ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ডিসেম্বর

সেলিনা হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডিসেম্বর

|| সেলিনা হোসেন ||

 

আজ তেরোই ডিসেম্বর।

শীত তেমন পড়েনি। হিমেল আভা ছড়িয়েছে চারদিকে। টুপটাপ শুকনো পাতা ঝরছে আমার বাড়ির চারপাশের গাছ থেকে। একতলা ছোট বাড়িতে শীতের ঘনত্ব বেশি। বড় বড় গাছের কারণে রোদ কম আসে। পাতার ফাঁক গলিয়ে ঠিকমতো বাড়ির প্রাঙ্গণে পৌঁছায় না। তারপরও এই একতলা বাড়িটিতে বসবাস আমার আনন্দ। বাড়িতে পাখি আসে। ওড়াউড়ি করে, গান গায়। নিরিবিলি চুপচাপ বাড়িটা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বুঝি শহরে নেই। শহরের বাড়ি থেকে অনেকদূরে কোনো এক নির্জন প্রান্তরে বাস করছি। প্রান্তরের মাঝখানে এই একতলা, যার দেয়ালে রঙ সাদা। দরজা-জানালা পুরনো। ডেভেলপাররা আসে। বাড়িটিকে ভেঙে বহুতল ভবন করতে চায়। বলে, জায়গাটি অমূল্য রতন। হাইরাইজ বিল্ডিং করলে বদলে যাবে আমার জীবন। আমি এখন পর্যন্ত রাজি হইনি।

সেজুতি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে, আর কবে রাজি হবে? বয়স তো ষাটের কাছাকাছি হলো।

 

আমি সেজুতিকে মৃদু হেসে সান্ত্বনা দেই। নানা কথা বলি। যেটুকু বললে ও শান্ত হবে সেটুকুই। আমাদের ছেলেমেয়ে নেই। আমরা সাতাশ বছর ধরে একসঙ্গে আছি। আমরা ভালোই আছি। দুজন দু’জনকে বুঝি। বড় ধরনের সমস্যা নেই। বলব, বেঁচে থাকা মোটামুটি সহজই।

 

আমি জানি আজকের দিন ধরলে আমার বয়স সাতান্ন বছর তিন মাস ছয় দিন হবে। কৈশোরে আমি একটি দৃশ্য দেখেছিলাম। সেই দৃশ্যটি আমার স্মৃতির দেয়ালে সেঁটে আছে। একটুও বিবর্ণ হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে বলেই আমার ধারণা। অন্তত আমার এমনই মনে হয়। দৃশ্যটি দেখার সময় আমার বয়স ছিল তেরো বছর। তখন পর্যন্ত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মাস এবং দিনের হিসাব আমি করতে শিখিনি। দিন গুণতে শিখেছি সেই দৃশ্যটি দেখার পরে। কারণ বাবার ফিরে না আসা সে সময়ে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল।

 

ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে শীত পড়ুক আর না পড়ুক আমি শীতল হতে থাকি। আজকের এই দিনে গায়ের সোয়েটার আমার শীত ঠেকাতে পারছে না। কাঁপুনি হচ্ছে মাঝে মাঝে। ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। শীতের কাঁপুনি নাকি অন্যকিছু তা নিয়ে আমি ভাবছি। মাঝে মাঝে দৃশ্যটি আমাকে এমন কাঁপায়। কারণ সেই দৃশ্য দেখার পর থেকেই এখন পর্যন্ত আমি নিজেকে বালক ভাবি। আমি আমার বয়স বাড়তে দেই না। যতদিন আমি সেই দৃশ্যটির বিচার পাব না ততদিন এভাবেই চলবে। এবং চলেছে। ডিসেম্বরের সেই দৃশ্য আমাকে আচ্ছন্ন করে। আমি সেজুতিকে এমন ভাবনার কথা বলিনি। প্রেমের সম্পর্কে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু দৃশ্যটিকে আমি নিজের জগৎ বলে আড়াল করে রেখেছি। এই দৃশ্যটির কথা দেশবাসী জানে; আমি যেভাবে দেখেছি সেভাবে নয়। জানে ডিসেম্বরের তেরো তারিখে আলবদর বাহিনীর দু’জন সদস্য এসে বাবাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সেটি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। তার তিন দিন পরে আমরা বিজয় লাভ করেছিলাম। এখন আমি সেইসব অপরাধীর বিচারের অপেক্ষায় আছি।

 

সেজুতি এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। বলে, এমন চুপচাপ বসে আছে যে? কী ভাবছ? আমি উত্তর দেই না। সোয়েটার নাড়াচাড়া করি। যেন আমার সব মনোযোগ ওই সোয়েটারে। কিংবা সেজুতি যা জানতে চেয়েছে তার কোনো উত্তর দেয়ার দরকার আমার নেই। ও আবার বলে, এমন ঝিমিয়ে আছ কেন? কফি খাবে? আনব?

