ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিজয় দিবস ২০১৬ : সামান্য ভাবনা

আবুল কাসেম ফজলুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিজয় দিবস ২০১৬ : সামান্য ভাবনা

|| আবুল কাসেম ফজলুল হক ||

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৫ বছর সময়। মুক্তিযুদ্ধের পর এই ৪৫টি বছর পথ অতিক্রম করলাম। ৪৫ বছর আগে বিশ্বব্যবস্থা যে রকম ছিল, আজ সে রকম নেই। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে। উপজেলা হেডকোয়ার্টার, জেলা হেডকোয়ার্টার, রাজধানী ঢাকা- এসবের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, দালানকোঠা, বিলাস-সামগ্রী, অফিস আদালত, স্কুল-কলেজ, দোকান-পাট ইত্যাদি দেখতে গেলে মনে হয়, প্রায় শূণ্য থেকে সমৃদ্ধি অর্জনকারী একটি দেশ।

 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে তেইশ বছরের অগ্রগতিও  দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পকিস্তানের উন্নয়ন অনেক কম ছিল এবং বৈষম্য বিরাট ছিল। এই উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সরকারের ভূমিকা, কি পাকিস্তান আমলে, কি বাংলাদেশ আমলে- বিবেচনাযোগ্য। জনসাধারণ জীবিকার তাগিদে, সুখ সমৃদ্ধির আশায়  প্রাণপনে উৎপাদন করেছে। শ্রমের ক্ষেত্রে গরিব বাঙালির, সাধারণ বাঙালির রেকর্ড সব সময় প্রশংসনীয়। উচ্চ ফলনশীল শস্যবীজ, দ্রুত-বংশবৃদ্ধিকারী হাঁস-মুরগি-মাছ, সিনথেটিক ফাইবার, ডিজিটাল পদ্ধতি- এসবই সমৃদ্ধি অর্জনের কারণ। বাংলাদেশ বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি করছে, পোশাক তৈরি করে বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে বিক্রি করছে, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীতে পণ্য পাঠাচ্ছে এবং এসবের দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। দেশের ভেতরে সিমেন্ট কারখানা, কাপড়ের কল, পোশাক শিল্প ইত্যাদির কিছু প্রসার ঘটেছে। এসবের বাইরে শিল্প-কারখানার বিস্তার উল্লেখযোগ্য নয়।

 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন গোটা পৃথিবী জুড়েই ঘটছে। অভাব, অনটন ও দুর্ভিক্ষের যে ভয়াবহ দৃশ্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এখন থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগেও দেখা যেত, এখন তা আর কোন দেশেই নেই। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রচার করা হয় যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক উন্নয়ন একসঙ্গে সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে রাজনৈতিক উন্নয়নের বিবেচনাকে স্থগিত রাখতে হবে। আর রাজনৈতিক উন্নয়ন চাইলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

 

মাহাথির মুহম্মদ সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি একনায়কত্ববাদী শাসক ছিলেন, সে জন্যই মলেয়েশিয়ার উন্নয়ন তিনি সাধন করতে পেরেছিলেন, গণতন্ত্রী হলে পারতেন না। গণতন্ত্রের ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। গণতন্ত্র আর নির্বাচনতন্ত্র যে এক নয়, একথা কম লোকেই উচ্চারণ করছেন। নানারকম ভালো ভালো কথার মারপ্যাচের মধ্যে উন্নয়ন পরিমাপ করা হচ্ছে কেবল মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি কিংবা মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধি কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে। সবল ও দুর্বলের মধ্যে, ধনী ও গরিবের মধ্যে, সবল রাষ্ট্র ও দুর্বল রাষ্ট্রের মধ্যে, ধনী রাষ্ট্র ও গরিব রাষ্ট্রের মধ্যে বৈষম্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছে। জুলুম-জবরদস্তি, নারী নির্যাতন, পরিবার বিপর্যয়, নারী ও শিশু হত্যা, ঘুষ-দুর্নীতি, হত্যা-আত্মহত্যা বেড়ে চলছে।

 

মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট তত্ত্ব। উস্কানিমুলক বক্তব্য নিয়ে মৌলবাদীবিরোধী প্রচার-আন্দোলন চলিয়ে প্রায় দুনিয়াব্যাপী ধর্মকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে।  যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ন্যাটো বাহিনী সবল অবস্থানে থেকে, উন্নত প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে, মিথ্যার পর মিথ্যা প্রচার করে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক আক্রমন ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিয়েছে তালেবান, আলকায়দা, আইএস ইত্যাদি জঙ্গিবাদী সংগঠন। অনেক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে জঙ্গিবাদ এবং চলছে জঙ্গিবাদী হত্যাযজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে এবং দেশে দেশে কঠোর দমননীতি অবলম্বন করে, দমনমূলক নতুন নতুন আইন জারি করে, জেল-ফাঁসি দিয়ে অপরাধ ও জঙ্গিবাদ দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ-করণীয়-করণ ও ফলাফলের সূত্র ধরে সমস্যাকে বোঝার এবং ন্যায় বাড়ানোর ও অন্যায় কমানোর জন্য বিধি-ব্যবস্থা উন্নত করার কথা ভাবাই হচ্ছে না। এ অবস্থায় দুনিয়াব্যাপী মানুষ আজ মনোবল হারা।

