।

 

আমাদের দেশে একটা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু নাকি মিলিয়ন এবং লক্ষের পার্থক্য বুঝতে পারেননি, সেজন্য পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সাংবাদিকদের কাছে শহিদের সংখ্যা ‘থ্রি লাখ’ বলতে গিয়ে ‘থ্রি মিলিয়ন’ বলে ফেলেছিলেন। এটা যে সর্বত মিথ্যা একটি বক্তব্য সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। একাত্তর সালেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্নে অর্থাৎ মার্চে পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রথম বলেছিলেন : ‘ওদের ত্রিশ লক্ষ হত্যা কর, বাকীরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হবে।

Robert Payne, Massacre, The Tragedy of Bangladesh and the Phenomenon of Mass Slaughter Throughout History; P:50; New York, Macmillan, 1973

সত্যি বলতে, যদি এই সংখ্যাটা ভুল হয়ে থাকে তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রথমে এই ভুলটা বঙ্গবন্ধু নন, বরং করেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া। কিন্তু তিনিই শেষ নন; মাওলানা ভাসানী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লক্ষ হত্যাকাণ্ডের কথা তার বক্তব্যে বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর খালেদ মোশাররফ কানাডার গ্রানাডা টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইতিমধ্যে দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে’। কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছেন ‘বারবারা বিডলারকে’ তার কয়েকটা লাইন তুলে দেই :

 

‘তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো;
ওটা একটা জল্লাদের ছবি।
পনেরোলক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে…’

 

যুদ্ধের সময় শহিদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছিলো উপরের লেখাগুলো তাই প্রমাণ করে। এবার আসুন দেখি বিদেশি কিছু পত্রিকা যুদ্ধ চলাকালীন কী লিখেছে শহিদের সংখ্যা নিয়ে :

 

১) Times একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই লিখেছে নিহতের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে

২) News Week এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৭১ লিখেছে নিহত ৭ লক্ষ।

৩) The Baltimore sun ১৪ মে ১৯৭১ লিখেছে সংখ্যাটা ৫ লাখ।

৪) The Momento, Caracas জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লক্ষ।

৫) কাইরান ইন্টারন্যাশনাল ২৮ জুলাই লিখেছে ৫ লক্ষ।

৬) Wall Street Journal ২৩ জুলাই রিপোর্ট করেছে, সংখ্যাটা প্রায় ১০ লক্ষ।

৭) Times সেপ্টেম্বরের বলছে প্রায় ১০ লক্ষাধিক।

৮) দি হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস- লন্ডন ১লা অক্টোবর ১৯৭১ বলেছে শহীদের সংখ্যা ২০ লক্ষ।

 

বারবার বলছি এসব যুদ্ধ চলাকালীন কথা। যুদ্ধের সময় অর্ধপূর্ণ তথ্যসূত্র নিয়েই এসব নিউজ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের আগে পূর্ণ খবর পাওয়া অসম্ভব ছিলো। এবারে আসুন দেখা যাক ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর আর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের পত্রিকা (বঙ্গবন্ধু দেশে আসার আগ পর্যন্ত)। যেমন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আখতার মুকুল চরমপত্রের শেষ পর্বে তিরিশ লক্ষ শহিদের কথা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তখনো জানতেনও না দেশ যে স্বাধীন হয়েছে।

 

 

এর ছয় দিন পর দৈনিক পূর্বদেশে পত্রিকায় ২২.১২.১৯৭১ তারিখে ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে লেখা হয় : ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দু’শতাধিক বুদ্ধিজীবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।’ এটা বঙ্গবন্ধু দেশে আসার আঠারো দিন আগের কথা। এরপর রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা পত্রিকা ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ ৩০ লক্ষ শহীদের বিষয়টি তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করে। তাও বঙ্গবন্ধু দেশে আসার ৭ দিন আগে।

 

 

জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ তিরিশ লক্ষ শহিদের কথা প্রকাশ করে মর্নিং নিউজ, বঙ্গবন্ধু দেশে আসার ৬ দিন আগে। তারা লেখে- "Over 30 lakh persons were killed throughout Bangladesh by the Pakistani occupation forces during the last nine months"