 

আমার বালক বয়সে আমি কখনো কফি খাইনি। যুদ্ধের সময় কফি খাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমার দাদুর বাড়িতে কফির চেয়ে চা বেশি খাওয়া হতো। সেজুতি আমার ঘাড়ে হাত রেখে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে বলে, ডিসেম্বর মাস এলে তুমি বেশি ঝিমিয়ে যাও। তোমার কি যে হয় বুঝি না।

বোস। আমার কাছে বোস সেজুতি। আমি তোমার হাত ধরে রাখব।

আমাদের সন্তান নেই। তারপর তুমি যদি এমন ঝিম মেরে থাক তাহলে আমার দিন কাটতে চায় না।

আমি ওর হাতে চাপ দিয়ে বলি, তুমি না বলো, আমি খুব প্রাণবন্ত, সতেজ মানুষ। এ কারণে আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছিল।

 

সেজুতি আমার হাত নিজের দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিকই বলেছিলাম। তবে ডিসেম্বরে তোমার যেন কী হয়! তোমার ভেতরে কিছু একটা আছে, যা তুমি আমাকে বলো না। কৈশোরে তোমার কাউকে ভালো লেগেছিল কিংবা যৌবনে? যাকে তুমি আর খুঁজে পাওনি?

 

তুমি খুব পানসে কথা বললে সেজুতি। একদম গতানুগতিক। তোমাকে তো বলেছি তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ নেই।

 

যত যা-ই কিছু বলো না কেন, তোমার ভেতরে কিছু একটা আটকে আছে। বাবার মৃত্যু বোধহয়, না? দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মৃত্যু?

 

তুমি আমাকে এ প্রশ্ন অনেকবার করেছ সেজুতি। কিন্তু তুমি জানো যে আমার চোখের সামনে বাবার মৃত্যু হয়নি।

সেজুতি আর কথা বাড়ায় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, বাইরে যাবে?

কোথায় যেতে চাচ্ছ?

বিশেষ কোনো জয়গায় নয়। চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি।

তোমার বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে আজ আর বের হই না। শরীর ভালো লাগছে না। 

ঠিক আছে, আজ ঘরেই থাকি। স্যুপ বানিয়েছি। তুমি বোস। আমি নিয়ে আসছি।

 

সেজুতি চলে যায়। বুঝতে পারি ও খানিক স্বস্তি নিয়ে নিজের বৃত্তে ফিরে গেল। বাচ্চা না থাকার কষ্ট ও যতটা পায়, আমি ততটা পাই না। আমি ওকে স্বস্তিতে রাখারই চেষ্টা করি। ওর জীবনেও স্বাধীনতা যুদ্ধের ত্যাগ আছে। সেজুতি সে গল্প সবার সঙ্গে করে। বিশেষ করে পরিবারের অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে। বলে, তোদের দেশটাকে বুঝতে হবে। দেশের জন্য কিছু করতে হবে। যার যেটুকু সামর্থ্য সেটুকু। সেজুতি আমাকে বলে, এই কথাগুলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কথা। তোমাকে ভালোবাসার মতো একই সমান্তরালের কথা পিয়াল।

 

আমি পিয়াল অনেকদিন আশ্চার্য বিস্ময়ে ওর এসব কথা শুনেছি। কি গভীর মর্মযাতনায় ও যুদ্ধকে ভালোবাসার সঙ্গে মিশিয়ে দিন কাটায়। অথচ নিজের সন্তানদের একথা বলার সুযোগ ও পায়নি। আমাদের বিয়ে হয়েছিল স্বাধীনতার বারো বছর পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে প্রেম হয়। যুদ্ধের সময় সেজুতির বয়স ছিল আট বছর। ওর বাবা মে মাসের দিকে যুদ্ধ করতে চলে গিয়েছিল। ওর মাকে বলেছিল, স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমি যাচ্ছি। যদি ফিরে আসি ভাববে, তোমার ভাগ্যে আমার ফিরে আসা। তোমার জন্য আমার শ্রেষ্ঠ উপহার হবে স্বাধীনতা। আমার মেয়ে হবে স্বাধীনতার ফুল। সেজুতিকে কোলে নিয়ে ওর বাবা কপালে চুমু দিয়েছিল। সে স্মৃতি ওর জীবনের অক্ষয় স্মৃতি। কখনো কখনো কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি চোখ বুঁজলে এই দৃশ্য দেখতে পাই।