 

নোয়াম চমস্কি, জোসেফ স্টিগলিজ প্রমুখ মনীষী অন্যায়-অবিচারের চিত্র উন্মোচিত করে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন। উন্নততর, নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো রূপকল্প তাঁরা চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না। এক সময় রোমা-রোঁলা, বার্ট্রান্ড রাসেল, আলবার্ট আইনস্টাইন, জাঁপল সাঁর্ত প্রমুখ মনীষী অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, ন্যায় ও মানবতার কল্যাণে বিবৃতি দিয়ে, বই লিখে প্রচারমাধ্যমের যে সমর্থন পেতেন, এঁরা তা পাচ্ছেন না। যাঁরা এখন প্রচারমাধ্যমের সমর্থনপুষ্ট ও জনপ্রিয়, তাঁরা ভিন্ন চরিত্রের ভাবুক-চিন্তক-শিল্পী। সংক্ষেপে এই হল আজকের বিশ্বব্যবস্থার ও মানবতার অবস্থা।

 

পশ্চিমা সভ্যতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে চলছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি সভ্যতার সংকট ও অবক্ষয়ের ধারা বহমান আছে। মাঝখানে (১৮৪৮-১৯৯১) মার্কসবাদ অবলম্বন করে সভ্যতার সংকট কাটিয়ে উন্নততর নতুন বিশ্বব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার সাধনা ও সংগ্রাম দেখা দিয়েছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুপ্তির (১৯৯১) পর শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার বক্তব্য আবেদনহীন  হয়ে পড়েছে।

 

এই বিশ্ববাস্তবতায়, বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা নিরন্তর প্রচার করছি বটে, কিন্তু চলছি মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ, বন্ধুত্ববাদ, এনজিও, সিএসও (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন) ইত্যাদি নিয়ে। আমার তো মনে হয়, যুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বিরোধ আছে। এ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট উপলব্ধি, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও কার্যক্রমের অভাবে যুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন আমরা অল্পই করতে পারছি।

 

ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে আমাদের এত যে আন্দেলন-সংগ্রাম-আত্মত্যাগ, তার ফল কী হচ্ছে? যাকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বলছি তা আসলে কী? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে যে লুটতরাজ চালানো হয়েছে তা তো দুর্বৃত্তরা করেছে। দুর্বৃত্তদের আমরা সমাদর করে সাম্প্রদায়িক বলছি কেন? চোরকে চোর বললে, ডাকাতকে ডাকাত বললে, দুর্বৃত্তকে দুর্বৃত্ত বললে ক্ষতি কী?

 

একদিকে আমাদের যুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অপরদিকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন; একদিকে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, অপরদিকে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস; একদিকে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ অপরদিকে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর আয়োজন- এরই মধ্যে পুলিশ, র‌্যাবের ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কোন গন্তব্যের দিকে আমরা চলছি?

 

এসব প্রশ্নে পরিচ্ছন্ন ধারণা না নিয়ে চলতে থাকলে আমাদের ভুল পথে চলারও সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দরকার দূরদর্শী প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা। এসব নিয়ে আমি চিন্তা করি। আমার ‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’, ‘জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বায়ন ও ভবিষ্যত’, ‘অবক্ষয় ও উত্তরণ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এসব বিষয় নিয়ে আমার কিছু চিন্তার প্রকাশ আছে। চিন্তা ও আলোচনা-সমালোচনা খুব দরকার। একই সঙ্গে অবস্থাকে উন্নত করার জন্য কাজ দরকার। উন্নতি সম্ভব। উন্নতি সাধন করতে হবে।

 

বিজয় দিবসে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের  মহান নেতাদের। শ্রদ্ধা নিবেদন করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। শ্রদ্ধা নিবেদন করছি তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও অন্য সব নেতাকে যাঁরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নিয়েছেন। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ও অগনিত শহীদদের। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল ফজল, আবু মাহমুদ, আহমদ শরীফ প্রমুখ ভাবুক চিন্তকদের যাঁরা তাঁদের চিন্তাশক্তি দিয়ে আমাদের যাত্রাপথকে সুগম করেছেন। অতীতের মহৎদের স্মৃতি সকলের চেতনায় নতুন মহত্বের জন্ম দিক।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়