 

 

ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করে এভাবে, "Pak Army Killed over 30 Lakh people" যেটা প্রকাশিত হয় ০৫.০১.১৯৭২ তারিখে বঙ্গবন্ধু দেশে আসার ৫ দিন আগে। দৈনিক বাংলা পত্রিকা তিরিশ লাখ শহিদের কথা লেখে ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামের নিবন্ধে জানুয়ারি মাসের ছয় তারিখ। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার ৪ দিন আগে। (পেপার কাটিংগুলোর কৃতজ্ঞতা : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মাহবুবুর রহমান জালাল ভাই এবং তার সংগঠন CBGR, ওমর শেহাব ভাই এবং তার সংগঠন ICSF)।

 

তথ্য প্রমাণে এটুকু তো পরিস্কার যে তিরিশ লক্ষ শহিদ কোন স্বপ্নে পাওয়া কিংবা কারো ভুল উচ্চারণের ফল নয় বরং বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যান। লেখার এই অংশে আমরা কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণা, থিসিস, এনসাইক্লোপিডিয়া, ডিকশনারির দিকে দৃষ্টিপাত করি। প্রথম মনে করিয়ে দেই ১৯৮১ সালে ইউ এন ইউনির্ভাসাল হিউম্যান রাইটসের ডিকলেয়ারেশানের কথা। যেখানে লেখা হয়েছে : ‘মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১ এর গণহত্যায় স্বল্পতম সময়ে সংখ্যার দিকে সর্ববৃহৎ। গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০ - ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এটি হচ্ছে গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনে সর্ব্বোচ্চ নিধনের হার।’

 

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই কাজ (দিনপ্রতি ৬০০০ - ১২০০০ বাঙালি নিধন) করেছে মোটামুটি ২৬০দিনে (একাত্তুরের ২৫-এ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত)। অর্থাৎ বাঙালি নিধনের লোওয়ার লিমিট: ৬০০০ x ২৬০ = ১৫,৬০,০০০ (১৫ লক্ষ ৬০ হাজার)। আর নিধনের আপার লিমিট: ১২০০০ x ২৬০ = ৩১,২০,০০০ (৩১ লক্ষ ২০ হাজার)। এই ইউনির্ভাসাল হিউম্যান রাইটসের ডিকলেয়ারেশান কিন্তু ১৯৮১ সালের অর্থাৎ স্বাধীনতার ১০ বছর বাদের। সুতরাং কোন বিভ্রান্তি কিংবা মিস স্পেলিং-এর সুযোগ নেই। এবারে নিচের পয়েন্টগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক :

 

১। Encyclopedia Americana তাদের 2003 সালের সংস্করণে বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ে একাত্তরে মৃত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে তিরিশ লক্ষ।

 

 

২। পুলিৎজার পুরস্কারবিজয়ী লেখিকা Samantha Power-এর লেখা গণহত্যা সম্পর্কিত সর্বাধিক বিক্রি হওয়া একটি বই "A Problem from Hell": America and the Age of Genocide" এই বইয়ের ভেতর ১৯৭১ সালে শহিদের সম্পর্কে সংখ্যাটি ৩০ লক্ষ বলা হয়েছে। এটা গণহত্যা নিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ।

 

 

৩। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে বাংলাদেশের গণহত্যা এই শতকের সর্বোচ্চ পাঁচটির একটি The Guinness Book of Records lists the Bangladesh Genocide as one of the top 5 genocides in the 20th century

 

৪। প্রখ্যাত গণহত্যা গবেষক লিও কুপার জেনোসাইড নামে একটি বই লিখেছেন। বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে কিছু সংখ্যা দিয়ে। লেখা হয়েছে- ১৯১৫ : ৮০০,০০০ আর্মেনিয়ান। ১৯৩৩-৪৫ : ৬০ লক্ষ ইহুদী। ১৯৭১ : ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী। ১৯৭২-৭৫ : ১০০,০০০ হুটু। নিচে লাল কালিতে বড় করে লেখা জেনোসাইড। এই অংকের মানুষ গণহত্যার শিকার।