 

সেজুতির বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। বড় একটি অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এ খবর যুদ্ধের সময়ই এসেছিল ওদের পরিবারে। বাবার ছবি দেখতে দেখতে বড় হয়েছে সেজুতি। ওর বিষয়টি প্রকাশ্য। ওর বাবার চলে যাওয়ার কথা ও সবাইকে বলে। ওর কষ্ট সবাই বোঝে। ওর বাবা শহীদ হয়েছেন ত্রিপুরা রাজ্যের সবরুম এলাকায়। স্বাধীনতার পরে ওর বাবার যোদ্ধা সঙ্গীদের নিয়ে ওর মা গিয়েছিলেন কবর জিয়ারত করতে। কোনটা ওর বাবার কবর তা আলাদা করে চেনা যায়নি। সেটি একটি গণকবর ছিল। ওর মা কবর না-পাওয়ার কষ্ট নিয়ে দেশে ফিরেছিল। সেজুতিকে ওর মা সঙ্গে নিয়ে যায়নি। বাবা যে গণকবরে আছে সেটিও ওর দেখা হয়নি। আমার সঙ্গে বিয়ের পরে বলেছিলাম, চলো যাই, আমরা বাবার কবর খুঁজে আসি। ও মাথা নেড়ে বলেছিল, না পিয়াল, দরকার নেই। এতদিনে কবরের মাটি সমান হয়ে গেছে। আমার কাছে বাবার চিঠি আছে সেটাই আমার বড় গর্ব স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু। চিঠিটি মা তার মৃত্যুর আগে আমাকে দিয়ে গেছেন। এরচেয়ে বড় সম্পদ আর কি হতে পারে। মাঝে মাঝে বের করে বলে, পিয়াল চিঠিটায় রোদ-আলো লাগাই। যেন বিবর্ণ না হয়। আমি ভেবে দেখেছি ওই চিঠির জন্য আমি সেজুতির প্রেমে পড়েছিলাম। আমার দেখা দৃশ্যের সঙ্গে যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা।

 

তবে সেজুতির প্রকাশ্য কষ্ট আমার নেই। আমি কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। আমার অবরুদ্ধ বুকের ভেতর বেলি ফুলের সৌরভ ছড়ায়। সেখানে স্বাধীনতা ও মৃত্যু আছে। ওই সৌরভ আন্দোলিত করে আমাকে। আমি বিমোহিত হই। বাবার কবর না থাকা আমাকে কষ্ট দেয় না। আমি ভাবতে পারি যে আমার বাবা পুরো দেশজুড়ে আছেন। স্বাধীনতা ও শহীদের সঙ্গে আছেন।

 

সেজুতি স্যুপ দিয়ে চলে গেছে। আমি খেয়ে শেষ করি। না খেলে ওকে কষ্ট দেয়া হবে। আজ আমি বুকের ভেতরের দৃশ্যটিকে খুলে দেয়ার জন্য বাইরে আসি। আমার বাড়ির প্রাচীরের সবটা জুড়ে আছে গাছের সারি। আশপাশে আছে ঝোপের মতো ফুলগাছ। মাঝে মাঝে নিজেই কেটেছেঁটে ছোট করি। বেলি ফুলের ঝোপগুলোর কাছে মাটিতে বসে বুকের দৃশ্যপটে বেলিফুল সাজাই। আমার বাবা এই ফুলটি ভালোবাসতেন। তিনি নিজের হাতে গাছের পরিচর্যা করতেন। বাড়ির বারান্দায় গোটা দশেক টবে বেলি ফুল ফুটতো। সৌরভে আমোদিত হতাম আমরা। বেশি খুশি হতেন মা। বাবার স্মৃতি নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। আমার সঙ্গেই থাকেন। কয়েকদিন আছে অন্য ভাইয়ের বাড়িতে গেছেন। মায়ের দিন এভাবে ঘুরেফিরে কাটে। একসময় শিক্ষকতা করতেন। আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। এখন তার অবসর জীবন। একটি ফুলে হাত রেখে বলি, এই ফুলটা তোমার জন্য মাগো।

 

বাবাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় মা সেদিন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধরে নেয়ার পুরো দৃশ্যটি ওখান থেকে দেখেছিলেন। আমার দাদি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন। দুপুরের খাবার। দুপুরের খাবার দাদু একটা থেকে দেড়টার মধ্যে খেয়ে ফেলতেন। দাদু কিছুই দেখেননি। তিনি খেতে শুরু করবেন বলে টেবিলে গিয়ে বসেছিলেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তিনি খুব ঝিম মেরে থাকতেন। সবার জন্য ভাবতেন। আমার বড় ভাই যুদ্ধে চলে যাবার পরে তিনি আরও বেশি অস্থির হয়ে থাকতেন। আমি তার চারপাশে খুব একটা যেতাম না। আমার খুব ভয় করতো।

 

সেই দুপুরের সময় ছিল বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আমার দাদুর বাড়ির প্রধান গেট আটকে তালা দিয়ে রাখা হতো। যখন-তখন যে কেউ ঢুকে পড়ুক এটা দাদু চাইতেন না। অবশ্য পরিচিতজন এলে সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে ভেতরে ঢোকানো হতো। তারপর আবার আটকে দেয়া হতো। আমাদের বাইরে খেলতে যাবার সুযোগ ছিল না। বাড়ির উঠোনে আমরা ভাইবোনেরা বিকেলে কিছুক্ষণ খেলতাম। তেমন হইচই করে খেলা আমাদেরও হয়ে উঠত না। আমরা অল্পক্ষণে চুপ হয়ে যেতাম। কেন এমন হতো তার কোনো বড় কারণ আমাদের সামনে ছিল না। সবার মধ্যে আমি দু’চার বছরের বড় ছিলাম। আমি সবাইকে বলতাম, যুদ্ধের সময় বাচ্চাদের বেশি খেলতে নেই। ছোট্ট নুহাস বলতো, তাহলে আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলি? যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা কি তা আমরা জানতাম না বলে চুপ করে থাকতাম। তারপর যার যার ঘরে চলে যেতাম। আমাদের মায়েরা দুধ-বিস্কুট দিতেন। খাওয়া হলে পড়াতে বসাতেন। বড়দের সঙ্গে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম, বাবা ঘরে পায়চারি করছেন। বলছেন, পায়ের ব্যথার জন্য আমার যুদ্ধে যাওয়া হলো না। মা বলতেন, ছেলে যুদ্ধ করতে গেছে এটাই তো আমাদের গর্ব। আমি তো নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলি, আল্লাহ ও যেন বীরের বেশে ফিরে আসে।

 

আমার মাথা এলোমেলো লাগছে। আমি ভাবছিলাম সেদিনের দুপুরের কথা। ভাবতে ভাবতে আমি অন্য কোথাও চলে গেছি। বেলি ফুলের গন্ধ টানলে আমি আবার ফিরে আসি সেদিনের দুপুরের সময়ে। আমার বাবা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। নাটকপাগল মানুষ। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গণমানুষের কথা বলতেন। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি এখন এসব বুঝি। আমার কৈশোরে এতকিছু বোঝার বয়স ছিল না। যেদিন আলবদর বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরজায় লাথি দিয়েছিল সেদিন আমি দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখেছিলাম। মবিনুর চাচা এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, আপনারা কী চান?

 

ওরা কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলেছিল, আমরা মফিজুরকে চাই। দরজা খুলে দে। ওকে ডেকে নিয়ে আয়।

 

মবিনুর চাচা দরজা খুললে ওরা রাইফেলের নল চাচার বুকের ওপর তাক করে। আমার বাবা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। বলেন, আমি মফিজুর। কেন আমাকে ডাকছ?

আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

কোথায় যেতে হবে? কেনই বা যাব?

এসব প্রশ্নের জবাব তুমি পাবে না। চল। গাড়িতে ওঠ।

বাবার পিঠে রাইফেলের নলের গুঁতো দিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল ওরা। বাবা আকস্মিক ধাক্কায় পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিয়েছিলেন। চাচাকে বলেছিলেন, বাবা-মাকে বলিস আমি যাচ্ছি। দেখি ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। ওদের নাকের ডগায় বাংলাদেশের পতাকা ঝুলিয়ে দেব।