 

 

৫। Dr. Ted Robert Gurr এবং Dr. Barbara Harff কে বলা হয়ে থাকে রাজনীতি বিজ্ঞানের দুই দিকপাল। তাদের গবেষণালব্ধ পুস্তক “Towards Empirical Theory of Genocides and Politicides” বইতে উল্লেখ করেছেন ১৯৭১ সালের সংঘাতে ১২,৫০,০০০ থেকে ৩০,০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে।

 

৬। ড. রুডলফ যোসেফ রামেল হাওয়ায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাকে বলা হয় বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত গণহত্যা বিশেষজ্ঞ। তার লেখা 'STATISTICS OF DEMOCIDE' বইটিকে দাবি করা হয়ে থাকে বিশ্বে গণহত্যা নিয়ে সংখ্যাগতভাবে অন্যতম কমপ্রিহেন্সিভ বই। বইটির অষ্টম অধ্যায়ে Statistics Of Pakistan’s Democide Estimates, Calculations, And Sources নিবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামে সর্বোচ্চ সম্ভাবনার ঘরে মৃত্যু হয় ৩০,০৩,০০০ মানুষের । বিশিষ্ট রাজনীতি বিজ্ঞানী Rudolph Joseph Rummel বা R.J. Rummel তাঁর 'China's Bloody Century' এবং ‘Lethal Politics: Soviet Genocide and Mass Murder Since 1917’ নামের দু’টি গবেষণাধর্মী বইয়ের পরিশিষ্টে গণহত্যার পরিসংখ্যান কীভাবে করতে হয় তার  একটা মেথডোলজি দিয়েছেন আগ্রহীরা পুরোটা পড়তে পারেন।

 

 

সবশেষে বলি, মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা তিরিশ লাখ হতে হলে তৎকালীন মোট জনগোষ্ঠীর ৪শতাংশ শহিদ হতে হয়। একাত্তরে পাঁচ জনের পরিবার চিন্তা করলে সংখ্যাটা ০.১৬। অনেককেই বলতে শোনা যায় ‘কই আমার পরিবারে তো কেউ শহিদ হয়নি’ যারা এমন প্রশ্ন তোলেন তারা ভুলে যাচ্ছেন এখন সালটা ১৯৭১ না ২০১৫ একাত্তরের দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্ম আপনি। একাত্তরে বিশটা পরিবারের ভেতর একজন শহিদের খোঁজ করা মানে এখনকার ১০০/১৫০/২০০ পরিবারে একজন খুঁজে পাওয়ার সমান।

 

আপনারা কি জানেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বধ্যভূমির কেবল একটা গর্ত থেকে ১ হাজার ১০০ টা মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিলো। সেই বধ্যভূমিতে এরকম প্রায় একশটি গর্ত ছিলো। আর WCFC-র হিসাব অনুসারে সারাদেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে  ৯৪২টি।  অনেকে বলেন মুক্তিযুদ্ধে শহিদের নামের তালিকার লিস্ট করা হয় নাই কেন?

 

তাদের জন্য বলে নেই,  দুনিয়ায় যত যুদ্ধ হয়েছে সে যুদ্ধগুলোর কোনটাতেই বেসামরিক মৃত্যুর কোন নাম ধরে তালিকা নাই। এমন তালিকা করা হয় না কারণ এটা করা সম্ভব না। যুদ্ধ একটা অস্বাভাবিক অবস্থা, এটা রোড ট্র্যাফিক অ্যাকসিডেন্ট নয়, এটা সার্কাস নয়, এটা কনসার্ট নয়, এটা ফুটবল স্টেডিয়াম নয়। এসময় শুধু তথ্য সংগ্রহের সমস্যা নয়, আরো অনেক ঘটনা ঘটে। যেমন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দেশ ত্যাগ করে, তাদের মধ্যে অনেকেই ফেরে না, অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, পরিবার-সমাজ বিহীন ভবঘুরে মানুষরাও নিহত হন যাদের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও আছে যুদ্ধের কারণে পরোক্ষ মৃত্যু। যারা হত্যা করে তারাও অপরাধ ঢাকার জন্য মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে। এসব কারণেই যুদ্ধে নিহতের পরিসংখ্যান সব সময় একটা সংখ্যা; একটা নামসহ পূর্নাঙ্গ তালিকা নয়। এটাই পৃথিবীব্যাপী গৃহীত নিয়ম। যারা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তালিকা চায় তাদের যে কোন একটা গণযুদ্ধের বেসামরিক নিহত নাগরিকদের তালিকা দেখাতে বলুন। যুদ্ধে মৃত বা নিখোঁজ সামরিক ব্যাক্তিদের তালিকা করা সম্ভব কিন্তু বেসামরিক ব্যাক্তিদের নয়।

 

আর আমাদের কাছে কিন্তু অসম্পূর্ণভাবে জেলা ওয়ারী নিহত মানুষের তালিকা আছে। যেখানে অর্ধ-পূর্ণ হিসেবে ১৮-টি জেলায় সাড়ে বারো লাখ মানুষের কথা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় একেবারে জেলা ধরে ধরে। এছাড়া শরণার্থী শিবিরে ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। এরপর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি দাবি করেছে যুদ্ধের প্রভাবে আগে ও পরে পরোক্ষ মৃত্যু হয়েছে আরও ৫-৭ লাখ মানুষের।

 

তুলনামূলক জনসংখ্যা বিচার করলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণহত্যার সাথে তুলনা করলে আমরা পাই আমাদের গণহত্যা মোটেও অবিশ্বাস্য কোন ফিগার নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- কম্বোডিয়ার খেমারুজরা ২৬০ দিনে তাদের দেশের ২১ শতাংশ মানুষকে হত্যা করে। এরপর রুয়ান্ডা ১০০ দিনে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ গণহত্যার মাধ্যমে শেষ করে ফেলে। চিনের নানকিং মাসাকারে মাত্র এক মাসে ৩ লাখ মানুষকে শেষ করে দেয়,  আর্মেনিয়ায় জনসংখ্যা ৪৩ লাখ এর ভেতর মারা হয় ১৫ লাখ। নাইজেরিয়ার ৩৫,০০০ সৈনিক ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে।

 

সাড়ে সাত কোটি জনগণের দেশে আর ৯২,০০০ পাকি সৈনিক আর দুই লাখ প্রশিক্ষিত রাজাকার নিয়া একই ৩০ লাখ ফিগার, মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ মানুষের হত্যাকাণ্ড মোটেও অবিশ্বাস্য নয়।

 

এবার ফাইনাল যুক্তিতে আসি; যদি আপনি বংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ভালো করে লক্ষ্য করেন তাহলেই বুঝতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধে আসলে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো।  পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লিপিবদ্ধ আছে জাতিসংঘের কাছে। যে কোন দেশের নামের সাথে 'ডেমগ্রাফি' শব্দটা জুড়ে দিলেই উইকিপিডিয়ার আলদা আলাদা নথি পাবেন, যেমন "Demographics of Bangladesh"। এবং প্রাসঙ্গিকভাবে বলি যদি আগ্রহ থাকে তাহলে এসব ডাটাকে ইনভ্যালিড বলার আগে অন্যান্য দেশের গণহত্যার (যেমন রুয়ান্ডা, নাইজেরিয়া, আর্মেনিয়া, ইরাক, কম্বোডিয়া ইত্যাদি) সালের সাথে ডেমোগ্রাফির জন্ম-মৃত্যু হারের পরিবর্তন লক্ষ করবেন দেখবেন এক্কেবারে এক্যুরেটভাবে বলে দিতে পারবেন কোন দেশে কখন যুদ্ধ হয়েছে।

 