চল, শুয়োরের বাচ্চা।

ওরা ধাক্কা দিয়ে বাবাকে মাইক্রোবাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। কালো কাপড়ে মুখ-ঢাকা আরও কয়েকজন আশপাশে ছিল। তারা লাফিয়ে গাড়িতে ওঠে। গাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। ছুটে যাই মায়ের কাছে। মাও কাঁদছে। বাড়িজুড়ে কান্না। চাচা চিৎকার করে বলে, আমাদের সামনে স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু। বাড়িজুড়ে তার কণ্ঠস্বর গমগম করে। আমরা চাচাতো ভাইবোনেরা দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। দাদু আমাদের মাথায় হাত বোলান আর দোয়া পড়েন। আমার মা বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছেন। আমি একবার মায়ের কাছে যাই, একবার দাদুর কাছে। কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। শুধু দেখতে থাকি যে দিনের আলো কমে আসছে।

 

আমি জানি আজ সেই তেরোই ডিসেম্বর। বাবার ফিরে আসার অপেক্ষা আমার নেই। আছে নরঘাতকদের বিচার পাওয়ার অপেক্ষা। ট্রাইবুনালের বিচারের রায়ে একজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এটা কার্যকর হবে। আমি সেই দিন গুনছি। টের পাই সেজুতি এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়েছে। মাথার ওপর ওর হাত। বলছে, এই ঠান্ডার মধ্যে মাটিতে বসে আছে কেন? চল, ঘরে চল।

ঘরে বরং খুব ঠান্ডা লাগছিল। এখন মনে হচ্ছে কোনো ঠান্ডা নেই।

তুমি যা বলছ সেটা মেনেই বলছি, এসো। ঘরে যাই। সেজুতি হাত বাড়ায়। আমি ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়াই। পা টলে ওঠে। বুকে ব্যথা হচ্ছে। সেজুতিকে কিছু না বলে সামলে নেই নিজেকে। সোফায় বসে চোখ বন্ধ করি। সেজুতির মোবাইল বাজলে ও মোবাইল নিয়ে বারান্দায় যায়। আমি বুঝতে পারি আমার খুব খারাপ লাগছে। তারপরও ওকে কিছু বলি না। ভাবছি, রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।

 

সেজুতি ফোনে কথা বলে ফিরে এসে বলে, এই ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধীদের একজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হবে। আমি বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাব। তুমি কোথাও যাবে? 

না, আমি বাড়িতেই থাকি। তুমি যাও। কোথায় যাবে?

প্রথমে প্রতিচির বাড়িতে। তারপরে শাহবাগে। গণজাগরণ মঞ্চে। হালিমা ছুটি নিয়েছে। বাড়িতে তোমাকে একাই থাকতে হবে।

অসুবিধা কি? আমার বই আছে। গান আছে। সিনেমা আছে। শব্দ করে হাসে সেজুতি। আমিও ওর সঙ্গে হা-হা করে হাসি। পরক্ষণে টের পাই বুকের ব্যথায় ধাক্কা লাগছে। তখন শুনতে পাই সেজুতি বলছে, তোমার আরও একটি জিনিস আছে। সে কথা তুমি বললে না। তোমার একটি দৃশ্য আছে। এই ডিসেম্বরে তোমার সেই দৃশ্য দেখার যন্ত্রণা কমবে। কারণ তুমি বাবার মৃত্যুর বিচার পাবে।

সেজুতি! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই।

 

আমি তোমার ডায়েরি পড়েছি। তোমাকে কোনোদিন বলিনি। তুমি আমাকে বলোনি দেখে আমিও তোমাকে জানতে দেইনি যে বিষয়টি আমি জানি। নিজের ভেতরে রেখে অপেক্ষা করেছ। আমি তোমার সেই অপেক্ষা ভাঙতে চাইনি। একজন যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর হলে আমিও আমার শহীদ বাবার স্মৃতি নতুন করে পতাকায় জড়াব।

সেজুতি! আমি বিব্রত হই। দৃশ্যের কথা আমি ওর কাছে লুকিয়েছি বলে।

ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমার বিব্রত ভাবকে পাত্তাই দেয় না। হাসতে হাসতে বলে, কংগ্রাচুলেশনস পিয়াল। বিচার পাচ্ছ। আজ শাহবাগে গিয়ে বড় করে স্লোগান দেব। আকাশ-বাতাস ফাটানো স্লোগান।

আমি টের পাই আমার বুকে ব্যথা নেই। আমার দেখা দৃশ্যে আশ্চর্য ফুল ফুটে আছে। আমি চেঁচিয়ে বলি, শহীদের কন্যা তোমাকেও কংগ্রাচুলেশনস! এই ডিসেম্বরে যেদিন ফাঁসি কার্যকর হবে সেদিন আমাদের বুকের ভেতর তুষের আগুন এক কণা নিভবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়