খুবই সহজ পদ্ধতি; যখন দেখবেন মৃত্যুহার অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক কমে গেছে বুঝতে পারবেন সেই দেশে কোনো যুদ্ধ হয়েছিলো। আমার বই 'ত্রিশ লক্ষ শহিদ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা'-তে আমি এরকম ৭টা দেশ নিয়ে গ্রাফসহ হাতেনাতে এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখিয়েছি।

 

এবার দেখুন নিচে UN এর পপুলেশান গ্রোথ রেটে মানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের হিসেবটা কোট করলাম :

১৯৫০-১৯৫৫ সালে ১৪.৬, 
১৯৫৫-১৯৬০ সালে ১৫.৩, 
১৯৬০-১৯৬৫ সালে ১৫.৩,
১৯৬৫-১৯৭০ সালে ১৫.৭, 
১৯৭০-১৯৭৫ সালে ৫.৩ *, 
১৯৭৫-১৯৮০ সালে ১৪.২, 
১৯৮০-১৯৮৫ সালে ১৪.৫, 
১৯৮৫-১৯৯০ সালে ১৪.১

 

 

আপনারা কি লক্ষ করতে পারছেন ১৯৬৫-১৯৭০ সালে গ্রোথ-রেট ১৫ এর উপরে থাকা একটা দেশের পপুলেশান গ্রোথ রেট হঠাৎ ১৯৭০-১৯৭৫ সালে ৫.৩ হয়ে গেলো। যদি আসলেই হিসেবটা করেন তাহলে দেখবেন স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় ৭০১-৭০৬= ৬৫ লক্ষ মানুষের হিসাব মিলছে না। এবং সেই হিসাব আর কখনোই মেলেনি।

 

৭১ থেকে ৭৫ সালের ভেতরে আমাদের দেশ বেশ বড় বড় কয়েকটি দুর্যোগের ভেতর দিয়ে গিয়েছে-

১) সত্তরের ঘূর্ণিঝড়
২) চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ
৩) যুদ্ধের পর ভারতে থেকে যাওয়া শরণার্থী
৪) রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড
৫) মুক্তিযুদ্ধ

 

১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় ছিল একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় যা ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্নিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভঙ্করতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় বদ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কিছু মানুষের মতে এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ছয় থেকে আট লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। যদিও একশ্রেণীর মানুষ দাবি করে থাকে সেই সময় সেরকম কোন দুর্ভিক্ষ হয় নি। তখনকার সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার। শরণার্থী শিবির থেকে না ফিরে আসা মানুষদের সংখ্যা এক্কেবারে নিশ্চিতভাবে অনুমান করা যায় কারণ তৎকালীন ভারত সরকার শরণার্থীদের হিসাব রাখতো। সর্বোচ্চ হিসেবে সংখ্যাটা সাত লক্ষ। আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। এই তিনটি উৎসে হতাহতের সর্বোচ্চ মান যোগ করে পাচ্ছি (৫+৮+৭), বিশ লক্ষ। ৬৫ লাখ থেকে ২০ লাখ বাদ দিলে থাকে ৪৫ লক্ষ। এই ৪৫ লক্ষ মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।

 

১ থেকে ৪ পর্যন্ত ঘটনাগুলোতে যে কোন সোর্স থেকে সর্বোচ্চ দাবিকৃত হতাহতের সংখ্যা দিয়ে হিসেব করুণ, আমার দেয়া সংখ্যাগুলো অবান্তর মনে হলে নিজেরা খোঁজ নিয়ে সংখ্যা বসান। তাহলেই বের হয়ে আসবে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা সম্পর্কে এই থিওরি মতে সর্বনিম্ন সংখ্যাটি। আপনি সৎ হলে যত নিচেই নামুন কোনো হিসাবেই তিরিশ লাখের নিচে নামতে পারবেন না।

 

সবশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন, দেশটা শুধু মায়ের মতো না দেশটা মা-ই। এক একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প, প্রসব যন্ত্রণায় কাতর মায়ের এক একটা আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ যারা অস্বীকার করে, তিরিশ লক্ষ শহীদকে যারা অস্বীকার করে তারা বাঙালি হতে পারে না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়